Logo
Logo
×

শেষ পাতা

জড়িয়ে পড়েছেন নানা অপকর্মে

ফের প্রকাশ্যে চট্টগ্রামের শীর্ষ সন্ত্রাসী মোরশেদ

মাদক স্পটের নিয়ন্ত্রণ নিতে গিয়ে কিশোর গ্যাংয়ের হামলার শিকার

Icon

চট্টগ্রাম ব্যুরো

প্রকাশ: ১৩ জুন ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

ফের প্রকাশ্যে চট্টগ্রামের শীর্ষ সন্ত্রাসী মোরশেদ

ফাইল ছবি

চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের তালিকাভুক্ত এক সময়ের শীর্ষ সন্ত্রাসী বাকলিয়ার ত্রাস হিসাবে পরিচিত মোরশেদ খান ২০ বছর পর প্রকাশ্যে এসেছেন। এলাকায় ফিরেই তিনি আবারও জড়িয়ে পড়েছেন সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি ও মাদক ব্যবসায়। সর্বশেষ ৮ জুন একটি মাদক স্পটের নিয়ন্ত্রণ নিতে গিয়ে কিশোর গ্যাংয়ের হামলার শিকার হয়েছেন। কয়েকজন সহযোগীসহ আহত হওয়ার পর মোরশেদ খান এলাকায় ফেরার খবরটি চাউর হয়েছে। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে নগরীর দক্ষিণ বাকলিয়ায় সন্ত্রাসী দুই গ্রুপের মধ্যে উত্তেজনা তৈরি হয়েছে। পাশাপাশি আতঙ্ক বিরাজ করছে সাধারণ ব্যবসায়ী ও এলাকাবাসীর মধ্যে।

জানা গেছে, মোরশেদ খানের বাবার নাম মৃত মহসিন খান। নগরীর ১৯ নম্বর দক্ষিণ বাকলিয়া ওয়ার্ডে তাদের বাড়ি। মাধ্যমিকের গণ্ডি পেরোতে না পারলেও বাকলিয়া ছাত্রদলের আহ্বায়ক হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯২ সালে বাকলিয়া ছাত্রলীগ নেতা আছু হত্যাকাণ্ডে প্রথম তার নাম আসে। সরাসরি এই হত্যাকাণ্ডে অংশ নেওয়ার ঘটনায় তার বিরুদ্ধে মামলা হয়। এতে তার যাবজ্জীবন সাজাও হয়। কেবল এই মামলাই নয়; দক্ষিণ বাকলিয়ার রুবেল সেন হত্যা, শমসের আলী হত্যা মামলাও ছিল তার বিরুদ্ধে। সন্ত্রাস দমনে করা একটি মামলায় ৫ বছর, জননিরাপত্তা আইনের মামলায় ১৫ বছরসহ বিভিন্ন মামলায় তার সাজা হয়। ছাত্রদল ও বিএনপির রাজনীতি করে বিএনপি সরকারের সময়েই সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, অপহরণসহ বেপরোয়া অপকর্মের কারণে একাধিকবার জেল খাটেন মোরশেদ খান। সর্বশেষ ২০০৩ সালে অপারেশন ক্লিনহার্টের সময় যৌথ বাহিনীর হাতে গ্রেফতার হয়ে এক বছরের মতো জেল খাটেন। জেল থেকে বের হয়ে আবারও অপকর্ম করার কারণে তাকে গ্রেফতারে অভিযান চালায় র‌্যাব। ২০০৪ সালের শেষের দিকে বাকলিয়ায় র‌্যাবের অভিযানের সময় পানাভর্তি পুকুরে ডুব দিয়ে গ্রেফতার এড়ান। ছাত্রদল ক্যাডার ইকবাল ওরফে পাথরঘাটা ইকবাল, ছাত্রলীগ ক্যাডার মহিম উদ্দিন, শিবির ক্যাডার হুমায়ুনসহ শীর্ষ একাধিক সন্ত্রাসী র‌্যাবের ক্রসফায়ারে নিহত হওয়ার পর ভয়ে মোরশেদ খান শহর ছেড়ে আত্মগোপনে চলে যান। সেই থেকে গত ২০ বছরেরও বেশি সময় ধরে আর তার দেখা মেলেনি এলাকায়।

১৯৯৬ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় থাকাকালে এই এলাকায় মোরশেদ খানের আধিপত্য খর্ব হয়। আওয়ামী লীগ ক্যাডার শহীদুল্লাহ অপরাধ জগতের নিয়ন্ত্রণ নেন। তিনি এই সময়ে দক্ষিণ বাকলিয়া ওয়ার্ডের কাউন্সিলরও নির্বাচিত হন। তখন শহীদুল্লাহ গ্রুপের সঙ্গে মোরশেদ খানের সংঘাত-সংঘর্ষ লেগেই থাকত। চাঁদাবাজি, মাদক ব্যবসার নিয়ন্ত্রণসহ অপরাধ জগতের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে হতো এই সংঘাত-সংঘর্ষ। বিএনপি সরকার ক্ষমতায় থাকাকালে ২০০৪ সালের দিকে আওয়ামী লীগ ক্যাডার শহীদুল্লাহ অস্ত্রসহ র‌্যাবের হাতে গ্রেফতার হন। অন্যদিকে র‌্যাবের অভিযান থেকে বাঁচতে মোরশেদ খান আত্মগোপনে চলে যান। এই দুই সন্ত্রাসীর একজন পলাতক, আরেকজন গ্রেফতার হয়ে জেলে যাওয়ার পর এলাকার পরিস্থিতি কিছুটা শান্ত হয়। তবে গত ১৬ বছরে আওয়ামী লীগের নতুন নতুন সন্ত্রাসী সৃষ্টি হয়। যারা অপরাধ জগৎ নিয়ন্ত্রণ করে। এর মধ্যে এসপি বাবুল আক্তারের স্ত্রী মিতু হত্যা মামলার আসামি এহতেশামুল হক ভোলা, নাউক্কা কাজল, কিরিচ বাবুলসহ বিভিন্ন সন্ত্রাসী গ্রুপ এলাকায় আধিপত্য বিস্তার করে।

সূত্র জানায়, শহীদুল্লাহ জেল থেকে ছাড়া পেয়ে সবকিছু ছেড়ে দেন। আওয়ামী লীগের আমলে দাপট দেখানো অনেক সন্ত্রাসীও এলাকাছাড়া হয়ে যায় ৫ আগস্টের পর। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর এলাকায় ফিরে আসেন মোরশেদ খান। তিনি এসেই আবারও শুরু করেন চাঁদাবাজি। বহদ্দারহাট থেকে কর্ণফুলী শাহ আমানত সেতু পর্যন্ত যেসব গার্মেন্ট রয়েছে সেসব গার্মেন্টের ঝুট ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ নেন মোরশেদ খান। কর্ণফুলী সেতু এলাকার বাস টার্মিনাল ছাড়াও দক্ষিণ বাকলিয়া, পূর্ব বাকলিয়া, পশ্চিম বাকলিয়া, কোতোয়ালি ও চান্দগাঁওয়ের কিছু অংশে আধিপত্য বিস্তার করেন। এসব এলাকায় নতুন বাড়ি করলে, জমি বেচাকেনা হলে তাকে দিতে হয় চাঁদা। এই কয়েক মাসে বেপরোয়া চাঁদাবাজির মাধ্যমে কয়েক কোটি টাকার মালিক বনে যান মোরশেদ খান। তুলাতলি এলাকায় অবস্থিত নিড গার্মেন্টের দক্ষিণ বাকলিয়ার তক্তারপোল, চর চাক্তাই স্কুল গলি, বাদামতলী মোড়, জামাই বাজার, ইছহাকের পোল, চাক্তাই নয়া মসজিদ, খাজুরতলীসহ ১২-১৪টি স্পটে হয় জমজমাট মাদক ব্যবসা। পুলিশ প্রশাসনসহ বিভিন্ন গ্রুপকে ম্যানেজ করেই চলে এই ব্যবসা।

