Logo
Logo
×

শেষ পাতা

শেরপুর ও নেত্রকোনার সশস্ত্র বিদ্রোহ

ব্রিটিশবিরোধী সংগ্রামের নায়ক পাগল টিপু শাহ

Icon

মো. আবদুর রহিম বাদল, শেরপুর

প্রকাশ: ০৩ জুন ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

ব্রিটিশবিরোধী সংগ্রামের নায়ক পাগল টিপু শাহ

পাগল টিপু শাহের দরবার শরীফ, শেরপুর। ছবি: যুগান্তর

পাগল টিপু শাহ। শেরপুর ও নেত্রকোনা অঞ্চলে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের রূপকার। তিনি ছিলেন পাগলপন্থি আন্দোলনের নেতা। বাবা করিম শাহের মৃত্যুর পর ১৮১৩ সালে তিনি এ আন্দোলনের নেতৃত্বে আসেন। তার অধীনে এ আন্দোলন সরাসরি স্থানীয় জমিদার এবং পরোক্ষভাবে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বিরুদ্ধে কৃষকবিদ্রোহে রূপ নেয়।

টিপুর তেজোদীপ্ত প্রবল বিদ্রোহে ১৮২৪ ও ১৮২৫ সালে কেঁপে উঠেছিল ইংরেজ শাসনের ভিত। তিনি জনগণের মাঝে প্রচার করেছিলেন বাবার সাম্যবাদী মন্ত্র-‘সব মানুষ ভাই ভাই, মানুষে মানুষে কোনো ভেদাভেদ নাই।’ এই মন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে অসংখ্য নিপীড়িত-নির্যাতিত কৃষক দলে দলে এ আদর্শের পতাকাতলে সমবেত হয়েছিল। তাদের সংগঠিত করে টিপু শাহ শেরপুর পরগণা ও উত্তর ময়মনসিংহের সুসং পরগণায় পরিচালনা করেছিলেন ঐতিহাসিক কৃষকবিদ্রোহ আন্দোলন। ইতিহাসে এ আন্দোলন পাগলপন্থি আন্দোলন নামে পরিচিত।

টিপু শেরপুর অঞ্চলে ১৮২৫ সালে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন স্বাধীন প্রশাসনিকব্যবস্থা। তিনি শেরপুর ও সুসং পরগণাকে দুবছরে বেশি স্বাধীন করে রেখেছিলেন। ভারতের স্বাধীনতাসংগ্রামের ইতিহাসে টিপুর এ বিদ্রোহের গুরুত্ব অপরিসীম। তার ক্ষুদ্র প্রয়াস দিয়েই এ দেশের মানুষকে স্বাধীনতার মন্ত্রে উজ্জীবিত করে গেছেন। তার এ বীরত্বের জন্য তিনি ইতিহাসে চির অমর হয়ে আছেন।

অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষভাগে নেত্রকোনার পূর্বধলা উপজেলার কংশ নদীর তীরবর্তী লেটিরকান্দা গ্রামে টিপু শাহের জন্ম। শেরপুরের নালিতাবাড়ী থেকে ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে প্রকাশিত শিল্প, সাহিত্য ও মনন চিন্তার কাগজ বালুচরে মাহমুদ আব্দুল্লাহর ‘গারো পাহাড়ের সমতলে কৃষক আন্দোলন : হালুয়াঘাটের সংগ্রামী ঐতিহ্য’ শীর্ষক নিবন্ধে বলা হয়েছে, ঊনবিংশ শতাব্দীর শুরুতে শেরপুর পরগনায় পাগলপন্থি আন্দোলন শুরু হয়। টিপুর নেতৃত্বেই ইংরেজ দুঃশাসনের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হয়ে বিদ্রোহে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল সীমান্তবর্তী অঞ্চলের কৃষকসমাজ। ‘পাগলপন্থি’ ধারণার জন্ম দিয়েছিলেন তার বাবা করিম শাহ। করিম শাহ ছিলেন সুফিসাধক ও টিপুর দীক্ষাগুরু।

