চলে গেলেন বিশ্বের ‘দরিদ্র প্রেসিডেন্ট’
শাবনুর নাহার
প্রকাশ: ১৫ মে ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
উরুগুয়ের ‘নয়নমণি’ সাবেক প্রেসিডেন্ট হোসে মুজিকা (৮৯) আর নেই। ধূলি-ধূসর পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে মঙ্গলবার পরপারে চলে গেলেন তিনি। উরুগুয়ের বর্তমান প্রেসিডেন্ট ইয়ামান্দু ওরসি মঙ্গলবার তার এক্সে দেওয়া পোস্টে মুজিকার মৃত্যুর খবরটি নিশ্চিত করেন। লিখেছেন, ‘আপনি আমাদের যা কিছু দিয়েছেন এবং এই দেশের মানুষদের প্রতি আপনার যে গভীর ভালোবাসা ছিল, তার জন্য কৃতজ্ঞতা।’ মুজিকার মৃত্যুর কারণ জানা যায়নি। তবে তিনি খাদ্যনালির ক্যানসারে আক্রান্ত ছিলেন। বিবিসি।
দেশটির ৩৪ লাখ মানুষের প্রিয় ‘প্রেসিডেন্ট’ মুজিকা ‘পেপে’ নামেও পরিচিত। তবে ‘বিশ্বের দরিদ্র প্রেসিডেন্ট’ নামেই সবচেয়ে বেশি পরিচিত তিনি। কিন্তু বাস্তবটা ঠিক উলটো। তিনি ছিলেন ধনীদের চেয়েও ধনী-হৃদয়ের প্রাচুর্যে। তার ছিল না কোনো প্রাসাদ। ছিল না দেহরক্ষীতে ঘেরা গাড়িবহর। প্রেসিডেন্ট ছিলেন অথচ বাস করতেন ছোট্ট এক বাড়িতে। হাঁটতেন সাধারণ জুতা পরেই। রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পদে থেকেও নিজের পুরোনো বিটল গাড়ি চালিয়ে ঘুরে বেড়াতেন। আর বেতনের প্রায় সবটাই বিলিয়ে দিতেন অসহায়দের মাঝে। মঙ্গলবার ৮৯ বছর বয়সে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন এই বিপ্লবী নেতা। মৃত্যুর আগের মাসগুলোতে ক্যানসারের সঙ্গে লড়াই করে নিজ বাড়িতে নিঃশব্দে কাটিয়েছেন জীবনের শেষ সময়টা। পাশে ছিলেন স্ত্রী লুসিয়া তোপোলানস্কি। উরুগুয়ের ভাইস প্রেসিডেন্ট ছিলেন তিনি। এএফপি।
মুজিকা ছিলেন উরুগুয়ের একজন প্রভাবশালী রাজনীতিবিদ, বিপ্লবী নেতা ও কৃষক। তিনি ২০১০ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত দেশটির ৪০তম প্রেসিডেন্ট হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। তার জীবনযাত্রার সরলতা ও নীতিগত অটলতার জন্য তিনি বিশ্বব্যাপী প্রশংসিত হন। কারাগারের অন্ধকার গর্তে কাটিয়েছেন এক যুগেরও বেশি। আবার সেখান থেকেই উঠে এসে দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় ও প্রগতিশীল নেতা হয়ে উঠেছেন। সারা জীবন কাটিয়েছেন লড়াই করে। প্রথমে সমাজ বদলাতে, পরে নিজেকে বদলে সমাজকে আলোকিত করতে।
শৈশব ও সংগ্রামী উত্থান : হোসে মুজিকা ১৯৩৫ সালের ২০ মে উরুগুয়ের রাজধানী মন্টেভিডিওতে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা ছিলেন ইতালিয়ান ও মা ছিলেন স্প্যানিশ বাস্ক বংশোদ্ভূত। খুব অল্প বয়সেই বাবাকে হারান। এরপর তাকে বড় করেন তার মা। সংসারের খরচ চালাতে মা-ছেলে মিলে ফুল বিক্রি করতেন। শৈশব থেকেই দরিদ্রতার সঙ্গে লড়াই করেছেন মুজিকা।
বিপ্লবী যাত্রা ও গেরিলা আন্দোলন : রাজনীতিতে হাতেখড়ি হয় উরুগুয়ের রক্ষণশীল জাতীয় পার্টিতে যোগ দিয়ে। তবে সমাজে বৈষম্য আর দমন-পীড়নের চিত্র তাকে ধীরে ধীরে বামপন্থার দিকে টেনে নেয়। ষাটের দশকে কিউবার বিপ্লব দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে তুপামারোস ন্যাশনাল লিবারেশন মুভমেন্ট (এমএলএন-টি) নামের বামপন্থি গেরিলা সংগঠনে যোগ দেন। তিনি ছিলেন সংগঠনটির সহপ্রতিষ্ঠাতা। প্রাথমিকভাবে ধনীদের কাছ থেকে লুট করে দরিদ্রদের মধ্যে বিতরণ করলেও পরে সংগঠনটি অপহরণ, বোমা হামলা ও হত্যাকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ে। তবে মুজিকা জানিয়েছেন, কোনো হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে তিনি জড়িত ছিলেন না।
বারবার গুলিবদ্ধ ও গ্রেফতার : কিউবার বিপ্লব এবং আন্তর্জাতিক সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে উরুগুয়ের তৎকালীন সরকারের বিরুদ্ধে গোপন প্রতিরোধে নামে তুপামারোস। যদিও তৎকালীন সরকার সাংবিধানিক কাঠামোর মধ্যেই পরিচালিত হচ্ছিল এবং নিজেকে গণতান্ত্রিক বলেই দাবি করত। বামপন্থিরা সরকারকে ক্রমবর্ধমান কর্তৃত্ববাদী বলে মনে করতেন। এই প্রেক্ষাপটে হোসে মুজিকা সক্রিয় হন বিপ্লবী কার্যক্রমে। একবার ১৯৭০ সালে একটি অভিযানের সময় পুলিশ তার শরীরে ছয়বার গুলি চালায়। মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে আসেন মুজিকা। এরই মধ্যে তাকে চারবার আটক করা হয়। ১৯৭১ সালে প্রথমবার আটক হন তিনি। গ্রেফতার হওয়ার পর মুজিকা দুবার জেল ভেঙে পালাতে সক্ষম হন। তার মধ্যে একটি পালানোর ঘটনা ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে আছে, যখন তিনি ১০৫ জন তুপামারো বন্দির সঙ্গে টানেলের ভেতর দিয়ে পালিয়ে যান।
দীর্ঘ কারাবাস ও নির্যাতন : ১৯৭৩ সালে উরুগুয়ের সামরিক বাহিনী অভ্যুত্থান ঘটালে ভেঙে পড়ে তুমারোস আন্দোলন। সে সময়ই আবারও কারাবন্দি হন মুজিকা। টানা ১২ বছর কেটেছে একাকী নিঃসঙ্গ বন্দিত্বে। ১৯৮৫ সালে উরুগুয়ে আবার গণতন্ত্রে ফিরলে সাধারণ ক্ষমায় মুক্তি পান তিনি। তবে কারাবাসের সময় চরম নির্যাতনের শিকার হয়েছেন মুজিকা।
রাজনীতিতে প্রত্যাবর্তন ও প্রেসিডেন্ট পদে অধিষ্ঠান : মুক্তির পর ধীরে ধীরে মূল ধারার রাজনীতিতে ফিরে আসেন মুজিকা। প্রথমে ১৯৯৫ সালে সংসদ-সদস্য এবং পরে ২০০০ সালে সিনেটর হিসাবে প্রত্যাবর্তন হয় তার। এরপর ২০০৫ সালে উরুগুয়ের প্রথম বামপন্থি সরকারের মন্ত্রী হন। সফল মন্ত্রিত্বের পর ২০১০ সালে প্রেসিডেন্ট হিসাবে শপথ নেন। ২০১৫ সাল পর্যন্ত দেশটির ৪০তম প্রেসিডেন্ট হিসাবে দায়িত্ব পালন করে ইতিহাস সৃষ্টি করেন মুজিকা।
সাধারণ জীবনযাপন : মুজিকার জীবনযাপন ছিল অত্যন্ত সাধারণ। প্রেসিডেন্ট হয়েও সাধারণ মানুষের মতোই জীবনযাপন করতেন তিনি। পরিবার নিয়ে তার ছোট খামারের বাড়িতেই থাকতেন। চালাতেন পুরোনো একটি গাড়ি। দেশ গড়ার দায়িত্বের পাশাপাশি কৃষিকাজও করতেন। এক কথায় তার জীবন ছিল অত্যন্ত সাদাসিধে। যার জেরেই নাম দেওয়া হয় দরিদ্র প্রেসিডেন্ট। তার অঙ্গীকার ছিল সমাজের জন্য কিছু করা এবং অতিরিক্ত বিলাসিতা বা ঐশ্বর্য থেকে দূরে থাকা। নিজের ভাগের বেশির ভাগ টাকাও দিয়ে দিতেন দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাসকারী মানুষদের। তার এই জীবনধারা এবং দানশীলতা আন্তর্জাতিক মহলে তাকে এক অনন্য রাজনৈতিক নেতা হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।
সামাজিক সংস্কার : সামাজিক সংস্কারে বেশ খ্যাতি অর্জন করেছেন মুজিকা। নবায়নযোগ্য শক্তির প্রতি গুরুত্ব দিয়ে উরুগুয়েকে বিশ্বের অন্যতম পরিবেশবান্ধব দেশ হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন তিনি।
অবসর ও শেষ ইচ্ছা : ২০২০ সালে সিনেটর পদ থেকে অবসর নেন। তবে রাজনৈতিকভাবে সক্রিয় ছিলেন। গত বছরের মে মাসে তার ক্যানসার ধরা পড়ে। ২০২৫ সালের জানুয়ারিতে লিভারে ক্যানসার ছড়িয়ে পড়ে। চিকিৎসা বন্ধ করে স্ত্রী লুসিয়া তোপোলানস্কির সঙ্গে শান্তিপূর্ণভাবে বাকি জীবন কাটানোর সিদ্ধান্ত নেন তিনি। তাদের কোনো সন্তান ছিল না। মন্টেভিডিওর কাছে তার বাসভবনে (কৃষি খামার) শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন মুজিকা। তার শেষ ইচ্ছা অনুযায়ী তাকে দাফন করা হবে নিজের খামারে, প্রিয় কুকুরটির পাশে।
লাতিন আমেরিকায় শোকের ছায়া : মুজিকার মৃত্যুতে লাতিন আমেরিকাজুড়ে শোকের ছায়া পড়েছে। দেশটির বর্তমান প্রেসিডেন্ট ইয়ামান্দু ওরসি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে তার মৃত্যুর খবরটি নিশ্চিত করেছেন। তিনি লিখেছেন, ‘আপনি আমাদের যা কিছু দিয়েছেন এবং এই দেশের মানুষদের প্রতি আপনার যে গভীর ভালোবাসা ছিল তার জন্য আমরা কৃতজ্ঞতা।’ এছাড়া কলম্বিয়ার প্রেসিডেন্ট গুস্তাভো পেত্রো, বলিভিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট ইভো মোরালেস, মেক্সিকোর প্রেসিডেন্ট ক্লডিয়া শেইনবাউম, ব্রাজিলের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, চিলির প্রেসিডেন্ট গ্যাব্রিয়েল বোরিকসহ বিশ্বের বিভিন্ন নেতা তার মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেছেন
