Logo
Logo
×

শেষ পাতা

১১ বুলেটে ঝাঁজরা হয় জনির বুক

হত্যার আগে টর্চার সেলে ডিবির অমানবিক নির্যাতন

১০ বছর পর মামলা করলেও তদন্তে কচ্ছপগতি অসন্তুষ্ট পরিবার

ইমন রহমান

ইমন রহমান

প্রকাশ: ৩১ মে ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

হত্যার আগে টর্চার সেলে ডিবির অমানবিক নির্যাতন

রাজধানীর খিলগাঁও থানা ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন নুরুজ্জামান জনি (৩০)। তার পৈতৃক নিবাস খিলগাঁও তিলপাপাড়া। এলাকায় ছিল গোষ্ঠীগত প্রভাব। এ প্রভাবই কাল হয় জনির। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন-পরবর্তী বিএনপির ডাকা আন্দোলন চলাকালে গ্রেফতার হন তিনি। প্রথমে রাজধানীর মিন্টু রোডে ডিবি কার্যালয়ের টর্চার সেলে নিয়ে হাত-পা ও চোখ বেঁধে চালানো হয় অমানবিক নির্যাতন। সেদিন মধ্যযুগীয় কায়দায় বিএনপির আরও অনেক নেতাকর্মীকে নির্যাতন করে ডিবি পুলিশ। পরে সাজানো বন্দুকযুদ্ধে ১৬টি বুলেটবিদ্ধ হয় জনির শরীরে, যার ১১টিতে ঝাঁজরা হয় বুক। গুলিবিদ্ধ হয়ে ‘ও মাগো, মা, মা...বাঁচাও’ বলে আর্তনাদ করেন জনি। ঘটনার সময় বিচার চাওয়ারও সাহস পায়নি পরিবার। এ ঘটনার ১০ বছর পর মামলা করলেও তদন্তে কচ্ছপগতিতে অসন্তুষ্ট জনির পরিবার।

জনির স্বজন ও পরিবার সূত্র বলছে, জনিকে আটকের বিষয়টি গোপন রাখে ডিবি পুলিশ। জনির খোঁজে হন্যে হয়ে ছোটেন বাবা ইয়াকুব আলী ও সাত মাসের অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী মুনিয়া পারভীন। খিলগাঁও থানা, ডিবি কার্যালয়সহ বিভিন্ন জায়গায় যান তারা। কিন্তু কেউ জনির তথ্য দেয়নি, গ্রেফতারের বিষয়টি পরিবারের কাছে স্বীকারও করেনি ডিবি। নিখোঁজের একদিন পর বাসার কাছাকাছি তিলপাপাড়া জোড়াপুকুর মাঠে পড়ে ছিল জনির ক্ষতবিক্ষত লাশ। রোববার সকালে খিলগাঁও থানাধীন তিলপাপাড়া আট নম্বর সড়কের ২০১নং বাড়িতে গিয়ে কথা হয় নুরুজ্জামান জনির বাবা মো. ইয়াকুব আলী ও ছোট ভাই থানা ছাত্রদলের বর্তমান সভাপতি মনিরুজ্জামান হীরার সঙ্গে। বড় ভাই জনির কথা বলতে গিয়ে দুচোখ ভিজে আসে হীরার। তিনি বলেন, ভাইয়ের মৃত্যুর খবর শুনলেও শেষ দেখাটা হয়নি।

বাবা ইয়াকুব আলী স্মৃতিচারণা করে বলেন, জোড়াপুকুর মাঠের পাশে যেখানে জনির লাশ ফেলে রাখে, সেখানে ঘাসের ওপর ছোপ ছোপ জমাট বাঁধা রক্ত ছিল। আমি নিজ হাতে পানি দিয়ে ধুয়ে দিয়েছিলাম। মাঠের আশপাশের বাসিন্দারা জানান, হত্যার আগে ওই রাতে জনিকে বিরিয়ানি খাওয়ায় পুলিশ। গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর জনি ‘ও মাগো, মা, মা...বাঁচাও’ বলে আর্তনাদ করেন। মামলার তদন্ত নিয়ে জনির বাবা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, পিবিআই-এর এক নারী এসআই তদন্ত করছেন। তিনি অনেক কিছু বলেন, তবে কাজে কিছুই পাচ্ছি না। অন্যতম আসামি আজিজের নম্বর দিলেও তাকে গ্রেফতার করছে না। সোমবার বিকালে খিলগাঁও জোড়াপুকুর খেলার মাঠে গিয়ে দেখা যায়, যে স্থানে পড়ে ছিল জনির লাশ, সেখানে দেওয়াল নির্মাণ করেছে সিটি করপোরেশন। ঘটনাস্থলের আশপাশে থাকা দোকানিরা জনি হত্যার কথা শুনেই চুপসে যান। এক চায়ের দোকানি জানান, জানিকে হত্যার রাতে প্রচণ্ড গুলির শব্দে পুরো এলাকা প্রকম্পিত হয়। ভোরে যখন লাশ নিয়ে যাওয়া হয়, তখন পুরো এলাকা পুলিশ ঘিরে রাখে।

কী ঘটেছিল সেদিন : ২০১৫ সালের ১৯ জানুয়ারি নুরুজ্জামান জনির সঙ্গে গ্রেফতার হয়েছিলেন তার বন্ধু ছাত্রদল নেতা মো. মইন হোসেন। তিনি বলেন, জনির ছোট ভাই হীরাকে কারাগারে দেখতে আমরা রিকশায় করে নাজিমউদ্দিন রোডের কেন্দ্রীয় কারাগারে পৌঁছাই বেলা ১২টায়। কিন্তু হীরার সঙ্গে দেখা করতে পারিনি আমরা। ১টার দিকে আমরা কারাগারের দ্বিতীয় তলা থেকে সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামতেই সিভিল পোশাকে ১০ থেকে ১২ জন আমাদের ঘিরে ফেলে। তারা বলেন, ‘আমরা ডিবির লোক। আপনাদের সঙ্গে ডিবির এসি স্যার কথা বলবেন।’ আমরা যেতে না চাইলে দুজনকেই চড়থাপ্পড় মেরে জেলখানা থেকে বের করে। পরে হাতকড়া পরিয়ে গাড়িতে তোলে। এরপরই চোখ বেঁধে ফেলে। পরে কোথায় নিয়েছে, তা তখন বুঝতে পারিনি। এক রুমে ৪ থেকে ৫ জনকে গাদাগাদি করে রাখে। আমাদের প্রচুর মারধর করে। পায়ের সঙ্গে রড বেঁধে হাত পেছনে নিয়ে বেঁধে নির্যাতন করে। এশার আজানের পর জনিকে অন্য রুমে নিয়ে যায়।

মইন বলেন, আমাকে মৎস্য ভবন এলাকায় পুলিশ মার্ডার মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে কারাগারে পাঠানো হয়। এ ঘটনায় আমি ও জনি কেউই জড়িত ছিলাম না। ওই মামলায় আট মাস জেল খেটেছি আমি। পরে অবশ্য নির্দোষ প্রমাণিত হয়েছি। তবে পুলিশের ভাষ্য ছিল, মৎস্য ভবন মোড়ে পুলিশের গাড়িতে পেট্রোল বোমা নিক্ষেপকারীদের অন্যতম সদস্য ছিল জনি। এছাড়া রাজনৈতিক সহিংসতার আরও কিছু ঘটনায় সে জড়িত বলেও পুলিশ উল্লেখ করে।

গত বছরের ২ সেপ্টেম্বর ডিএমপির খিলগাঁও থানায় মামলা করেন জনির বাবা মো. ইয়াকুব আলী। মামলায় পুলিশ কর্মকর্তা ও স্থানীয় আওয়ামী লীগের ৬২ জনের নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাত আরও ১৫ থেকে ২০ জনকে আসামি করা হয়। মামলাটি বর্তমানে তদন্ত করছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। আসামির তালিকায় আছেন-সাবেক ডিএমপি কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া, ডিবি দক্ষিণ জোনের তৎকালীন উপপুলিশ কমিশনার (ডিসি) কৃষ্ণপদ রায়, তৎকালীন এসআই দীপক কুমার দাস, এসি মো. জাহিদুল হক তালুকদার, ইনস্পেকটর ওহিদুজ্জামান, ইনস্পেকটর এসএম শাহরিয়ার হাসান, এসআই শিহাব উদ্দিন, এসআই বাহাউদ্দিন ফারুকী, এসআই মো. জাহাঙ্গির হোসেন, খিলগাঁও থানার সাবেক এসআই আলাউদ্দিনসহ আরও অজ্ঞাত পুলিশ সদস্যকে আসামি করা হয়। আরও আসামি করা হয় ঢাকা-৯ আসনের সাবেক সংসদ-সদস্য সাবের হোসেন চৌধুরী, তার পিএস আব্দুল মান্নান, খিলগাঁও থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি শরীফ আলী খান, ১নং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের কাউন্সিলর মাহবুব হোসেন মাহবুব, আওয়ামী লীগ নেতা আব্দুল আজিজ প্রমুখ।

মামলাটি বর্তমানে তদন্ত করছেন পিবিআই ঢাকা মেট্রো দক্ষিণের এসআই শাহনাজ। তিনি যুগান্তরকে বলেন, মামলাটি আমাদের কাছে এসেছে পাঁচ মাস আগে। যেহেতু বেশ আগের ঘটনা, ওইসময় কারা ছিল, কারা কী করেছিল, কে কোন পদে থেকে বিষয়গুলো পরিচালনা করেছে-এ বিষয়গুলো বের করার চেষ্টা করছি।

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম