সিপিডির বাজেট সংলাপে ড. হোসেন জিল্লুর
ব্যবসা-বাণিজ্য অনিশ্চয়তায় ফেলছে গায়েবি মামলা
বাজেট অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় ব্যর্থ * কিছু রাজস্ব পদক্ষেপ বাজেটের মূল প্রতিপাদ্যের সঙ্গে সাংঘর্ষিক
যুগান্তর প্রতিবেদন
প্রকাশ: ২৩ জুন ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
সামগ্রিকভাবে দেশের চলমান অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় ব্যর্থ হয়েছে ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেট। রাজস্ব খাতের কিছু পদক্ষেপ বাজেটের মূল প্রতিপাদ্যের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। যদিও এবার ভৌত অবকাঠামোর পরিবর্তে মানুষের ওপর অগ্রাধিকার দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, এসব লক্ষ্যকে বাস্তবায়নে যথাযথ পদক্ষেপ বাজেটে নেই। তিনি বলেন, গায়েবি মামলার সংস্কৃতি দেশের পুরো ব্যবসা পরিমণ্ডলকে এক ধরনের গভীর অনিশ্চয়তার মধ্যে ফেলেছে। এতে এক ধরনের স্থবিরতা তৈরি হয়েছে। রোববার রাজধানীর একটি হোটেলে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) আয়োজিত সংলাপে এসব কথা বলা হয়। অনুষ্ঠানে বক্তারা বলেন, জুলাই বিপ্লব যে স্বপ্ন দেখিয়েছিল, অন্তর্বর্তী সরকারের বাজেট তা পূরণ করতে পারেনি। এবার অর্থনৈতিক দুষ্টচক্র থেকে বের হওয়ার সুযোগ ছিল। কিন্তু সেই সুযোগ কাজে লাগানো যায়নি।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. হোসেন জিল্লুর রহমান। অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন। সিপিডির বিশেষ ফেলো মোস্তাফিজুর রহমানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য রাখেন বিএনপির আন্তর্জাতিকবিষয়ক সহ-সম্পাদক রুমিন ফারহানা, তৈরি পোশাক মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর সিনিয়র সহসভাপতি এনামুল হক খান, অগ্রণী ব্যাংকের চেয়ারম্যান সৈয়দ আবু নাসের বখতিয়ার আহমেদ, বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) সভাপতি শওকত আজিজ রাসেল, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সাবেক চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ, বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি এক্সচেঞ্জ বাংলাদেশের চেয়ারম্যান এম মাসরুর রিয়াজ এবং ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরামের (ইআরএফ) সভাপতি দৌলত আক্তার মালা।
ড. হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, আজকে বাজেট অনুমোদন হচ্ছে। আর আমরা এখানে আলোচনা করছি। এর প্রভাব কী জানি না। তিনি বলেন, বর্তমানে গায়েবি মামলার সংস্কৃতি দেশের পুরো ব্যবসা পরিমণ্ডলকে এক ধরনের গভীর অনিশ্চয়তার মধ্যে ফেলেছে। এতে দেশে এক ধরনের স্থবিরতা তৈরি হয়েছে।
তিনি বলেন, একদিন আগে চট্টগ্রাম থেকে একজন জানালেন, তার নামে আরেকটা হত্যা মামলা হয়েছে। ১১০ জন আসামি। উনি ৯৫ নম্বরে। এভাবে গায়েবি মামলা হওয়ায় কে শাস্তি পাওয়ার যোগ্য, সেটি আলাদা করতে পারছি না। আমরা একটা ‘ব্ল্যাঙ্কেট সাসপিশন’র (একজনের অপরাধে সবাইকে সন্দেহ) পর্দা পুরো সমাজের ওপর ঢেলে রেখেছি। এ অবস্থায় সবাই হাত গুটিয়ে বসে থাকা ও ভুক্তভোগী হওয়া ছাড়া কোনো উপায় নেই।’ তিনি আরও বলেন, বিনিয়োগের স্থবিরতা কাটাতে শুধু অর্থ মন্ত্রণালয় নয়, পুরো সরকারব্যবস্থাকেই কাজ করতে হবে। স্বরাষ্ট্র থেকে শুরু করে বিচার বিভাগসহ প্রতিটি মন্ত্রণালয় যদি সঠিকভাবে কাজ না করে, তাহলে হবে না। ড. হোসেন জিল্লুর বলেন, আজকের আলোচনাতে সরকার একটু রাগ করতে পারে। তবে আমাদের রেগে যাওয়ার সময় হয়েছে। সেই রাগ অযৌক্তিক নয়। আমি এটাকে বলি পবিত্র রাগ। যে রাগের মাধ্যমে সমাজ পরিবর্তন করতে হয়, ওই রেগে যাওয়ার সময় হয়েছে। তিনি সরকারের সামনে ৫টি বড় চ্যালেঞ্জ রয়েছে বলে জানান। প্রথমত, শিক্ষাকে মানবসম্পদে রূপান্তর করা, বিনিয়োগে স্থবিরতা কাটানো, যুব কর্মসংস্থান নিশ্চিত করা, দারিদ্র্যবিমোচন ও বৈষম্য দূর করা এবং গার্মেন্টেসের বাইরে রপ্তানির নতুন খাত বের করা। তার মতে, আগামী দিনের জন্য অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির নতুন চালক বের করতে হবে। এক্ষেত্রে কৃষি, ওষুধ এবং আইটি খাতে বিশাল সম্ভাবনা রয়েছে। সেই সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে উদ্যোগ নিতে হবে।
হোসেন জিল্লুর রহমান আরও বলেন, বাজেটে বড় কোনো সিদ্ধান্তের জন্য রাজনৈতিক উদ্যোগ জরুরি। ‘অনেকে বলছেন বর্তমান উপদেষ্টা পরিষদে চারজন অর্থনীতিবিদ রয়েছেন। তারপরও কেন গতানুগতিক বাজেট হলো। আমি মনে করি উপদেষ্টা পরিষদের সবাই অর্থনীতিবিদ হলেও ব্যতিক্রম কিছু হতো না। কারণ বড় কোনো সিদ্ধান্ত নিতে হলে যে সাহস দেখাতে হয়, সেটির জন্য রাজনৈতিক উদ্যোগ প্রয়োজন।’
বিটিএমএ সভাপতি শওকত আজিজ রাসেল বলেন, ‘আমরা অনেক অস্বস্তিকর সময় পার করছি। বর্তমানে আমরা দেখছি খুব সুন্দর সুন্দর মডেল তৈরি হচ্ছে। এর মধ্যে একটা মডেল হচ্ছে, কেউ লুট করলে বাংলাদেশ ব্যাংক সেই লুটের টাকা আবার ব্যাংকে পৌঁছে দিয়ে আসে। ব্যাংকগুলো লুট করেছে, আর আমরা তার ক্ষতিপূরণ দিচ্ছি চড়া সুদহার দিয়ে। আমার থেকে আপনি (সরকার) বাড়তি টাকা নিয়ে এই চুরির টাকার ভর্তুকি দেবেন, এটা হয় না।’ তিনি বলেন, ‘এখন পর্যন্ত একটা ব্যাংকের কর্মকর্তার শাস্তি হয়নি, একজন গ্রাহকেরও (দোষী) জেল হয়নি। কারণ, যার কাছে টাকা, যে যত বড় চোর, সে তত বড় স্বচ্ছ।’
মূল প্রবন্ধে ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেট আকারে ব্যতিক্রম। এটি চলতি অর্থবছরের বাজেটের তুলনায় ছোট। বাজেটে প্রবৃদ্ধির পরিবর্তে সামগ্রিক উন্নয়নে এবং ভৌত অবকাঠামোর পরিবর্তে মানুষের ওপর অগ্রাধিকার দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু দুঃখজনকভাবে, এসব লক্ষ্যকে বাস্তবায়নের জন্য যথাযথ বাজেট বরাদ্দ বা পদক্ষেপ নেই। বাজেটে কিছু ইতিবাচক উদ্যোগ প্রস্তাব করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে কর ছাড়, বিভিন্ন খাতে বরাদ্দ ও প্রণোদনা এবং ক্ষতিকর কার্যক্রমে উচ্চ কর আরোপ। তবে, প্রস্তাবিত বাজেট সামগ্রিকভাবে চলমান অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জগুলোর মোকাবিলা করতে ব্যর্থ হয়েছে। এই চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করতে পারলে জনগণ ও ব্যবসায়ীদের জন্য স্বস্তি আনতে পারত। অন্যদিকে কিছু রাজস্ব পদক্ষেপ বাজেটের মূল প্রতিপাদ্য ‘একটি সমতাভিত্তিক ও টেকসই অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গঠন’ এর সঙ্গে সাংঘর্ষিক। যেহেতু ২০২৬ অর্থবছরের বাজেট অনুমোদনের পথে। তিনি বলেন সিপিডি বাজেট বাস্তবায়নে দক্ষতার সঙ্গে সম্পাদনের ওপর গুরুত্ব আরোপ করছে। এই প্রেক্ষাপটে, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা বৃদ্ধির জন্য বাজেট বাস্তবায়নের মধ্যমেয়াদি পর্যালোচনা এবং প্রয়োজনীয় সংশোধন করার আহ্বান জানানো হচ্ছে।
ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, এই বাজেট পরোক্ষ করের ওপর নির্ভরশীল। এটি বাজেটের মূল দর্শনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। কারণ বাজেটের লক্ষ্য সম্পদ পুনর্বণ্টন। অর্থাৎ ধনীদের কাছ থেকে কর নিয়ে গরিবদের দেওয়া হবে। কিন্তু পরোক্ষ কর বাড়লে দরিদ্রদের ওপর করের বোঝা চাপে। অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য রাখেন এবি পার্টির সাধারণ সম্পাদক ব্যারিস্টার ফুয়াদ আব্দুল্লাহ এবং ব্যবসায়ী নেতা শামস মাহমুদ।
