সিনহা হত্যা মামলা
প্রদীপ-লিয়াকতের মৃত্যুদণ্ড বহাল
৬ জনের যাবজ্জীবন
যুগান্তর প্রতিবেদন
প্রকাশ: ০৩ জুন ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
মেজর (অব.) সিনহা মো. রাশেদ খান হত্যা মামলায় সাবেক ওসি প্রদীপ কুমার দাশ ও পরিদর্শক মো. লিয়াকত আলীর মৃত্যুদণ্ড বহাল রেখেছেন হাইকোর্ট। এ ছাড়া অপর ছয় আসামির যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বহাল রাখা হয়েছে। বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমান ও বিচারপতি মো. সগীর হোসেনের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ সোমবার এ রায় দেন। মামলায় বিচারিক আদালতের রায়ের পর আসামিদের ডেথ রেফারেন্স (মৃত্যুদণ্ড অনুমোদন) ও আপিলের ওপর শুনানি নিয়ে এ রায় দেওয়া হয়।
রায়ে, সিনহাকে হত্যায় সহযোগিতা এবং ঘটনা ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টার অভিযোগে টেকনাফ থানার এসআই নন্দদুলাল রক্ষিত, কনস্টেবল রুবেল শর্মা ও সাগর দেব এবং পুলিশের তিন ‘সোর্স’ মো. নুরুল আমিন, মোহাম্মদ আইয়াজ ও মো. নিজাম উদ্দিনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। রায়ে বলা হয়, আমরা নিম্ন আদালতে এ মামলার সব সাক্ষ্য প্রমাণ ও দলিলাদি এবং রায় পর্যালোচনা করেছি। পারিপার্শ্বিক স্বাক্ষ্য প্রমাণ পর্যালোচনা করে এ সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছি যে, এ মামলার ডেথ রেফারেন্স গ্রহণ করা হলো, আসামিদের আপিল ও জেল আপিল খারিজ করা হলো।
রায়ের সময় সিনহার বোন শারমিন শাহরিয়ার ফেরদৌস এবং কয়েকজন অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা আদালতে উপস্থিত ছিলেন। রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করে শারমিন শাহরিয়ার ফেরদৌস বলেন, সত্যের জয় হয়েছে। আমরা চাই দ্রুত এ রায় কার্যকর হবে। আসামিদের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী এসএম শাহজাহান ও সারওয়ার আহমেদ। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন অ্যাটর্নি জেনারেল এম আসাদুজ্জামান ও ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল জসিমউদ্দিন সরকার।
কোনো মামলায় বিচারিক আদালতের রায়ে আসামির মৃত্যুদণ্ড হলে তা কার্যকরে হাইকোর্টের অনুমোদন লাগে, যা ডেথ রেফারেন্স মামলা হিসাবে পরিচিত। অন্যদিকে বিচারিক আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে আসামিরা আপিল, জেল আপিল ও বিবিধ আবেদন করতে পারেন। ডেথ রেফারেন্স ও আপিলের ওপর সাধারণত একসঙ্গে শুনানি হয়ে থাকে। সিনহা হত্যা মামলায় বিচারিক আদালতের রায়ের পর এর নথিপত্র ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট শাখায় পৌঁছায়। যা একই বছর ডেথ রেফারেন্স মামলা হিসাবে নথিভুক্ত হয়। অন্যদিকে দণ্ডাদেশের বিরুদ্ধে ২০২২ সালে আসামিরা পৃথক আপিল ও জেল আপিল করেন। ডেথ রেফারেন্স মামলা শুনানির পূর্বপ্রস্তুতি হিসাবে পেপারবুক (মামলার বৃত্তান্ত) প্রস্তুত করতে হয়।
পেপারবুক প্রস্তুতসহ আনুষঙ্গিক প্রক্রিয়া শেষ হওয়ার পর প্রধান বিচারপতি এ মামলার ডেথ রেফারেন্স, আসামিদের আপিল-জেল আপিল শুনানি ও নিষ্পত্তির জন্য হাইকোর্টের দ্বৈত বেঞ্চ নির্ধারণ করে দেন। এদিকে প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদ ‘অগ্রাধিকার ভিত্তিতে’ এ মামলা নিষ্পত্তির সিদ্ধান্ত দিলে চলতি বছরের ২৩ এপ্রিল ডেথ রেফারেন্স ও আপিলের ওপর হাইকোর্টে শুনানি শুরু হয়। ২৯ মে শুনানি শেষে আদালত রায়ের জন্য ২ জুন দিন ঠিক করে দেন।
২০২০ সালের ৩১ জুলাই রাতে কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিন ড্রাইভের শামলাপুর চেকপোস্টে গুলি করে হত্যা করা হয় সিনহা মো. রাশেদ খানকে। মহামারির মধ্যে ওই ঘটনা সারা দেশে আলোড়ন সৃষ্টি করে। আইনি বাহিনীর বৈধ অস্ত্রের অবৈধ ব্যবহার করে সিনহাকে হত্যার ঘটনা সমালোচনার ঝড় ওঠে। সিনহা ছিলেন সেনাবাহিনীর একজন অবসরপ্রাপ্ত মেজর, যিনি স্বেচ্ছায় অবসর নেওয়ার পর কয়েকজন তরুণকে সঙ্গে নিয়ে ভ্রমণবিষয়ক তথ্যচিত্র বানানোর জন্য কক্সবাজারে গিয়েছিলেন।
ওই ঘটনায় সিনহার বোন মামলা করার পর ১২ পুলিশসহ ১৫ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেন র্যাবের জ্যেষ্ঠ সহকারী পুলিশ সুপার খাইরুল ইসলাম। একজন আইনের লোক হয়েও ওসি প্রদীপ কীভাবে মাদকবিরোধী অভিযানের নামে বন্দুকযুদ্ধ সাজিয়ে খুন করে যাচ্ছিলেন টাকার জন্য, তা উঠে আসে তার তদন্তে। সেখানে বলা হয়, তথ্যচিত্র নির্মাণে কক্সবাজারে গিয়ে সিনহা ও তার সঙ্গীরা টেকনাফের নিরীহ মানুষের ওর ওসি প্রদীপের ‘অবর্ণনীয় নির্যাতন-নিপীড়নের কাহিনি’ জেনে গিয়েছিলেন। এরপর বিপদ আঁচ করতে পেরে প্রদীপের পরিকল্পনায় সিনহাকে হত্যা করা হয়। প্রদীপের নির্দেশে সিনহাকে গুলি করেন লিয়াকত। বাকিরা তাদের সহযোগিতা করেন।
২০২১ সালের ২৭ জুন ওই ১৫ আসামির বিচার শুরুর আদেশ দিয়েছিলেন কক্সবাজারের জেলা ও দায়রা জজ মোহাম্মদ ইসমাইল। সাত মাস পর ২০২২ সালের ৩১ জানুয়ারি তিনি রায় ঘোষণা করেন। সেখানে ওসি প্রদীপ ও পরিদর্শক লিয়াকতকে মৃত্যুদণ্ড এবং তিন পুলিশসহ ছয়জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন তিনি। মামলার ১৫ আসামির মধ্যে বাকি চার পুলিশ সদস্য এবং তিন এপিবিএন সদস্যকে বেকসুর খালাস দেন জজ আদালত। পরে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করতে ডেথ রেফারেন্স হাইকোর্টে আসে। কারাগারে থাকা দণ্ডিত আসামিরা আপিল করেন।
রায়ের পর ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল জসীম সরকার বলেন, ‘ডেথ রেফারেন্স মঞ্জুর ও আসামিদের আপিল খারিজ করে রায় দিয়েছেন হাইকোর্ট। প্রদীপসহ দুই আসামির মৃত্যুদণ্ড ও অপর ছয় আসামির যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বহাল রেখেছেন আদালত। প্রদীপের পক্ষে শুনানিতে থাকা জ্যেষ্ঠ আইনজীবী মনসুরুল হক চৌধুরী বলেন, ‘হাইকোর্টের রায়ের প্রত্যয়িত অনুলিপি গ্রহণের ৩০ দিনের মধ্যে আপিল করার সুযোগ আছে। উনি (প্রদীপ) চাইলে আপিল করতে পারেন।
