মনিরউদ্দীন ইউসুফের পিত্রালয় এবং মাতুলালয়
দুই জমিদার বাড়ির কথা
এ টি এম নিজাম, কিশোরগঞ্জ
প্রকাশ: ১১ মে ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
সাহিত্যের প্রতিটি ক্ষেত্রে অসামান্য কৃতিত্ব প্রদর্শনের পাশাপাশি ফার্সি ভাষায় রচিত মহাকবি ফেরদৌসীর মহাগ্রন্থ ‘শাহনামা’র বাংলা অনুবাদের অসাধারণ কাজ করে যিনি বাংলার ফেরদৌসী হিসাবে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন তিনি হলেন কবি মনিরউদ্দীন ইউসুফ।
মোগল সম্রাট জাহাঙ্গীরের দরবারের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার উত্তর পুরুষ বাঙলা সাহিত্যের এই বাতিঘর মসনদে আলা বীর ঈসা খাঁর পরগনার কিশোরগঞ্জ সদর উপজেলার বৌলাই জমিদার বাড়ির সন্তান। তার মাতুলালয়ও জেলার তাড়াইল উপজেলার জাওয়ার জমিদার বাড়ি। প্রতিদিন দেশের দূর-দূরান্ত থেকে কিশোরগঞ্জের এই দুই জমিদার বাড়ি (সাহেব বাড়ি) পরিদর্শনে আসেন বহু পর্যটক-দর্শনার্থী। এদের মধ্যে সাহিত্য রসিক লোকজন সেখানে খুঁজে ফেরেন বাঙলার ফেরদৌসী খ্যাত কবি-ঔপন্যাসিক মনিরউদ্দীন ইউসুফের পদচিহ্ন এবং সৃষ্টি কর্মের সংগ্রহশালা। কিন্তু; এসব কিছু না পেয়ে হতাশ হয়ে ফিরে যান তারা।
এ নিয়ে কথা হলে মনিরউদ্দীন ইউসুফের ভাগনে এহতেশাম উদ্দীন আহমেদ পারভেজ যুগান্তরকে জানান, পৈতৃক নিবাস বৌলাই সাহেব বাড়িতে মনিরউদ্দীন ইউসুফের সাহিত্য সম্ভার নিয়ে একটি সংগ্রহশালা বা গ্রন্থাগার গড়ে তোলার বিষয়ে কাজ চলছে। প্রচারবিমুখ সব্যসাচী লেখক কবি মনিরউদ্দীন ইউসুফ ছিলেন একাধারে ঔপন্যাসিক, নাট্যকার, সম্পাদক ও অনুবাদক। তিনি ৩৭টি গ্রন্থ রচনা এবং অনুবাদ করেন। ইরানের বর্তমান রাজাভীর খোরাসান প্রদেশের মহাকবি ফেরদৌসীর শাহনামা বাংলায় অনুবাদ করার অসামান্য কৃতিত্ব প্রদর্শন করার জন্য তিনি ‘বাংলার ফেরদৌসী’ নামেই সমধিক পরিচিত।
এছাড়াও ছোটদের জন্য তিনি লিখেছেন-‘ছোটদের ইসলাম পরিচয়’, ‘ছোটদের রসুল চরিত্র’, ‘মহাকবি ফেরদৌসী’, ‘চল যাই ছড়ার দেশে’ ইত্যাদি। এছাড়া তিনি ‘হজরত আয়েশা’ এবং ‘হজরত ফাতেমা’ নামে দুটি জীবনী গ্রন্থও রচনা করেন। মনিরউদ্দীন ইউসুফের মৌলিক কবিতার মধ্যে ‘এক ঝাঁক পায়রা’, ‘বেতস পাতা জলের ধারা’, ‘রাত্রি নয় কলাপি ময়ূর নয়’, ‘মনিরউদ্দীন ইউসুফের অগ্রন্থিও কবিতা’ উল্লেখযোগ্য।
ছাত্রজীবনে তার একটি কবিতার বই বের হয়েছিল যার নাম ‘উপায়ন’। তার এই কবিতাগুলোর মধ্যে একটি বই বাংলা গজলে পূর্ণ। জাতীয় কবি নজরুলের পর গজলে এমন কাজ বাংলায় আর হয়নি। কবি মনিরউদ্দীন ইউসুফ উপন্যাস এবং নাটকও লিখেছেন। উপন্যাসগুলোর নাম ‘ঝড়ের সাথে শেষে’, ‘পনসের কাঁটা’ এবং ‘ওর বয়স যখন এগারো’। তার শেষ দুটো উপন্যাসের পটভূমি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ এবং স্বাধীনতা-পরবর্তী ঘটনা চিত্র।
বাংলা সাহিত্যে এমন অসাধারণ অবদানের জন্য ১৯৭৮ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কার এবং ১৯৯৩ সালে বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক প্রদত্ত সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা একুশে পদকে ভূষিত হন মনিরউদ্দীন ইউসুফ। তিনি একুশে পদক ছাড়াও আরও যেসব পুরস্কার পেয়েছেন সেগুলো হলো-গভর্নর স্বর্ণপদক (১৯৬৮), হাবিব ব্যাংক সাহিত্য পুরস্কার (১৯৬৮), বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার (১৯৭৮) এবং আবুল মনসুর আহমদ সাহিত্য পুরস্কার (১৯৮৫) ইত্যাদি।
নিভৃতচারী-প্রচারবিমুখ ব্যক্তিত্ব মনিরউদ্দীন ইউসুফ ১৯১৯ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি তার নানার বাড়ি কিশোরগঞ্জ জেলার তাড়াইল উপজেলার জাওয়ার জমিদার বাড়িতে (সাহেব বাড়ি) জন্মগ্রহণ করেন। তার নানা ছিলেন জাওয়ারের জমিদার আবদুল হাকিম খান চৌধুরী। কবি মনিরউদ্দীন ইউসুফের পৈতৃক বাড়ি কিশোরগঞ্জের সদর বৌলাই গ্রামে। বৌলাইয়ে তার পরিবার এক প্রাচীন সম্ভ্রান্ত মুসলিম জমিদার পরিবার হিসাবে পরিচিত। জানা যায়, কবি মনিরউদ্দীন ইউসুফের পূর্বপুরুষ বাগদাদ থেকে মোগল সম্রাট জাহাঙ্গীরের আমলে দিল্লিতে আসেন এবং সেখানকার দরবারে ‘আমির’ হিসাবে যোগদান করেন।
পরে তার এক পৌত্রকে সুবা-বাংলার কিশোরগঞ্জের ভাটি বাংলায় অবস্থান করার নির্দেশ দান করা হয়। তার নাম ছিল শেখ করিম খান-যিনি করিম খান আমীরুল বহর নামে পরিচিত। অর্থাৎ ওই এলাকার নৌবাহিনীর কর্তৃত্ব ভার তাকে দেওয়া হয়। আরও জানা যায়, সম্রাট আকবরের সঙ্গে ঈসা খাঁর যে সন্ধিচুক্তি হয়, তারই ধারাবাহিকতায় করিম খাঁর এই নিযুক্তি। মনিরউদ্দীন ইউসুফের পিতা মিজবাহ উদ্দীন আহমদ এবং মাতা সানজিদা খাতুন।
বাংলা সাহিত্যের এই অসামান্য কৃতিত্ব ও প্রতিভার অধিকারী মনিরউদ্দীন ইউসুফ ১৯৮৭ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি ৬৮ বৎসর বয়সে তিনি বিশাল সাহিত্য সম্ভার আর স্ত্রী, দুই ছেলে ও এক মেয়ে রেখে ইন্তেকাল করেন। মীরপুর বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে তার লাশ দাফন করা হয়। ইতোমধ্যে মেয়ে ব্যতীত অন্যরাও অনন্তপথের যাত্রী হয়েছেন।
