ঈশা খাঁর শৌর্যবীর্যের স্মারক ‘এগারসিন্দুর জলদুর্গ’
এটিএম নিজাম, কিশোরগঞ্জ
প্রকাশ: ১৩ জুন ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
কিশোরগঞ্জের পাকুন্দিয়ায় ‘এগারসিন্দুর জলদুর্গের’কামান দাগানোর উঁচু ঢিবি। ছবি: সংগৃহীত
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
‘এগারসিন্ধুর জলদুর্গ’ মধ্যযুগীয় একটি দুর্গ। এটি মসনদে আলা ঈসা খাঁর শৌর্যবীর্যের স্মারক। এই দুর্গে মোগল বাহিনীকে বারবার নাস্তানাবুদ করেছিলেন ঈশা খাঁ। এটি কিশোরগঞ্জ জেলার পাকুন্দিয়া উপজেলার এগারসিন্ধুর গ্রামে অবস্থিত। ‘এগারসিন্ধু’ শব্দটি এখানে ‘এগারোটি নদী’ অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। ধারণা করা হয়, এক সময় এখানে এগারোটি নদীর মোহনা ছিল।
জানা যায়, এখানে মোগল নৌবাহিনীর সঙ্গে ঈশা খাঁ বহু যুদ্ধে মুখোমুখি হয়েছিলেন। এসব যুদ্ধে মোগল সেনাপতি মানসিংহের দুই সন্তান নিহত হন। নিহত হন ঈশা খাঁর ছেলে মাসুম খাঁনও। শেষ পর্যন্ত ক্ষিপ্ত ও উন্মত্ত মানসিংহ নিজেই যুদ্ধে অবতীর্ণ হন। কিন্তু বিচক্ষণ বীর ঈশা খাঁ তাকে সরাসরি যুদ্ধের আমন্ত্রণ জানান। মানসিংহও প্রচুর রক্তক্ষয় এড়াতে ঈশা খাঁর সঙ্গে মুখোমুখি তলোয়ার যুদ্ধে অবতীর্ণ হন। সে যুদ্ধে মানসিংহের তলোয়ার দ্বিখণ্ডিত হয়ে পড়ে। অসহায় হয়ে পড়েন মানসিংহ। কিন্তু মহানুভব বীর ঈশা খাঁ নিজের তলোয়ার মানসিংহের দিকে এগিয়ে দিয়ে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানান। ঈশা খাঁর এমন মহানুভবতায় অভিভূত হয়ে মানসিংহ যুদ্ধের ইতি টানেন। বারো ভূঁইয়াদের নেতা ঈসা খাঁকে সসম্মানে দিল্লির দরবারে নিয়ে যান। এমন বীরত্ব আর মহত্ত্ব গাথা শুনে দিল্লির সম্রাট আকবর তাকে ভাটি বাংলার বিস্তীর্ণ অঞ্চলের জায়গিরদারি প্রদান করেন।
ইতিহাস থেকে জানা যায়, ঈসা খাঁ মোগলদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে এই দুর্ভেদ্য ‘এগারসিন্ধুর জলদুর্গ’ ব্যবহার করেছিলেন। বর্তমানে এই দুর্গের অস্তিত্ব নেই। এগারসিন্ধুর দুর্গের পাশে রয়েছে বেবুথ রাজার দিঘি, সাদী মসজিদ ও শাহ মাহমুদ মসজিদ। দুর্গটি ঈশা খাঁর শক্ত ঘাঁটি ছিল। দুর্গে প্রায় ৬০ ফুট চওড়া মাটির দেওয়াল ছিল। এর তিন দিক নদী দিয়ে ঘেরা এবং একদিকে পরিখা খনন করে প্রতিরক্ষার ব্যবস্থা ছিল। ঐতিহাসিক জলদুর্গের ধ্বংসাবশেষ এবং এর আশপাশের মোগল আমলের নান্দনিক স্থাপত্যশৈলীর মসজিদ দেখতে আজও দেশ-বিদেশের পুরাকীর্তি প্রেমিকরা এখানে ভিড় করেন।
ঈশা খাঁর বীরত্ব আর কৌশলের নানা গল্প, ইতিহাস ও লোকগাথায় বর্ণিত আছে। ঢাকার অদূরে সোনারগাঁয়ে ছিল তার রাজধানী। পরাক্রমশালী এই ভূঁইয়া বা ভূস্বামী বা জমিদারের জীবন ছিল বৈচিত্র্যে ভরা। কিশোরগঞ্জের করিমগঞ্জ উপজেলার জঙ্গল বাড়িতে ছিল তার দ্বিতীয় রাজধানী।
‘বারো ভূঁইয়া বা ষোড়শ শতাব্দীর বাঙ্গালার ইতিহাস’ বইতে আনন্দনাথ রায় ঈশা খাঁ প্রসঙ্গে লিখেছেন, ‘তাহার কমনীয় দেহ যেরূপ একদিকে বীরত্বব্যঞ্জক ও স্বাধীনতা প্রয়াসী ছিল, অপরদিকে সেইরূপ কপটতা, মিত্রদ্রোহিতা, স্বার্থপরতা প্রভৃতি তার অস্থিমজ্জার সাথে জড়িয়ে পড়েছিল। ঈশা খাঁ যে একজন প্রকৃত যোদ্ধা ও স্বদেশ প্রাণ ছিলেন, এ বিষয়ে সন্দেহ নাই।’
তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, অহোম রাজা ১৭ শতাব্দীতে এগারসিন্ধুর জলদুর্গটি দখল করে নেন। পরে সুবেদার ইসলাম খান তাদের পরাজিত করেন। তিনি দুর্গটি ধ্বংস করে দিয়েছিলেন। পরে ১৮৯৭ সালের ভূমিকম্পে দুর্গের বাকি অংশও ধ্বংস হয়ে যায়। তবে দুর্গের ভেতরে উঁচু একটি ঢিবি পাওয়া যায়, যেখান থেকে প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে কামান দাগানো হতো। এসব প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর সংরক্ষণ করছে।
২০২২ সালে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর এই দুর্গে খনন কার্যক্রম চালায়। এই খননে পাওয়া গেছে, প্রায় আড়াইশ পিস প্রাচীন তৈজসপত্রের নিদর্শন ও স্থাপত্য কাঠামোর ধ্বংসাবশেষ। উদ্ধার করা প্রত্নবস্তুগুলোর মধ্যে রয়েছে জীবাশ্ম, প্রস্তরখণ্ড, পোড়ামাটির হাঁড়ি-পাতিল, ঘটিবাটি, থালা, পিরিচ, মাটির কলসের ভাঙা অংশ, তৈলপ্রদীপ, প্রদীপদানি, অলংকৃত ইট, ব্রেসলেট, হাতের বালা, সিরামিক, পোড়ামাটির বল ইত্যাদি।
‘বৌলাইবাড়ির ৪০০ বছর’র (বৌলাই জমিদার বাড়ি) লেখক ও বিশিষ্ট গবেষক ড. হালিম দাদখান বলেন, এগারসিন্ধুর জলদুর্গের ঐতিহাসিক গুরুত্ব বিবেচনায় এটিকে রক্ষায় এবং বর্তমান প্রজন্মের সামনে উপস্থাপনের মতো কোনো কর্মকাণ্ড আজও দৃশ্যমান হয়নি। প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর শুধু সেখানে সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে রেখে মাঝেমধ্যে খোঁড়াখুঁড়ির মাধ্যমে তাদের কাজ সীমাবদ্ধ রেখেছে। অথচ বীর ঈসা খাঁর শৌর্যবীর্যের স্মারক এ দুর্গটির অবয়ব তৈরির কোনো প্রচেষ্টা নেই। মানসিংহের বিরুদ্ধে ঈশা খাঁর বীরত্বগাথা আমাদের নতুন প্রজন্মকে জানানোর উদ্যোগ যেমন নেই, দুর্গের একটি কাঠামো তৈরির কাজের মাধ্যমে এবং পুঁথি-পুস্তকের পাঠ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্তির প্রচেষ্টাও নেই। এই গবেষক মনে করেন, ঈশা খাঁর রণাঙ্গনের বীরত্বগাথার সঙ্গে আমাদের সব আন্দোলন-সংগ্রাম এমনকি মহান মুক্তিযুদ্ধেরও একটি সম্পর্ক রয়েছে।