জানা গেছে, এতদিন এসব মাদক স্পট নিয়ন্ত্রণ করত কিশোর গ্যাংয়ের গডফাদার হিসাবে পরিচিত সোবহান। তার ভাই করিম ছাড়াও বাদশা, সাইফুল, সাজ্জাদসহ কিশোর গ্যাংয়ের বিশাল একটি গ্রুপ এসব মাদক স্পট নিয়ন্ত্রণ করে সেখান থেকে প্রতি মাসে লাখ লাখ টাকা আদায় করে। মোরশেদ খান ফেরার পর এসব মাদক স্পটের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার চেষ্টা করে। তার অনুসারী হিসাবে পরিচিত খোরশেদ, রাজিব খান, আজম খান, শওকত, গলাকাটা হোসেন, কালন, মোটা জাগির এসব মাদক স্পটে হানা দিয়ে ব্যবসার ভাগ দেওয়ার জন্য সোবহান গংকে তাগাদা দেয়। এতে কাজ না হওয়ায় একপর্যায়ে মোরশেদ খান নিজেই অনুসারীদের নিয়ে ৮ জুন সোবহানের আস্তানায় হানা দেয়। এ সময় সোবহানের অনুসারীরা এলোপাতাড়ি কুপিয়ে মোরশেদ খান ও তার সহযোগীদের আহত করে। মোরশেদ খানের মাথায় কোপ পড়ে। তিনি পরিচয় গোপন করে চমেক হাসপাতালে চিকিৎসা নেন। তার আরও একাধিক অনুসারী ওইদিন গুরুতর আহত হন। অস্ত্র ফেলে পালিয়ে আসেন মোরশেদ খান। এই ঘটনাটি ঘটে বাকলিয়া থানার আলী স্টোর বিল্ডিং তক্তারপুলসংলগ্ন আবদুল করিম বাইলেনে। পরে পুলিশ এসে অভিযান চালিয়ে একটি বিদেশি পিস্তল উদ্ধার ও মোরশেদ খানের অনুসারী হিসাবে পরিচিত শফিকুল ইসলাম ওরফে শফিককে গ্রেফতার করে। এ ঘটনায় ৯ জুন বাকলিয়া থানায় অস্ত্র আইনে মামলা করা হয়। বাকলিয়া থানার এসআই মো. নিজাম উদ্দিন বাদী হয়ে এই মামলা করেন।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে এলাকার একাধিক সাধারণ ব্যবসায়ী ও এলাকাবাসী বলেছেন, ২০ বছর আগে মোরশেদ খান ছিলেন এলাকার মূর্তিমান আতঙ্ক। ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর আবারও তিনি এলাকায় ফিরে সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি ও মাদক-বাণিজ্য করছেন। ব্যবসায়ীরা তার কাছ থেকে নিস্তার পাচ্ছেন না। প্রতিপক্ষ গ্রুপের সঙ্গে সংঘাত-সংঘর্ষে লিপ্ত হচ্ছেন। এ অবস্থায় সাধারণ মানুষ আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন। মোরশেদ খানের এলাকায় ফিরে আসা ও অপকর্মে নেতৃত্ব দেওয়ার অভিযোগ প্রসঙ্গে বাকলিয়া থানার ওসি (তদন্ত) মোজাম্মেল হক যুগান্তরকে বলেন, ৮ জুন বাকলিয়ায় মোরশেদ খান ও সোবহান গ্রুপের মধ্যে মারামারির ঘটনা ঘটেছে। খবর পেয়ে পুলিশ অভিযান চালিয়ে অস্ত্রসহ একজনকে গ্রেফতার করেছে। তবে ওই ঘটনায় কেউ থানায় মামলা করেনি। অস্ত্র উদ্ধারের ঘটনায় পুলিশ বাদী হয়ে একটি মামলা করেছে। তদন্ত করে পরবর্তী আইনি পদক্ষেপ নেওয়া হবে।

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম