দেশের একমাত্র জাতিতাত্ত্বিক জাদুঘর
ছাদ দিয়ে পড়ছে পানি নষ্ট হচ্ছে নিদর্শন
আলোচনা সভায় মাস্টারপ্ল্যান করার সিদ্ধান্ত জানালেন মহাপরিচালক
এম এ কাউসার, চট্টগ্রাম
প্রকাশ: ২২ জুন ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
নানা সংকট ও সমস্যা নিয়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে চট্টগ্রামের জাতিতাত্ত্বিক জাদুঘরের কার্যক্রম। ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির এই সংগ্রহশালায় রয়েছে বিভিন্ন দেশের ২৯টি জনগোষ্ঠীর ব্যবহৃত পণ্য। হাজার বছরের পুরোনো নকশিকাঁথা থেকে শুরু করে রয়েছে কাপড়-চোপড়-অলংকার এবং তীর-বল্লমের মতো হাতিয়ার। এটি কেবল চট্টগ্রামের নয়, দেশের একমাত্র জাতিতাত্ত্বিক জাদুঘর। তবে ষাট বছরের পুরোনো ভবনে পরিচালিত জাদুঘরটি এখন অনেকটাই জরাজীর্ণ হয়ে গেছে। বৃষ্টি হলেই ছাদ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছে জাদুঘরের ভেতরে। এতে প্রত্নতাত্ত্বিক অনেক নিদর্শন নষ্ট হওয়ার উপক্রম হয়েছে।
এদিকে আন্তর্জাতিক জাদুঘর দিবস উপলক্ষ্যে চট্টগ্রামের জাতিতাত্ত্বিক জাদুঘরে দুদিনের সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়েছে। শনিবার জাদুঘরের সেমিনার হলে আয়োজিত সমাপনী দিনে উপস্থিত ছিলেন প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের মহাপরিচালক সাবিনা আলম। এদিন জাতিতাত্ত্বিক জাদুঘরের প্রদর্শনী পরিকল্পনার আধুনিকায়ন : স্থাপত্যিক চ্যালেঞ্জ ও করণীয় শীর্ষক প্রবন্ধ উপস্থাপন করা হয়। সভায় জাদুঘরের সার্বিক উন্নয়নে মাস্টারপ্ল্যান করার কথা জানানো হয়।
জানা গেছে, এশিয়া মহাদেশে দুটি জাতিতাত্ত্বিক জাদুঘর রয়েছে। এর মধ্যে একটি রয়েছে বাংলাদেশে এবং অপরটি রয়েছে জাপানে। ১৯৬৫ সালে নগরীর আগ্রাবাদ বাণিজ্যিক এলাকায় ১ দশমিক ২৫ একর স্থানজুড়ে গড়ে তোলা হয় দেশের একমাত্র জাতিতাত্ত্বিক জাদুঘর। এটি সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের নিয়ন্ত্রণাধীন। এই জাদুঘরটি মূলত দেশের বিভিন্ন সাংস্কৃতিক গোষ্ঠীর উত্তরাধিকার ও তাদের জীবনপ্রণালী সম্পর্কে দর্শনার্থীদের ধারণা দেওয়ার নিমিত্তে প্রতিষ্ঠিত। এখানে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক গোষ্ঠীর প্রাত্যহিক জীবনের ব্যবহৃত বেশ কিছু দুর্লভ সামগ্রী রয়েছে। এখানে রয়েছে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীসহ বিদেশি পাঁচটি দেশের জাতিতাত্ত্বিক গোষ্ঠীর বিভিন্ন সামগ্রীর তুলনামূলক বিশ্লেষণ। বাংলাদেশের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর মধ্যে পার্বত্য চট্টগ্রামের চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, মুরং, বম, খিয়াং, খুমি, চাক, রাখাইন, পাংখোয়া; সিলেট অঞ্চলের খাসিয়া, মনিপুরী, পাঙন, পাত্র; ময়মনসিংহ অঞ্চলের গারো, হাজং, দালু, মান্দাই, কোচ; রাজশাহী-দিনাজপুর অঞ্চলের সাঁওতাল, ওরাঁও, রাজবংশী, পলিয়া এবং যশোর-ঝিনাইদহ অঞ্চলের বুনো বা বোনা, বাগদি অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।
জাদুঘরে রয়েছে চারটি গ্যালারি ও একটি কেন্দ্রীয় হল। এর তিনটি গ্যালারিতে বাংলাদেশের ২৯টি সাংস্কৃতিক গোষ্ঠীর নানা রকমের ব্যবহারিক সামগ্রী যেমন : অস্ত্র, ফুলদানি, কাপড়, নৌকা, কাঁচি, অলংকার, বাঁশের পাইপ ইত্যাদি এবং বাকি গ্যালারিতে ভারত, পাকিস্তান, কিরগিজস্তান, অস্ট্রেলিয়া, জার্মানির কিছু সম্প্রদায়ের জীবনপ্রণালী প্রদর্শনের ব্যবস্থা করা আছে। হলরুমের মানচিত্র ও দেয়ালচিত্রের মাধ্যমে উপজাতিদের বিভিন্ন রকম উৎসব ও সংস্কৃতি সম্পর্কেও দর্শনার্থীদের ধারণা দেওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে। এছাড়াও ১৯৮৯ সালে ভেঙে ফেলা জার্মানির বার্লিন প্রাচীরের অংশবিশেষ প্রদর্শনীতে রয়েছে।
সূত্র জানায়, ১৯৭৪ সালে জাতিতাত্ত্বিক জাদুঘরটি সর্বসাধারণের পরিদর্শনের জন্য উন্মুক্ত করা হয়। ওই বছরের ৯ জানুয়ারি স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের প্রথম শিক্ষামন্ত্রী ইউসুফ আলী এই জাদুঘর উদ্বোধন করেন। এটি রোববার ও সরকারি ছুটির দিন ব্যতীত প্রতিদিন সকাল ১০টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত থাকে। গড়ে প্রতিদিন দেশি-বিদেশি গবেষকসহ দুই শতাধিক দর্শনার্থী এই জাদুঘর পরিদর্শন করেন। টিকিটের মূল্য যথাক্রমে দেশীয় দর্শনার্থীদের জন্য ৩০ টাকা, বিদেশিদের জন্য ৪০০ টাকা, সার্কভুক্ত দেশের নাগরিকদের জন্য ২০০ টাকা এবং ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের জন্য ১০ টাকা নির্ধারণ করা হয়। সর্বশেষ জুলাই ২০২৪ থেকে এপ্রিল ২০২৫ পর্যন্ত ১০ মাসে ২৪ হাজার ২২ জন দর্শনার্থী জাদুঘর পরিদর্শন করেছেন। এতে সাত লাখ সাত হাজার ১৫০ টাকা আয় হয়।
জাতিতাত্ত্বিক জাদুঘরের সমস্যাসমূহ : চট্টগ্রামের জাতিতাত্ত্বিক জাদুঘরে জনবল সংকটসহ নানা ধরনের সমস্যা রয়েছে। সংশ্লিষ্টরা জানান, জাদুঘরের সাংগঠনিক কাঠামোতে মোট পদ রয়েছে ৩০টি। তবে বর্তমানে কর্মরত রয়েছেন ১৬ জন। সহকারী পরিচালক ও ফিল্ড অফিসারসহ প্রায় অর্ধেক পদ শূন্য রয়েছে। বর্ষা শুরু হতেই জাদুঘর ভবনের ছাদ চুয়ে পানি পড়ছে। ষাটের দশকে নির্মিত ভবনটি জরাজীর্ণ অবস্থায় রয়েছে। এছাড়া জাদুঘরের অফিস ভবনও পুরাতন এবং জরাজীর্ণ অবস্থায় রয়েছে। তাই জাদুঘর ভবনের পাশাপাশি প্রয়োজনীয় ভবনগুলো আধুনিক স্থাপত্য শৈলীতে নির্মাণ করা প্রয়োজন বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। তাছাড়া সংস্কারের অভাবে জাদুঘরের সামনের সড়ক ও আঙিনায়ও প্রতিনিয়ত জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়। এতে করে দর্শনার্থীরা যাতায়াতে দুর্ভোগে পড়েন। এছাড়া জাদুঘরের ডিসপ্লে সিস্টেম আধুনিকায়ন না হওয়ায় বর্তমান তরুণ শ্রেণির দর্শনার্থীরা মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে।
জাদুঘর পরিদর্শনে যাওয়া কলেজ শিক্ষার্থী সোম্য নাথ বলেন, ‘জাতিতাত্ত্বিক জাদুঘরটি বর্তমানে যে জরাজীর্ণ অবস্থায় রয়েছে তা দর্শনার্থীদের কাম্য নয়। এখানে প্রদর্শিত সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সম্পর্কে নতুন প্রজন্মকে আকৃষ্টকরণে যুগোপযোগী কার্যক্রম গ্রহণ করা প্রয়োজন।
জাতিতাত্ত্বিক জাদুঘরের উপপরিচালক কাম কিপার মো. আমিরুজ্জামান যুগান্তরকে বলেন, ‘আন্তর্জাতিক জাদুঘর দিবস উদযাপন উপলক্ষ্যে দুই মাসব্যাপী নানা কর্মসূচি পালন করা হয়েছে। এর মধ্যে দর্শক জরিপ, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও দুদিনব্যাপী সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়। সেমিনারে বিদ্যমান জাদুঘর ভবনটি কিভাবে দর্শকদের কাছে আরও আকৃষ্ট করা যায় সে বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। এ নিয়ে একটি মাস্টারপ্ল্যান করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