জানা যায়, ১৮২০ সালে শেরপুরের জমিদারি ভাগবাঁটোয়ারা হয়, জমিদাররা পরস্পরের বিরুদ্ধে মামলায় জড়িয়ে পড়েন। নিয়মিত খাজনা দিতে অক্ষম প্রজাদের ওপর বর্তায় মামলার খরচও। এ সময় বিপন্ন প্রজারা টিপুর শরণাপন্ন হন। পরে লেটিরকান্দা গ্রামে এক সভার আয়োজন করা হয়। ১৮২৪ সালের ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে অনুষ্ঠিত ওই সভায় টিপুর সহস্রাধিক ভক্ত যোগ দেন। বিশাল গণজমায়েতে প্রজারা টিপুকে শেরপুরের জমিদারির ন্যায্য উত্তরাধিকার এবং তাকেই নিজেদের ‘স্বাধীন সুলতান’ ঘোষণা করেন। এরপর পাগলপন্থিরা টিপুর নেতৃত্বে বিদ্রোহ ঘোষণা করে। একসময় শেরপুর অঞ্চল দখল করে নেয়। প্রচীন দুর্গ গড়জরিপাকেন্দ্রিক স্বশাসন ও বিচারব্যবস্থা চালু করেন টিপু। এ সময় স্থানীয় জমিদাররা শেরপুর থেকে পালিয়ে যান।

বাংলাদেশ ইসলামিক ফাউন্ডেশন থেকে ১৯৮৬ সালে প্রকাশিত একেএম মহিউদ্দিনের লেখা ‘পাগলা টিপু’ গ্রন্থে উল্লেখ করা হয়েছে, ১৮২৫ সালে ইংরেজ আর জমিদারদের বিরাট ফৌজ আক্রমণ করে টিপুর মুজাহিদ বাহিনীকে। শেরপুরের কাছে মুখোমুখি হয় দুই সেনাদল। কিন্তু টিপুর কাছে তারা পরাজিত হয়। জমিদাররা তাদের একটি সৈন্যও ফেরত নিয়ে যেতে পারেননি যুদ্ধক্ষেত্র থেকে।

ইংরেজরা যুদ্ধ করে টিপুকে কাবু করতে না পেরে বেছে নেয় চক্রান্তের পথ। নানারকম লোভ দেখিয়ে জমিদার নর নারায়ণ রায় ও টিপুর সেনাপতি জানকুগিরিকে হাত করে ইংরেজ সেনানায়ক মেজর ডেমপিয়ার। তারাই কৌশলে টিপুকে ডেমপিয়ারের হাতে ধরিয়ে দেয়। এ সময় ডেমপিয়ার মুখে মৃদু হাসি হেসে বলেছিলেন, ‘টিপু তুমি বীর। আমি বীরকে সম্মান করি। আমি একজন ইংরেজ, তোমার দুশমন। তবুও তোমার সঙ্গে কোনো বেইমানি আমি করিনি। তোমার দেশের লোকই তোমার সঙ্গে বেইমানি করল। তুমি আমার বন্দি, চলো আমার সঙ্গে।’

বীর মুক্তিযোদ্ধা প্রবীণ আইনজীবী ফকির আখতারুজ্জামান বলেন, খাজনা আদায়সহ নানা কারণে নিরীহ কৃষক প্রজাদের ওপর ইংরেজ ও জমিদারদের অত্যাচার-নিপীড়নের বিরুদ্ধে পাগল টিপু তার অনুসারীদের নিয়ে বিদ্রোহ করেছিলেন। এদেশের মানুষকে শাসকের জুলুম-অত্যাচার থেকে বাঁচাতে এবং স্বাধীনতার জন্য বছরের পর বছর আন্দোলন-সংগ্রাম করেছেন। ওই সময়ে গেরিলাযুদ্ধের মতো ছিল এ লড়াই। টিপু তার বাহিনীকে এ যুদ্ধেও প্রশিক্ষিত করে তুলেছিলেন।

শেরপুরের প্রবীণ শিক্ষাবিদ ও গবেষক বীর মুক্তিযোদ্ধা ড. সুধাময় দাস বলেন, আমাদের ইতিহাসে অমর নায়ক হয়ে আছেন টিপু শাহ। গণমানুষের সংগ্রামে তিনি যে ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেছেন, তা ইতিহাসের অংশ। মানুষ শোষণমুক্তির সংগ্রামে তাকে সব সময় স্মরণ করবে এবং অনুপ্রাণিত হবে।

পাগল টিপু শাহের অষ্টম বংশধর সুলতান গাজী শাহজাহান শাহ প্রিন্স বলেন, অনেক ইতিহাসবেত্তা জেলখানায় টিপু শাহের মৃত্যু হয়েছে উল্লেখ করলেও প্রকৃতপক্ষে তার মৃত্যু হয়েছে নেত্রকোনার লেটিরকান্দার নিজ বাড়িতে।

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম