কুমিল্লা টাউন হল: দেড়শ বছরের শিক্ষা সংস্কৃতির বাতিঘর
আবুল খায়ের, কুমিল্লা
প্রকাশ: ২০ জুন ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
বীরচন্দ্র গণপাঠাগার ও নগর মিলনায়তন বা কুমিল্লা টাউন হল। জেলায় শিক্ষা-সংস্কৃতির বাতিঘর। এটি দেড়শ বছর ধরে জ্ঞানের মশাল জ্বেলে রেখেছে। নগরবাসীর প্রাণ খুলে নিশ্বাস নেওয়ার একটুকরো শান্তিনিকেতন। এখানে শুধু জ্ঞানের চর্চাই নয়, চলে রাজনীতি, সমাজনীতি ও অর্থনীতির চর্চা। স্থাপত্যশৈলীর অনন্য এ নিদর্শনটি অবিভক্ত ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের রাজপরিবারের স্মৃতি বহন করছে। প্রতিষ্ঠানটি জেলাবাসীর গৌরবের প্রতীক। ভাষা আন্দোলন, স্বাধীনতাযুদ্ধসহ বিভিন্ন স্বাধিকার আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দুও ছিল এ টাউন হল।
জানা যায়, ১৮৮৫ সালে কুমিল্লা শহরের কান্দি খালের তীরে প্রতিষ্ঠিত হয় বীরচন্দ্র গণপাঠাগার ও নগর মিলনায়তন। শহরের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত হওয়ায় স্থানীয় বাসিন্দারা টাউন হল নামেই চেনে। এ টাউন হলকে কেন্দ্র করেই বিকশিত হয়েছে কুমিল্লার শিক্ষা, সংস্কৃতি, রাজনীতি, আর্থসামাজিক ও কল্যাণমুখী নানা কর্মযজ্ঞ। এখানে পদধূলি পড়েছিল জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, মহাত্মা গান্ধী, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ, মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, ভাষাসৈনিক ধীরেন্দ্রনাথ, ড. সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায়ের মতো বিশিষ্টজনের।
তৎকালীন ত্রিপুরার মহারাজার জমিদারিকালে গণপাঠাগারটি কাছারি বাড়ি হিসাবে ব্যবহৃত হতো। তার নায়েব-গোমস্তারা এ কাছারি বাড়িতে থাকতেন। পরে ১৮৮৫ সালে মহারাজ বীরচন্দ্র মাণিক্য বাহাদুর নিজস্ব অর্থায়নে ১০ বিঘা জমির ওপর এটি প্রতিষ্ঠিত করেন। স্বাধীনতার পর পাঠাগারের সামনে শহীদ মিনার গড়ে ওঠে। শহীদ মিনারের পাশে স্থাপন করা হয় মুক্তমঞ্চ। রয়েছে একটি মিলনায়তনও, যা নগর মিলনায়তন নামে পরিচিত। দ্বিতলবিশিষ্ট ভবনের মূল ফটকের ফ্লোরে সারি সারি টেবিলের ওপর দেশের শীর্ষস্থানীয় পত্রিকাগুলো সাজানো থাকে পাঠকের জন্য। সকাল ১০টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত বিনামূল্যে পত্রিকা পাঠ করা যায়। ভবনের সিঁড়ি বেয়ে দ্বিতীয় তলার একটি কক্ষের তাকে সাজানো রয়েছে প্রাচীনকাল থেকে বর্তমান পর্যন্ত প্রকাশিত সৃজনশীল গবেষণালব্ধ বহু বই। এখানে বসে পাঠকের বই পড়ার ব্যবস্থা রয়েছে। গবেষণার জন্য পাঠাগারের আলাদা কক্ষে বই পড়ার সুব্যবস্থা আছে। পাঠাগারে এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা, রাজমালা থেকে শুরু করে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের কবি, সাহিত্যিক, রাজনীতিক ও ধর্মীয় মনীষীদের রচনাসমগ্র রয়েছে। এখানে বাংলা ভাষার ২৪ হাজার এবং ইংরেজি ভাষার ছয় হাজার বই রয়েছে। ৩০ হাজার বই দিয়ে ৬৩টি আলমারি সজ্জিত। সদস্যরা একসঙ্গে এক সপ্তাহের জন্য তিনটি বই নিতে পারেন। তাছাড়া সংরক্ষিত গ্রন্থগুলো পাঠাগারে বসে পাঠ করা যায়। কেউ চাইলে পুরোনো পত্রিকার কপি দেখতে পারেন। গণপাঠাগারের সামনে রয়েছে সবুজ চত্বর। প্রতিদিন বিকাল ও সন্ধ্যায় স্থানটা থাকে আড্ডামুখর। সবুজ ঘাসে বসে কেউ গলা ছেড়ে গান গায়। কেউবা করেন আবৃত্তি।
স্থানীয়রা জানান, বীরচন্দ্র গণপাঠাগারে রয়েছে সেরা সব বইয়ের সংগ্রহ। অনেক বড় বড় মনীষী এখানে এসে বিভিন্ন সময় কথা বলেছেন। এ টাউন হলের মঞ্চেই নাটক করেছেন ভাষাসংগ্রামী লায়লা নুরসহ অসংখ্য গুণী শিল্পী। আবৃত্তি করেছেন দুই বাংলার অনেক শিল্পী।
কুমিল্লার ইতিহাসবেত্তা আহসানুল কবীর বলেন, ১৮৮৫ সালে নগরের প্রাণকেন্দ্র কান্দিরপাড়ে কুমিল্লা টাউন হল প্রতিষ্ঠিত হয়। অত্যন্ত দৃষ্টিনন্দন কারুকাজে ভবনটি নির্মিত। ১৯৩০ সালে এটি প্রথম সংস্কার করা হয়। ২০০২-০৩ সালে এটি পুনরায় সংস্কার করা হয়।
টাউন হলের সদস্য সচিব সাজ্জাদুল কবির যুগান্তরকে বলেন, কুমিল্লা টাউন হল জেলাবাসীর গৌরবের প্রতীক। এটি দেড়শ বছরের ঐতিহ্য ধারণ করছে। আমরা সব শ্রেণি-পেশার মানুষের প্রয়োজনে সব সময় সেবা দিয়ে আসছি।
জেলা প্রশাসক আমিরুল কায়সার বলেন, কুমিল্লার ইতিহাস-ঐতিহ্যের সঙ্গে জড়িয়ে আছে টাউন হল। প্রতিষ্ঠানটি জেলাবাসীর প্রতিমুহূর্তের জন্য প্রাসঙ্গিক। আমরা মানুষের প্রত্যাশা অনুযায়ী টাউন হলের আধুনিকায়নের পদক্ষেপ নেব।
