Logo
Logo
×

শেষ পাতা

শত বছরের ‘সাতক্ষীরা হাউজ’

ঐতিহ্যের স্মারক হিসাবে সংস্কার করতে চান যশোরের ডিসি

Icon

তৌহিদ জামান, যশোর

প্রকাশ: ১৪ জুন ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

ঐতিহ্যের স্মারক হিসাবে সংস্কার করতে চান যশোরের ডিসি

একশ বছরের বেশি সময় পার করেছে যশোরের ঐতিহ্যবাহী ‘সাতক্ষীরা হাউজ’। বিশাল আয়তনের এ স্থাপনা একশ বছর ধরে জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের বাসভবন হিসাবে ব্যবহৃত হতো। নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে ভবনটি এখন পরিত্যক্ত হলেও ঐতিহ্যের স্মারক হিসাবে তা সংস্কারের প্রচেষ্টা করছেন যশোরের বর্তমান জেলা প্রশাসক মো. আজাহারুল ইসলাম।

সাতক্ষীরা হাউজের সেই বিশাল জায়গায়ই পরে নির্মাণ করা হয় যশোর জেলা প্রশাসকের বাসভবন। ইট, চুন-সুরকি দিয়ে তৈরি ঘরের দেওয়াল, লম্বা বড় বারান্দা, ছাদে ব্যবহৃত হয়েছে বড় বড় কাঠের কড়ে বর্গা, মেঝেতে মূল্যবান টাইলস। বলা হচ্ছে, এই ভবনের স্থাপত্যশৈলীতে ঐতিহ্যের ছাপ রয়েছে।

বয়সের ভারে ন্যুব্জ এই ভবনের সেই জৌলুস আর নেই। দেওয়াল থেকে খসে পড়েছে পলেস্তারা, ভেঙে গেছে জানালার ঘুলঘুলি, দরজা, সিঁড়ি, ছাদের কোথাও কোথাও ভেঙে পড়েছে, দেওয়ালের ফাঁকে ও ছাদের ওপরে গজিয়েছে বটসহ নানা গাছগাছালি।

জেলা প্রশাসনের নথি ঘেঁটে জানা যায়, ‘সাতক্ষীরা হাউজ’ নামে পরিচিত ভবনটি ১৯২১ সাল থেকে যশোর জেলা প্রশাসকের বাসভবন হিসাবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। ভবনের মূল মালিক ছিলেন তৎকালীন সাতক্ষীরার জমিদার শৈলজানন্দ চৌধুরী (শৈলজা নাথ চৌধুরী)।

১৮৯৫ সালের শেষের দিকে নির্মিত সাতক্ষীরা হাউজ স্থাপত্য নিদর্শনের এক উজ্জ্বল ঐতিহ্য। দোতলা এ ভবনসংলগ্ন জমির পরিমাণ ২৪ দশমিক ৭৫ একর। বিশালাকৃতির ভবনের নিচতলায় ছোট-বড় মিলিয়ে ১৮টি ঘর এবং উপরতলায় ১৩টি কক্ষ। ছাদে ব্যবহৃত কড়ে মূল্যবান কাঠের, দেওয়াল ২০-২৫ ইঞ্চি চওড়া, বড় একটি হলরুম, গেস্টরুমের মেঝেতে মূল্যবান পাথরের টাইলস ব্যবহার করা হয়েছে। ২০১৭ সালের ৯ জুলাই সাতক্ষীরা হাউজ সংরক্ষণ প্রসঙ্গে গণপূর্তের নির্বাহী প্রকৌশলীকে দেওয়া পত্রে তৎকালীন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক দেবপ্রসাদ পাল বিষয়গুলো উল্লেখ করেন।

২০০৩ সালের ২৩ মার্চ গণপূর্তের তৎকালীন নির্বাহী প্রকৌশলীর দেওয়া প্রতিবেদনে জানা যায়, ১৮৯৫ সালে নির্মিত এ ভবনটি। দ্বিতল ভবনের নিচতলা ৮ হাজার ৮০০ বর্গফুট, দোতলা ৮ হাজার বর্গফুট। ভবনটি বসবাসের অনুপযোগী, ঝুঁকিপূর্ণ, মেরামত অযোগ্য। বসবাসের জন্য বিপজ্জনক বিধায় ১৯৯৩ সালের ৪ এপ্রিল তৎকালীন জেলা প্রশাসক এ ভবন ত্যাগ করে পাশে গণপূর্তের বাংলোয় ওঠেন।

জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, বিশাল এ ভবনটি তৎকালীন সাতক্ষীরার জমিদার শৈলজানন্দ চৌধুরী (শৈলজা নাথ চৌধুরী) নিজে বসবাসের জন্য নির্মাণ করেন।

১৯২১ সালে জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের বাসভবন হিসাবে মাসিক ১২০০ টাকা ভাড়ায় ভারত সম্রাট প্রথমে ১৫ বছরের জন্য লিজ নেয়। ওই বছর থেকেই জেলা ম্যাজিস্ট্রেট বসবাস শুরু করেন। পরে এই লিজ আরও ১০ বছরের জন্য বাড়ানো হয়। লিজ থাকাকালে ভবনের মালিক যশোর লোন কোম্পানির কাছে ভবনটি বন্ধক রাখেন। লোন কোম্পানি ১৯৩৩ থেকে ১৯৩৮ সালের মধ্যে তিনটি মানি এক্সিকিউশন কেসের মাধ্যমে ভবনটি খরিদ করে। এতে লোন কোম্পানি ভবনের মালিক হয়। ১৯৪৩-৪৪ সালের কোনো একসময় কলকাতা হাইকোর্ট যশোর লোন কোম্পানিকে অবলুপ্ত ঘোষণা করেন এবং কলকাতা ব্যাংক লিমিটেডের সঙ্গে সংযুক্ত হয়।

১৯৪৬ সালের ২০ নভেম্বর ২ লাখ ৪৭ হাজার টাকায় কলকাতা ব্যাংকের কাছ থেকে নিলামের মাধ্যমে করাচি নিবাসী মেসার্স এম হক এবং আক্তার হোসেন সাতক্ষীরা হাউজের মালিক হন।

এদিকে কলকাতা ব্যাংক লিমিটেড এই বাড়ির লিজ নবায়নে অসম্মত হলে যশোরের তৎকালীন জেলা ম্যাজিস্ট্রেট এইচএইচ নোমানি রিকুইজিশন কেসের আদেশের মাধ্যমে বাড়িটি রিকুইজিশন এবং আগের মতোই জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের বাসভবন হিসাবে বলবৎ করেন।

পরবর্তী সময়ে কলকাতা হাইকোর্টের আদেশে কলকাতা ব্যাংক লিমিটেডের পক্ষে অফিশিয়াল লিকুইডিটর হিসাবে ঢাকা হাইকোর্টকে নিযুক্ত করা হয়। ঢাকা হাইকোর্টের ১৯৭৭ সালের ২৬ জানুয়ারির আদেশবলে কলকাতা ব্যাংক লিমিটেডের সমুদয় সম্পত্তির মালিক বাংলাদেশ ব্যাংককে নিযুক্ত করা হয় এবং সাতক্ষীরা হাউজসহ কলকাতা ব্যাংকের সম্পত্তির মালিক হিসাবে বাংলাদেশ ব্যাংক দেখাশোনা করে।

বাংলাদেশ ব্যাংক ১৯৭৮ সালের ১০ আগস্ট সাতক্ষীরা হাউজ খরিদ বা অধিগ্রহণের জন্য জেলা প্রশাসক যশোরকে প্রস্তাব করে। সেই মোতাবেক সংস্থাপন মন্ত্রণালয় স্বীকৃত হয়ে ৪৩ লাখ ৬০ হাজার টাকা মূল্য ধার্য ও প্রদান করে ১/৮৮-৮৯ এলএ কেসের মাধ্যমে ওই ভবন অধিগ্রহণ করে জেলা প্রশাসক মালিক হন।

এদিকে ২০০৩ সালের ২৩ মার্চ গণপূর্তের নির্বাহী প্রকৌশলী এক জরিপ প্রতিবেদনে জানান, নিকারের ৮১তম সভার কার্যবিবরণী অনুযায়ী ভবন (সাতক্ষীরা হাউজ) ভাঙার সিদ্ধান্ত ও নতুন ভবন (জেলা প্রশাসকের বাসভবন) তৈরির সিদ্ধান্ত হয়। সেই সিদ্ধান্ত অনুযায়ী নতুন ভবন নির্মাণ ও হস্তান্তর এবং পুরোনো ভবন ভাঙার জরিপ শেষ হয়েছে।

এরপরও ঐতিহ্য হিসাবে ভবন সংস্কারের জন্য ইতঃপূর্বে যশোর জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে উদ্যোগ নেওয়া হয়। সবশেষ যশোরের নতুন জেলা প্রশাসক মো. আজাহারুল ইসলামও একই মত পোষণ করেন। তিনি বলেন, স্মারক হিসাবে এই ঐতিহ্যবাহী ভবনটি সংস্কার করতে চাই। ব্যবহারের জন্য নয়। অথবা এই আদলে আরেকটি ভবন নির্মাণ।

মে মাসের মাঝামাঝি পরিকল্পনা কমিশনের (আর্থসামাজিক অবকাঠামো বিভাগ) সদস্য (সচিব) ড. কাউয়ুম আরা বেগম ভবনটি সরেজমিন পরিদর্শন করেন। তিনিও পুরোনো ডিসি অফিস ও এই ভবনের সংরক্ষণে একটি প্রকল্প পাঠাতে বলেছেন।

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম