Logo
Logo
×

শেষ পাতা

ধুয়া-জারিগানের জাদুকর মরমি কবি পাগলা কানাই

Icon

মিজানুর রহমান, ঝিনাইদহ

প্রকাশ: ১৮ জুন ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

ধুয়া-জারিগানের জাদুকর মরমি কবি পাগলা কানাই

কবি-সাহিত্যিক আর আধ্যাত্মিক পুরুষের পুণ্যভূমি ঝিনেদার (ঝিনাইদহ) হতদরিদ্র এক কৃষক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন কানাই। তৎকালীন যশোর জেলার ঝিনাইদহ মহকুমার (বর্তমান জেলা) সদর উপজেলার বেড়বাড়ি গ্রামের কুড়ন শেখ ও মোমেনা খাতুন দম্পতির তিন সন্তানের মধ্যে কানাই সবার বড়।

১৮০৩ সালে মতান্তরে ১৮০৯ সালে কানাইয়ের জন্ম বলে প্রচলিত রয়েছে। কিন্তু সঠিক কবে জন্মেছেন তা নিয়ে রয়েছে বিতর্ক। তার কোনো ছবিও নেই, যা এখন পাওয়া যায় তার সবকিছু কাল্পনিক। মাজারে স্থাপন করা প্রতিকৃতিও ভাস্কর্য শিল্পীর কল্পনার ফসল। বাংলার পথে পথে দোতারা হাতে গান গেয়ে ফেরা মরমি গীতিকবি পাগলা কানাই ১৮৮৯ (বাংলা ১২৯৬ সালের ২৮ আষাঢ়) সালে মৃত্যুবরণ করেন।

এক সময় যশোর জেলার অন্তর্গত ছিল ঝিনাইদহ মহকুমা। অত্যন্ত প্রাচীন এ জনপদের ইতিহাস-ঐতিহ্য মাটির পরতে পরতে লেগে আছে। সুলতানি আমল, নীলকর আর জমিদারদের অসংখ্য চিহ্ন যেমন রয়েছে, তেমনি রয়েছে কবি-সাহিত্যিক-সাধক পুরুষের উপাখ্যানের নানা চমকপ্রদ ইতিহাস।

কানাইয়ের ভাইয়ের নাম ছিল উজোল শেখ, বোন স্বরনারী। কানাই যখন খুব ছোট তখন তার বাবা মারা যান। পিতৃহারা কানাই ভবঘুরে হয়ে ওঠেন। জীবন-জীবিকার তাগিদে মা মোমেনা খাতুন বর্তমান কালীগঞ্জ উপজেলার চেউনে ভাটপাড়া গ্রামে এক আত্মীয়র বাড়িতে কানাইকে পাঠিয়ে দেন। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যে মা মারা গেলেন। বোন স্বরনারী দুই ভাইকে নিজের আশ্রয়ে (শ্বশুরবাড়ি) বেড়বাড়ি গ্রামে নিয়ে আসেন। দুরন্ত প্রকৃতির কানাই শরীর গঠনের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে অধ্যাত্ম প্রেমে উদ্বুদ্ধ হতে থাকেন। সে সময় জারিগান, পালাগান, কবিগানের আসর বসত গ্রামে গ্রামে।

ঢাকঢোল পিটিয়ে হাট-বাজারে-বন্দরে কাড়া দিয়ে জানিয়ে দেওয়া হতো দিনক্ষণ। কানাই গ্রামের মেঠোপথ ধরে আপন মনে গান গেয়ে বেড়াতে লাগলেন। ধীরে ধীরে আশপাশের বাড়ি বাথান ফকিরাবাদ, চণ্ডীপুরসহ নানা গ্রামে পরিচিত হয়ে ওঠেন কানাই। বোনের বাড়িতে গরু চরাতেন আর মনের আনন্দে গান বাঁধতেন, নিজের সুরে গেয়ে বেড়াতেন। ছোটবেলা থেকে পাগলাটে স্বভাবের হওয়ার কারণে লোকে তাকে পাগলা অভিধাটি (উপনাম) যুক্ত করেন। তার কর্মকীর্তির সঙ্গে এ পাগলা উপাধিটি অভিন্ন সূত্রে গ্রথিত হয়েছে।

এক জায়গায় বেশিদিন ভালো লাগত না কানাইয়ের। গরু চরানো রেখে কাজ নেন মাগুরা জেলার আঠারো-খাদার জমিদার চক্রবর্তী পরিবারের বেড়বাড়ির নীলকুঠিতে। মাত্র দুই টাকা বেতনের খালাসির চাকরি বেশিদিন করা হয়ে ওঠেনি। গানের টানে পথে বের হন আবারও। গান বাঁধার পরে সুর দিয়ে ধুয়ো-জারিগান যখন গাইতেন তখন উপস্থিত সবাই তার গানে মুগ্ধ হয়ে যেতেন। কিন্তু তার ছিল না কোনো আনুষ্ঠানিক সংগীত শিক্ষা, জানতেন না লেখাপড়া। তবে তৎকালীন বাউল, সাধু-ফকির প্রভৃতি গুণিজনের পদচারণা সর্বোপরি জীবন ও জগৎ সম্পর্কে কবির আত্মজিজ্ঞাসা ও আত্ম-অন্বেষণ তাকে প্রখর অধ্যাত্ম জ্ঞানে পরিপূর্ণ করে তোলে। তার গানে ইসলাম ও আল্লাহর প্রিয় নবী মুহাম্মদের (সা.) প্রতি গভীর অনুরাগ প্রকাশ পায়।

জানা যায়, বেড়বাড়ি গ্রামে সে সময় একটি মক্তব ছিল। সেখানে আরবি শেখানো হতো। ওই মক্তবে বেশিদিন যাতায়াত ছিল না কানাইয়ের। তিনি তার গানে উল্লেখ করেছেন-

‘লেখাপড়া শিখব বলে গেলাম মক্তবে,

পাগলা ছ্যাড়ার হবে না কিছু,

ঠাট্টা করে কয় সবে,

ছ্যাড়া বলে কিরে তাড়ুম তাড়ুম,

মারে সবাই গাড়ুম গুড়ুম,

বাপ এক গরিব চাষা,

ছাওয়াল তার সর্বনাশা।

সে আবার পড়তে আসে কেতাব কোরআন ফেকা,

পাগলা কানাই কয় ভাইরে পড়া হলো না শেখা।’

মুহম্মদ মনসুর উদ্দীন, ড. মাযহারুল ইসলাম, আবু তালিব, আমিন উদ্দিন শাহ, দুর্গাদাস লাহিড়ী, উপেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্যের মতো মনীষীরা পাগলা কানাইয়ের গানের সংগ্রহ এবং গবেষণা করেছেন। পাগলা কানাই ইসলাম ধর্মের পরিপূর্ণ অনুসারী ছিলেন এবং ইসলাম ধর্মের বিধিবিধানগুলো সঠিকভাবে মেনে চলতেন। বিভিন্ন গানের মধ্য দিয়ে তার এই অভিব্যক্তি পরিস্ফুটিত হয়েছে।

কানাইয়ের সবগুলো গানই আঞ্চলিক ভাষায় লেখা। যদিও ভারতের পশ্চিম বাংলার কূল ঘেঁষে গড়ে ওঠা জনপদে বেড়ে ওঠা এবং উত্তরবঙ্গ ও ফরিদপুর অঞ্চলের তৎকালীন কবি-সাধকদের সান্নিধ্য লাভের ফলে কানাইয়ের গানে বৈচিত্র্য ছিল ভিন্ন স্বাদের। মূলত তার গানে ছিল মুসলিম জাগরণের আহ্বান।

খোন্দকার রিয়াজুল হক তার লেখা বইয়ে উল্লেখ করেছেন, কবিত্ব প্রতিভায় লালনের পরেই তার (কানাই) স্থান বলা যায়। পুঁথিগত বিদ্যা না থাকলেও আধ্যাত্মিক চেতনায় জ্ঞানান্বিত হয়ে অপরূপ সৃষ্টিসম্ভার নিয়ে গ্রামবাংলার পথে-প্রান্তরে দোতারা হাতে ঘুরে ফিরেছেন তিনি।

কানাই ঠিক কতগুলো ধুয়া-জারি-লোকগীতি রচনা করেছেন তার সঠিক তালিকা আজও তৈরি করা হয়নি। অনেকটা অবহেলায় রয়ে গেছে গানগুলো। কারও কারও মতে, ধুয়া-জারির পদকর্তা পাগলা কানাই তিন সহস্রাধিক দেহতত্ত্ব, জারি, বাউল, মারফতি, ধুয়া, মুর্শিদী গানের স ষ্টা। দেহতত্ত্ব কানাইয়ের গানের প্রধান উপজীব্য হলেও জনজীবন, সমাজ ও সমকালের ভাবনা তার গানে বড় জায়গা পেয়েছে। যেগুলো থেকে বেরিয়ে আসে কালের ইতিহাস আর দিনকালের কথা। কথার পিঠে কথা লাগিয়ে তাৎক্ষণিক গান শোনাতে পারতেন তিনি। উপস্থিত বুদ্ধি দিয়ে তাৎক্ষণিকভাবে একের পর এক গানও রচনা করতে পারতেন। পালাগান বেঁধে সুর করে তা মনে রাখতে অসুবিধা হতো না তার। বহু পালাগান এভাবে মনের মধ্যে গেঁথে রেখেই শ্রোতাদের শোনাতেন।

জেলা কালচারাল অফিসার জসিম উদ্দিন জানান, কয়েক হাজার গানের মধ্যে সরকারিভাবে তিন শতাধিক গান সংরক্ষণ করা হয়েছে। শিল্পকলা একাডেমির উদ্যোগে কিছু কিছু গান পরিবেশন করা হয়ে থাকে। বর্তমানে ঝিনাইদহে পাগলা কানাই স্মৃতি সংরক্ষণ পরিষদ এই কবির সৃষ্টির গবেষণা এবং প্রচারের জন্য কাজ করে যাচ্ছে। পাগলা কানাই সংগীত একাডেমি অনেক প্রতিবন্ধকতার মাঝেও গানের নিয়মিত চর্চা করে যাচ্ছে। জেলা শহর থেকে মাত্র অনুমান সাড়ে ৫ কিলোমিটার পশ্চিমে বেড়বাড়ি গ্রামে তার সমাধিচত্বরে প্রতিবছর জন্ম এবং মৃত্যুদিবস পালন করা হয়। বসে গানের আসর। দেশ-বিদেশ থেকে ছুটে আসেন বাউল সাধকরা। বসে গ্রাম্যমেলা। সরকারিভাবে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে একটি লাইব্রেরি ও অডিটোরিয়াম।

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম