Logo
Logo
×

শেষ পাতা

বিএনপির আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া

বাজেটে রাজনৈতিক দল ও জনগণের মত নেই

ক্ষমতায় গেলে প্রথম ১৮০ দিনের পরিকল্পনার সারসংক্ষেপ উপস্থাপন করেন আমির খসরু

Icon

যুগান্তর প্রতিবেদন

প্রকাশ: ০৫ জুন ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

বাজেটে রাজনৈতিক দল ও জনগণের মত নেই

রাজনৈতিক দল ও সমাজের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের মতামত ছাড়াই অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট প্রণয়ন করেছে বলে অভিযোগ করেছে বিএনপি। বুধবার প্রস্তাবিত বাজেটের ওপর দলটির আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়ায় স্থায়ী কমিটির সদস্য আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, বিএনপি সর্বক্ষেত্রে সরকারকে সহযোগিতা করছে। প্রত্যাশা করেছিলাম সরকার আন্দোলনকারী রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে ন্যূনতম জাতীয় ঐকমত্য স্থাপনের মাধ্যমে বাজেট প্রণয়ন করবে। সমাজের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের মতামত নিতে পারত। পাশাপাশি বিশেষজ্ঞ, নাগরিক সমাজ, ব্যবসায়ী, তরুণ প্রতিনিধিরাও অংশ নিতে পারতেন। তাহলে বাজেট একটি সমন্বিত অর্থনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রতীক হতো। দেশের বিভিন্ন কণ্ঠের প্রতিচ্ছবি হয়ে উঠতে পারত এ বাজেট। কিন্তু সেই সুযোগটি কাজে লাগানো হয়নি। বাজেট প্রণয়ন একমুখী, অংশগ্রহণহীন ও গতানুগতিক ধারার হতো। নতুন চিন্তার প্রতিফলন ঘটত।

রাজধানীর গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে এই সংবাদ সম্মেলন হয়। এতে প্রস্তাবিত বাজেটের ওপর আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়ার পাশাপাশি বিএনপি ক্ষমতায় গেলে কেমন বাজেট করবে এবং কোন কোন খাতকে অগ্রাধিকার দেবে তারও একটি কর্মপরিকল্পনা তুলে ধরেন আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী। জানানো হয়, ক্ষমতায় গেলে প্রথম ১৮০ দিনের পরিকল্পনার সারসংক্ষেপ।

আমির খসরু বলেন, বাজেটের প্রধান লক্ষ্য হওয়া উচিত ছিল বেসরকারি বিনিয়োগ বৃদ্ধির পথনকশা উপস্থাপন। অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারে শিল্পকারখানা স্থাপন, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও কৃষিতে অগ্রাধিকার দেওয়ার দরকার ছিল। জরুরি ছিল ক্ষুদ্র, কুটির ও মাঝারি বিভিন্ন খাতে সহায়তার মাধ্যমে আরও নতুন উদ্যোক্তা সৃষ্টির। বিশাল সুদের হারের সঙ্গে অতিরিক্ত কর ও শুল্ক শিল্পে বড় চাপ সৃষ্টি করবে। বিশেষ করে উৎপাদনশীল খাতগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হবে, অনেক প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যেতে পারে, কর্মসংস্থানও কমতে পারে। মধ্যম ও নিম্নবিত্ত শ্রেণির ওপর আর্থিক চাপ বাড়লে অর্থনৈতিক অস্থিরতা বাড়তে পারে। দারিদ্র্য বিমোচনের অগ্রগতিও থমকে যেতে পারে।

তিনি বলেন, আর্থিক খাতের ভঙ্গুরতাও কাটেনি। পুঁজিবাজারে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা অবহেলিতই থেকে গেলেন। ব্যাংকের আর্থিক অবস্থা নাজুক। খেলাপি ঋণ আদায়, পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনা এবং করজাল সম্প্রসারণের মতো পদক্ষেপ নিলে রাজস্ব আহরণে নতুন ভিত্তি তৈরি হতো। সরকার ব্যাংক খাতের ওপর বেশি নির্ভরশীল। ‘ঋণ করে ঋণ শোধ’ দীর্ঘমেয়াদে আর্থিক স্থিতিশীলতার জন্য হুমকি। কালোটাকা সাদা করার সুযোগ কর ফাঁকি প্রদানকারীদের পুরস্কৃত করছে। নিয়মিত করদাতাদের প্রতি এটি অবিচার।

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজ ও স্কুলগুলোকে করের আওতায় আনা, অনলাইন ব্যবসার ওপর শুল্ক বৃদ্ধি, পুঁজিবাজারে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের জন্য কোনো কিছু না করা, অপ্রয়োজনীয়, দুর্নীতিগ্রস্ত ও অদক্ষ উন্নয়ন প্রকল্প বন্ধ না করাসহ বিভিন্ন খাতে বাজেটের প্রস্তাবনার সমালোচনা করেন আমির খসরু। বিএনপি ভবিষ্যতে ক্ষমতায় গেলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে পূর্ণাঙ্গ কর মওকুফের আওতায় আনা হবে বলে জানান তিনি।

কালোটাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়ারও সমালোচনা করে বিএনপির স্থায়ী কমিটির এই সদস্য বলেন, কালোটাকা সাদা করার সুযোগ কর ফাঁকি প্রদানকারীদের পুরস্কৃত করছে। নিয়মিত করদাতাদের প্রতি এটি অবিচার। করব্যবস্থার প্রতি আস্থা কমতে পারে। কর ফাঁকি ও জালিয়াতি রোধ এবং করজাল সম্প্রসারণ না করে ভ্যাট বৃদ্ধির মাধ্যমে বরাবরের মতো করের বোঝা সাধারণ জনগণের কাঁধে চাপানো হয়েছে। পণ্যের দাম ঊর্ধ্বমুখী হয়েছে। জীবনযাত্রার মান কমছে।

আমির খসরু বলেন, বর্তমানে মূল্যস্ফীতি প্রায় ‘ডবল ডিজিট’। তা কমিয়ে ৬ দশমিক ৫ শতাংশ করার কথা বলা হচ্ছে, যা বাস্তবসম্মত মনে হয় না। দারিদ্র্য বৃদ্ধির হারে লাগাম টানা যেত। বিশ্বব্যাংকের তথ্য বলছে, অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে ২৭ লাখের বেশি মানুষ আগের চেয়ে বেশি দরিদ্র হয়ে পড়েছে। বিশ্বব্যাংকের তথ্য বলছে, অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে ২৭ লাখের বেশি মানুষ আগের চেয়ে বেশি দরিদ্র হয়ে পড়েছে। এর মধ্যে ১৮ লাখ নারী। মজুরি বৃদ্ধির হার মূল্যস্ফীতির নিচে থাকায় প্রকৃত আয় কমেছে। দারিদ্র্য বৃদ্ধির পাশাপাশি ভোক্তা ব্যয়ের ওপরও চাপ সৃষ্টি করেছে। দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ স্থবির হওয়ায় আনুষ্ঠানিক-অনানুষ্ঠানিক প্রায় সব খাতেই কর্মসংস্থান কমেছে। ফলে সমাজে ভাঙন ধরেছে; দরিদ্র জনগোষ্ঠীর সংখ্যা বাড়ছে।

তিনি বলেন, বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাব মতে, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ছিল ৩ দশমিক ৯৭ শতাংশ। সেটা এবারের বাজেটে ধরা হয়েছে ৫ দশমিক ৬ শতাংশ, যা আগের সরকারের মতোই অবান্তর ও কাগুজে প্রবৃদ্ধি। খাদ্যনিরাপত্তা হুমকির মুখে। অপর্যাপ্ত, ত্রুটিপূর্ণ, দুর্নীতিগ্রস্ত সামাজিক সুরক্ষা খাতে পেনশন ও কৃষি ভর্তুকি অন্তর্ভুক্ত করে বরাদ্দ বাড়ানোর চেষ্টা হিসাবে দেখানো হয়েছে। কিন্তু সামাজিক সুরক্ষার জন্য সরকারি বরাদ্দ অপর্যাপ্ত থেকে যাচ্ছে। আজ অবধি সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনী কর্মসূচিগুলো অধিকারভিত্তিক হলো না।

ক্ষমতায় গেলে প্রথম ১৮০ দিনের পরিকল্পনা : আগামীতে ক্ষমতায় গেলে প্রথম ১৮০ দিনের অর্থনৈতিক কর্মপরিকল্পনা কী হবে তা ঘোষণা করে বিএনপি। বলা হয়, এই ছয় মাসের পরিকল্পনার ভিত্তিতে একটি অ্যাকশন-ওরিয়েন্টেড রোডম্যাপ প্রণয়ন করা হবে। বিভিন্ন খাতে বিএনপি কী কী পদক্ষেপ নেবে, সেগুলোও ওই রোডম্যাপে স্পষ্টভাবে তুলে করা হবে।

আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী দলের পক্ষ থেকে এর সারসংক্ষেপ উপস্থাপন করেন। তিনি বলেন, বিশ্বের অনেক দেশে রাজনৈতিক দল নির্বাচিত হওয়ার পর প্রথম ১০০ দিনে কী কী কাজ করবে, তার পরিকল্পনা প্রকাশ করে থাকে। জনগণের ক্ষমতায়নের দল হিসাবে বিএনপি বাংলাদেশে এমন একটি বাস্তবসম্মত সংস্কৃতি প্রবর্তন করতে চায়। জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়ে সরকার গঠনের পর প্রথম ১৮০ দিনের মধ্যে আমাদের লক্ষ্য ও পরিকল্পনা নির্বাচনের আগেই নির্ধারণ করা হবে।

সংবাদ সম্মেলনে শিক্ষাব্যবস্থা, স্বাস্থ্যসেবা, নারীর ক্ষমতায়ন, শহীদদের স্বীকৃতি, কৃষি খাত ও গ্রামীণ উন্নয়ন, শিল্প খাত, তথ্যপ্রযুক্তি খাত, প্রবাসী কল্যাণ, নগর ব্যবস্থাপনা, পরিবেশ ব্যবস্থাপনা ও আইনশৃঙ্খলা-এসব সেক্টরে ১৮০ দিনের পরিকল্পনার সারসংক্ষেপ তুলে ধরা হয়। একই সঙ্গে কর্মসংস্থানমুখী অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার, বেসরকারি খাতের প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিতকরণ, অবকাঠামো ও শিল্প অঞ্চলে বিনিয়োগ, বহুমুখীকরণ, উৎপাদনশীলতা ও উদ্ভাবন, ব্যাংকিং খাতকে ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগের জন্য সহজীকরণ, আর্থিক পণ্যের বহুমুখীকরণ, জ্বালানি ও বিদ্যুৎ কৌশল প্রণয়ন, নীল অর্থনীতি, সৃজনশীল শিল্প অর্থনীতি, বাণিজ্য সহজীকরণ ও শুল্ক পদ্ধতি উন্নয়নে দলটির কর্মপরিকল্পনা জানানো হয়। বিএনপির ১৮০ দিনের পরিকল্পনায় আরও রয়েছে পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ (পিপিপি) শক্তিশালীকরণ, জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা ও সবুজ প্রবৃদ্ধি, ঋণ ব্যবস্থাপনা ও রাজস্ব আহরণ বৃদ্ধি, ঋণ ব্যবস্থাপনা কৌশল, ব্যয় অগ্রাধিকরণ ও দক্ষতা বৃদ্ধির কৌশল, স্বল্পমেয়াদি ঋণের ওপর নির্ভরতা হ্রাস. ঋণ-উন্নয়ন-বিনিময়, অবৈধ ঋণ পর্যালোচনা ও বাতিলকরণ প্রক্রিয়া, রাজস্ব ব্যবস্থার যুগোপযোগীকরণ, প্রযুক্তিনির্ভর নজরদারি ব্যবস্থা, সবুজ কর কাঠামো, বাজেট প্রক্রিয়ার সংস্কারে কী করবে তার সারসংক্ষেপ।

সংবাদ সম্মেলনে আরও উপস্থিত ছিলেন-বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, সেলিমা রহমান, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ইসমাইল জবিহউল্লাহ ও অর্থনৈতিকবিষয়ক সম্পাদক ইঞ্জিনিয়ার খালেদ হোসেন মাহবুব শ্যামল।

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম