Logo
Logo
×

শেষ পাতা

জনতার মঞ্চ থেকে সিইসি

নির্বাচন ব্যবস্থা আইসিইউতে নেন কেএম নূরুল হুদা

Icon

যুগান্তর প্রতিবেদন

প্রকাশ: ২৪ জুন ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

নির্বাচন ব্যবস্থা আইসিইউতে নেন কেএম নূরুল হুদা

সাবেক সিইসি কেএম নূরুল হুদা। ফাইল ছবি

জাতীয় সংসদ এবং স্থানীয় সরকার নির্বাচন ব্যবস্থা চরম বিতর্কিত করেন সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কেএম নূরুল হুদা। তার আমলে ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত একাদশ সংসদ নির্বাচনে অস্বাভাবিক হারে ভোট পড়ে। ১০৩টি আসনের ২১৩টি ভোটকেন্দ্রে শতভাগ ভোট পড়ে। অর্থাৎ এসব ভোটকেন্দ্রের আওতাভুক্ত এলাকায় মৃত ও প্রবাসীরাও ভোট দেন। ১ হাজার ২০৫টি কেন্দ্রে ভোট পড়ে ৯৬ থেকে ৯৯ শতাংশ, যা অস্বাভাবিক।

একইভাবে স্থানীয় সরকার নির্বাচনও ছিল বিতর্কিত। ২০১৯ সালের উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় চেয়ারম্যান হন ১১১ জন। আর ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে বিভিন্ন পদে দুই হাজার জনপ্রতিনিধি ভোট ছাড়াই নির্বাচিত হন। ওই নির্বাচনে সহিংসতায় শতাধিক মানুষের মৃত্যু হয়। তবে এই সহিংসতার জন্য প্রার্থী ও তাদের সমর্থকদের দায়ী করে নূরুল হুদা একাধিকবার বলেছিলেন, এখানে ইসির কোনো দায় নেই। অথচ তারই সহকর্মী নির্বাচন কমিশনার প্রয়াত মাহবুব তালুকদার বলেছিলেন, প্রকৃতপক্ষে নির্বাচন এখন আইসিইউতে। বিতর্কিত নির্বাচন আয়োজনের দায়ে কেএম নূরুল হুদার বিরুদ্ধে রোববার মামলা করেছে বিএনপি। এদিন রাতে ‘জনতা’ তাকে আটক করে পুলিশে দেয়। আদালত তার চার দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন।

২০১৭ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি দায়িত্ব নেয় কেএম নূরুল হুদার নেতৃত্বাধীন পাঁচ সদস্যের নির্বাচন কমিশন। এই কমিশনের সদস্যরা হলেন প্রয়াত মাহবুব তালুকদার, রফিকুল ইসলাম, কবিতা খানম ও শাহাদাত হোসেন চৌধুরী। গঠনের পর থেকেই এই কমিশন নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে বিতর্ক ছিল। শুরুতে বিতর্কের কেন্দ্রে ছিলেন সিইসি কেএম নূরুল হুদা। তার কর্মজীবনের অভিজ্ঞতা এবং কুমিল্লার জেলা প্রশাসক থাকাকালে আওয়ামী লীগ-সমর্থিত ‘জনতার মঞ্চের’ সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলেন। বিএনপির সময়ে চাকরি হারানোর জের তুলেন সিইসির দায়িত্বে থাকার সময়ে। ২০২২ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত দায়িত্বে ছিলেন তিনি।

কেএম নূরুল হুদার সময়ে মূলত জাতীয় নির্বাচনের আগে ২০১৮ সালের ১৫ মে গাজীপুর ও খুলনা সিটি নির্বাচন নিয়ে বিভিন্ন অনিয়মের অভিযোগ উঠতে শুরু করে। জাতীয় নির্বাচনের আগে খুলনা, রাজশাহী, বরিশাল, গাজীপুর সিটি নির্বাচনে বিরোধী দলের প্রার্থী ও কর্মী, ভোটার এবং গণমাধ্যমকর্মীদের নানাভাবে চাপে রেখে নিয়ন্ত্রিত নির্বাচন করার প্রবণতা দেখা গিয়েছিল। প্রতিদ্বন্দ্বী মেয়র প্রার্থীর এজেন্টদের বের করে দেওয়া, সরকারি দলের প্রার্থীর পক্ষে বুথ দখল করে ব্যালটে সিল মারা, পুলিশের বাড়াবাড়ি বা পক্ষপাতমূলক ভূমিকা নিয়ে বিরোধী পক্ষগুলোর নানা অভিযোগ ছিল। কিন্তু ইসিকে কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি। তার সিইসি থাকাবস্থায় রাজনীতির সঙ্গে সেভাবে সম্পৃক্ততা না থাকলেও একাদশ সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের টিকিটে পটুয়াখালী-৩ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন সিইসির ভাগনে এসএম শাহজাদা।

বিতর্কিত নির্বাচনের খলনায়ক : স্থানীয় সরকার নির্বাচনগুলোর মতো জাতীয় নির্বাচনেও প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর ইসি কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে ব্যর্থ হয়। ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত একাদশ সংসদ নির্বাচনে ভোটের আগের রাতেই ক্ষমতাসীনরা ব্যালট বাক্স ভর্তি করে বলে অভিযোগ তোলে বিএনপিসহ সরকারবিরোধী দলগুলো। পরে ভোটের কেন্দ্রভিত্তিক ফলাফলেও অনেক অসংগতি দেখা যায়।

ভোটের পর সাধারণত কেন্দ্রভিত্তিক ফলাফল প্রকাশ করা হয়। কিন্তু একাদশ সংসদ নির্বাচনের কেন্দ্রভিত্তিক ফল প্রকাশ করা হয় প্রায় ছয় মাস পর। তাতে দেখা যায়, ১০৩টি আসনের ২১৩টি ভোটকেন্দ্রে শতভাগ ভোট পড়ে। ১ হাজার ২০৫টি কেন্দ্রে ভোট পড়ে ৯৬ থেকে ৯৯ শতাংশ। ৯০ থেকে ৯৫ শতাংশ ভোট পড়েছে ৬ হাজার ৪৮৪টি কেন্দ্রে। আর ৮০ থেকে ৮৯ শতাংশ ভোট পড়েছে এমন কেন্দ্রের সংখ্যা ১৫ হাজার ৭১৯। অন্যদিকে ১১টি কেন্দ্রে ভোট পড়েছে ১০ শতাংশের কম। ২০টি কেন্দ্রে ১০ থেকে ১৯ শতাংশ ভোট পড়েছে। আর ২০ থেকে? ৩৯ শতাংশ ভোট পড়েছে ৩০১টি ভোটকেন্দ্রে।

নির্বাচনের ৫০টি আসনের নির্বাচনি প্রক্রিয়ার ওপর এক পরিবীক্ষণের ফলাফলে ৪৭টিতেই অনিয়মর প্রমাণ পায় ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। এর মধ্যে ৩৩টি আসনে নির্বাচনের আগের রাতে ব্যালটে সিল মারা হয়েছে বলে তাদের প্রতিবেদনে বলা হয়। ২০১৯ সালের ১৫ জানুয়ারি টিআইবি তাদের এ-সংক্রান্ত গবেষণা প্রতিবেদনটি প্রকাশ করেছিল।

শতভাগ ভোট পড়া অস্বাভাবিক মনে করলেও রাতের ভোট ‘অভিযোগ আকারেই থেকে গেছে’ বলে মন্তব্য করেন সিইসি নূরুল হুদা। দিনের ভোট রাতে হওয়ার অভিযোগ নিয়ে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেছিলেন, অভিযোগের ওপর ভিত্তি করে আমি কনক্লুসিভ কিছু বলতে পারি না। কারণ, আমি তো দেখিনি। আপনিও দেখেননি যে রাতে ভোট হয়েছে। তদন্ত হলে বেরিয়ে আসত, বেরিয়ে এলে আদালতের নির্দেশে নির্বাচন বন্ধ হয়ে যেত। সারা দেশের নির্বাচনও বন্ধ হয়ে যেতে পারত। রাজনৈতিক দলগুলো কেন আদালতে অভিযোগ দেয়নি, সেটা তাদের বিষয়। এ সুযোগ তারা হাতছাড়া করেছে।

কেএম নূরুল হুদা কমিশনের বিরুদ্ধে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানে গুরুতর অসদাচরণ, আর্থিক অনিয়মসহ ৯টি সুনির্দিষ্ট অভিযোগ এনে তা তদন্তের জন্য সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠনের দাবি জানিয়ে ২০২০ সালের ১৪ ডিসেম্বর রাষ্ট্রপতিকে চিঠি দেন ৪২ জন বিশিষ্ট নাগরিক। একই বছরের ১৭ জানুয়ারি তারা এ বিষয়ে আরেকটি চিঠি দেন রাষ্ট্রপতিকে। ওই অভিযোগ নিয়ে কোনো পদক্ষেপ নেয়নি পতিত আওয়ামী লীগ সরকার।

কমিশনে মতবিরোধ : কেএম নূরুল হুদা তার সহকর্মী কমিশনারদের সঙ্গেও মতবিরোধে জড়িয়েছিলেন। কমিশন শপথ নেওয়ার পাঁচ মাসের মাথায় ২০১৭ সালের জুলাইয়ে ইসি সচিবালয়ের ৩৩ জন কর্মকর্তার বদলি নিয়ে সিইসি নূরুল হুদা ও নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদারের মধ্যে বিরোধ প্রথম প্রকাশ্যে আসে। এরপর জাতীয় নির্বাচনে সেনা মোতায়েন, সিটি নির্বাচনে সংসদ-সদস্যদের প্রচারের সুযোগ দেওয়া, ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) ব্যবহারসহ বিভিন্ন বিষয়ে ইসির মতবিরোধ প্রকাশ্যে আসে। বরিশাল সিটি করপোরেশন নির্বাচন নিয়েও কমিশনে মতবিরোধ তৈরি হয়েছিল। এসব ক্ষেত্রে মূলত মতবিরোধ দেখা গেছে নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদারের সঙ্গে অন্য কমিশনারদের। মেয়াদের শেষে এসেও মাহবুব তালুকদারের শারীরিক অসুস্থতা নিয়ে গণমাধ্যমে বিরূপ বক্তব্য দিতে দ্বিধা করেননি কেএম নূরুল হুদা।

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম