প্রধান উপদেষ্টার কাছে স্মারকলিপি
এনবিআর বিলুপ্তির অধ্যাদেশ একটি গোষ্ঠীর স্বার্থে জারি
যুগান্তর প্রতিবেদন
প্রকাশ: ২৩ মে ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
জাতীয় স্বার্থ নয়, বরং একটি গোষ্ঠীর স্বার্থে তড়িঘড়ি করে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) বিলুপ্তির অধ্যাদেশ জারি করা হয়েছে। মধ্যরাতে অত্যন্ত গোপনীয়তার সঙ্গে অধ্যাদেশ জারির আগে ব্যবসায়ী নেতা, সুশীল সমাজ, রাজনৈতিক নেতসহ সংশ্লিষ্ট অংশীজনের সঙ্গে আলোচনা করা হয়নি। এ অধ্যাদেশের ফলে রাজস্ব ব্যবস্থাপনায় অযাচিত হস্তক্ষেপের সুযোগ সৃষ্টি হওয়ায় রাজস্ব ব্যবস্থাপনার সার্বিক কার্যকারিতা বাধাগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। বৃহস্পতিবার প্রধান উপদেষ্টার কাছে এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদের দেওয়া স্মারকলিপিতে এ কথা বলা হয়। স্মারকলিপিতে এনবিআর বিলুপ্তির প্রক্রিয়া, আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে রাজস্ব সংস্থাগুলোর কাজের ধরন এবং উদ্ভূত পরিস্থিতিতে ঐক্য পরিষদের ৪ দফা দাবি তুলে ধরা হয়েছে। এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদের পক্ষে স্মারকলিপি দেন কাস্টমসের অতিরিক্ত কমিশনার হাছান মুহম্মদ তারেক রিকাবদার, অতিরিক্ত কর কমিশনার সেহেলা সিদ্দিকা, উপকর কমিশনার শিহাবুল ইসলাম কুশল, রাজস্ব কর্মকর্তা শফিউল বসর, কর পরিদর্শক মুতাসিম বিল্লাহ।
স্মারকলিপিতে বলা হয়, ১২ মে মধ্যরাতে প্রাচীন ও পরীক্ষিত এনবিআর বিলুপ্ত করে রাজস্ব নীতি ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনা অধ্যাদেশ জারি করা হয়। এ অধ্যাদেশটি অত্যন্ত গোপনে, অতি দ্রুততার সঙ্গে এবং প্রত্যাশী সংস্থা, ব্যবসায়ী সংগঠন, সুশীল সমাজ, রাজনৈতিক নেতৃত্বসহ সংশ্লিষ্ট সব অংশীজনকে অজ্ঞাত রেখে জারি করা হয়েছে। অধ্যাদেশে জাতীয় স্বার্থকে ক্ষুণ্ন করে নির্দিষ্ট গোষ্ঠী বা প্রভাবশালী মহলের স্বার্থকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে। অধ্যাদেশে এনবিআর-এর সাংগঠনিক স্বাতন্ত্র্য ও পেশাগত স্বকীয়তাকে অস্বীকার করা হয়েছে এবং রাজস্ব আহরণের প্রক্রিয়াকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি রাজস্ব ব্যবস্থাপনায় অযাচিত হস্তক্ষেপের সুযোগ সৃষ্টি হওয়ায় রাজস্ব ব্যবস্থাপনার সার্বিক কার্যকারিতা বাধাগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
এতে আরও বলা হয়, সরকারের আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে একমত পোষণ করে এনবিআর-এ কর্মরত কর্মকর্তা-কর্মচারীরা রাজস্ব প্রশাসনের আমূল সংস্কার চান। এটি এনবিআর-এ কর্মরতদের দীর্ঘদিনের দাবি। তবে এ সংস্কার হতে হবে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে স্বীকৃত সর্বোত্তম ব্যবস্থা ও পদ্ধতির অনুরূপ। দেশের স্বার্থ ও উন্নয়ন দর্শন এতে সঠিকভাবে প্রতিফলিত হবে; রাজস্ব প্রশাসন অধিকতর কার্যকর, প্রগতিশীল ও দুর্নীতিমুক্ত হবে এবং সংস্কার বিশেষ কোনো স্বার্থ হাসিলের হাতিয়ার হবে না।
জারিকৃত অধ্যাদেশের বিষয়ে আপত্তির কথা জানিয়ে স্মারকলিপিতে বলা হয়, অধ্যাদেশটি একটি বিশেষ গোষ্ঠী বা প্রভাবশালী মহলের সুবিধামতো তৈরি করা হয়। তড়িঘড়ি করে অধ্যাদেশটি ?জারির মাধ্যমে দেশের বৃহত্তর স্বার্থকে জলাঞ্জলি দেওয়া হয়েছে, যা জুলাই ছাত্র-জনতার বিপ্লবের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত জন-আকাঙ্ক্ষার অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ভালো কাজ ও উদ্দেশ্যকে প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়েছে। অধ্যাদেশে এনবিআর-এর আয়কর, কাস্টমস ও ভ্যাট বিভাগের কর্মকর্তাদের দীর্ঘমেয়াদি অভিজ্ঞতা ও পেশাগত দক্ষতার মূল্যায়ন করা হয়নি।
এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদ ‘কেমন সংস্কার চাই’, তাও স্মারকলিপিতে উল্লেখ করেছে। এতে বলা হয়েছে, শুধু কাঠামোগত বিভাজন নয়, এনবিআর-এর দীর্ঘদিনের সমস্যা যেমন: রাজস্ব ব্যবস্থাপনায় অনভিজ্ঞ নেতৃত্ব, দ্বিস্তরবিশিষ্ট প্রশাসন, সীমিত জনবল, অপ্রতুল অবকাঠামো ও লজিস্টিকস, পরস্পর সংযুক্ত অটোমেশনের ঘাটতি, বিপুল অঙ্কের অনানুষ্ঠানিক অর্থনীতির জায়গাগুলোয় সংস্কার প্রয়োজন। এনবিআর-এ কর্মরতরা এমন সংস্কার চান, যেখানে যোগ্যতা ও পেশাগত দক্ষতার মূল্যায়ন থাকবে, আমলাতান্ত্রিকতা নয়, যোগ্যতা ও বিশেষায়িত জ্ঞান অগ্রাধিকার পাবে। এক্ষেত্রে কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, জার্মানি, যুক্তরাজ্য, ইন্দোনেশিয়া অথবা কেনিয়ার মতো দেশগুলোর রেভিনিউ এজেন্সির মডেল ফলো করা যেতে পারে। এনবিআর-এ কর্মরতরা এমন একটি রাজস্ব ব্যবস্থাপনা চান, যেখানে তিন বিভাগ-আয়কর, কাস্টমস ও ভ্যাটের সব ফাংশন অটোমেটেড হবে। তিন উইংয়ের মধ্যে ইন্টিগ্রেশন থাকবে। সেই ইন্টিগ্রেটেড সিস্টেম দেশের ব্যাংকিং সিস্টেমের সঙ্গে সংযুক্ত থাকবে, যা রাজস্ব ব্যবস্থায় গতিময়তা, স্বচ্ছতা আনবে এবং বাণিজ্য সহজীকরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
কেন কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কলমবিরতির মতো আন্দোলনে নামতে হলো, এর পটভূমিও স্মারকলিপিতে উল্লেখ করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, রাজস্ব খাত সংস্কারবিষয়ক পরামর্শক কমিটির সংস্কার প্রস্তাবকে পাশ কাটিয়ে সবার অগোচরে অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ থেকে আরেকটি খসড়া প্রস্তাব করা হয়। এ নিয়ে এনবিআর-এ কর্মরত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মাঝে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। ক্ষোভের বিষয়ে একাধিকবার এনবিআর চেয়ারম্যানকে অবহিত করা হলেও তিনি তা আমলে নেননি। সব কর্মকর্তার মতামতকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে এনবিআর চেয়ারম্যান অনির্বাচিত দুই অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতিকে নিয়ে অর্থ উপদেষ্টার সঙ্গে দেখা করেন এবং রাজস্ব সংস্কার কমিটির প্রতিবেদনের পরিপন্থি একটি মডেল সমর্থন করেন। যার প্রতিফলন ১২ মে জারিকৃত অধ্যাদেশে দেখা যায়। মতামত উপেক্ষা করে অধ্যাদেশটি জারি করায় এনবিআর-এ কর্মরত সব শ্রেণির কর্মকর্তা-কর্মচারী ক্ষুব্ধ হয়েছেন।
স্মারকলিপিতে ঐক্য পরিষদের পক্ষ থেকে ৪টি দাবি জানানো হয়। এগুলো হচ্ছে-জারিকৃত অধ্যাদেশ অবিলম্বে বাতিল করতে হবে। অবিলম্বে এনবিআর চেয়ারম্যানকে অপসারণ করতে হবে। রাজস্ব সংস্কারবিষয়ক পরামর্শক কমিটির সুপারিশ জনসাধারণের জন্য ওয়েবসাইটে প্রকাশ করতে হবে। পরামর্শক কমিটির সুপারিশ আলোচনা-পর্যালোচনা করে প্রত্যাশী সংস্থা, ব্যবসায়ী সংগঠন, সুশীল সমাজ, রাজনৈতিক নেতৃত্বসহ সংশ্লিষ্ট সব অংশীজনের মতামত নিয়ে উপযুক্ত ও টেকসই রাজস্ব ব্যবস্থা সংস্কার নিশ্চিত করতে হবে।
