মুরাদনগরে বিবস্ত্র করে নির্যাতন
সমালোচনার মধ্যেই ছড়াল নতুন ভিডিও
পৈশাচিক নির্যাতন চালায় ছাত্রলীগ নেতা সুমন * চারজনের সাত দিনের রিমান্ডের আবেদন * মামলা নয়, সন্তানদের নিয়ে শান্তি চান সেই নারী
কুমিল্লা ব্যুরো
প্রকাশ: ০১ জুলাই ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
কুমিল্লার মুরাদনগরে ধর্ষণ, বিবস্ত্র করে নির্যাতন, ভিডিও ধারণ ও তা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়া নিয়ে দেশব্যাপী তোলপাড় চলছে। ক্ষোভে ফুঁসছে দেশ, জানাচ্ছে প্রতিবাদ। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে সেই ভিডিও ও ছবি ডিজিটাল প্ল্যাটফরম থেকে সরিয়ে ফেলার জন্য রোববারই নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। এরই মধ্যে সোমবার লোমহর্ষক নির্যাতনের আরেকটি ভিডিও ছড়িয়ে পড়েছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। ওই ভিডিওতে দেখা যায়, ইউনিয়ন (রামচন্দ্রপুর দক্ষিণ) ছাত্রলীগের সভাপতি মুহাম্মদ আলী সুমনের নেতৃত্বে রমজান, অনিক, আরিফসহ ১৫-২০ জন ধর্ষক ফজর আলীকে পৈশাচিক কায়দায় নির্যাতন করছে। পাশাপাশি সেই নারীকে বিবস্ত্র করে দুজনকে একত্র করে হাত-পা বাঁধছে।
ওই ঘটনায় পর্নোগ্রাফি আইনের মামলায় গ্রেফতার চারজনের সোমবার রিমান্ড চেয়েছে পুলিশ। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা মুরাদনগর থানার এসআই রুহুল আমিন বলেন, ‘দুপুরে বিচারিক হাকিম মুরাদনগর আমলি আদালতে আসামিদের হাজির করে সাত দিনের রিমান্ড আবেদন করা হয়। তবে এখনো আদালত থেকে কোনো আদেশ পাইনি। কাল (আজ) পেতে পারি। আপাতত তাদের জেলহাজতে পাঠানো হয়েছে।’ তিনি আরও বলেন, ধর্ষণ মামলার আসামি ফজর আলী এখনো হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকায় তাকে আদালতে হাজির করা যায়নি।
এ ছাড়া মামলার তদন্ত কাজে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন পুলিশের কর্মকর্তারা। পাশাপাশি সিআইডি, র্যাব, সেনাবাহিনীর সদস্যরাও ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। এদিকে নির্যাতনের শিকার ওই নারী সোমবার আবারও বলেছেন, মামলা-মোকদ্দমা নয়, এলাকায় সবার সঙ্গে মিলেমিশে শান্তিতে থাকতে চান তিনি। সোমবার ওই নারীর খোঁজ নিতে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীসহ সামাজিক সংগঠনের কর্মীরা এলে তাদের কাছে একই কথা পুনর্ব্যক্ত করেন তিনি।
বৃহস্পতিবার রাতে রামচন্দ্রপুর দক্ষিণ ইউনিয়নের বাহেরচর গ্রামে এক সংখ্যালঘু নারীকে ধর্ষণের অভিযোগ ওঠে। স্থানীয়রা বিষয়টিকে পরকীয়া দাবি করলেও সেই নারী জানান ফজর আলীর সঙ্গে আর্থিক লেনদেনের সম্পর্ক রয়েছে। ধর্ষণ নির্যাতন ও ভিডিও ছড়ানোর ঘটনায় পুলিশ পৃথক দুই মামলায় ছাত্রলীগ নেতা মুহাম্মদ আলী সুমনসহ পাঁচজনকে গ্রেফতার করেছে।
স্থানীয়রা জানান, সোমবার নতুন ভিডিওচিত্র প্রকাশ করা হয় ‘তোদের বাপ আইছে’ নামের একটি ফেসবুক আইডি থেকে। ভিডিওটি স্থানীয় নুর মোহাম্মদসহ বেশ কয়েকজন শেয়ার করে। এতে দেখা যায়, সুমনের নেতৃত্বে ১৫-২০ জন ফজর আলীকে বেধড়ক পেটাচ্ছে। বিবস্ত্র করে বেঁধে নির্যাতনের পর তার শরীর, হাত ও মাথা থেকে রক্ত ঝরছে। সুমন নিজেও ফজর আলীকে পৈশাচিক কায়দায় নির্যাতন করছে। সুমনের সহযোগী অনিক ওই নারীকে বিবস্ত্র করছে। পাশে থেকে রমজানসহ অন্যরা এসব ভিডিও ধারণ করছে। নতুন ভিডিও দেখে এলাকায় সমালোচনার মাত্রা তীব্র হয়েছে। রামচন্দ্রপুর দক্ষিণ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান গোলাম কিবরিয়া খোকন বলেন, এটা দীর্ঘদিনের পরকীয়ার সম্পর্ক। এলাকার সবাই জানে। দুই মাস আগে ফজর আলীর ছোট ভাই শাহপরান ওই নারীর সাথে তার ভাইয়ের পরকীয়া নিয়ে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছিল। তাছাড়া ওই পরিবারের সাথে ফজর আলীর আর্থিক লেনদেন রয়েছে। সেই সুবাদে তাদের নিয়মিত আসা-যাওয়া ছিল। তবে ঘটনাটিকে এতবড় করার কারিগর হচ্ছে ইউনিয়ন ছাত্রলীগ সভাপতি মুহাম্মদ আলী সুমন। তারা ওঁৎ পেতে থেকে দুজনকে ধরেছে। পরে পরিকল্পিতভাবে বিবস্ত্র এবং নির্যাতন করে এসব ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল করেছে। ছাত্রলীগ নেতার নেতৃত্বে ওই চক্রটি ভিন্ন কোনো উদ্দেশ্যে এ কাজ করে থাকতে পারে।
বাহেরচর এলাকার সাবেক ইউপি সদস্য আব্দুর রউফ বলেন, ফজর আলী একটা খারাপ লোক। এলাকায় বিভিন্ন নারীর পেছনে ঘুরে ঘুরে অপকর্ম করাই তার কাজ। গ্রামের অধিবাসী পেয়ারা বেগম বলেন, ফজর আলী ও ওই নারীকে হাতেনাতে ধরার জন্যই সেদিন রাতে ওঁৎ পেতে বসেছিল সুমন, রমজান ও অনিকরা। ফজর আলীর ভাই শাহ পরানের সাথেও ভিকটিমের সুসম্পর্ক রয়েছে। এটি তাদের একটি পারিবারিক সম্পর্ক।
ইউপি সদস্য আব্দুল করিম বলেন, ফজর আলীকে আটক করে শায়েস্তা করাই ছিল তাদের মূল লক্ষ্য। সেদিন রাতে ফজর আলীকে পৈশাচিক নির্যাতন করে গুরুতর আহত করা হয়। তাদের পরকীয়ার বিষয়টি এলাকার সবারই জানা। যেহেতু ধর্ষণের অভিযোগে মামলা হয়েছে, সে মামলায় তার শাস্তি হওয়া দরকার। পাশাপাশি ঘটনার হোতা সুমন ও তার সহযোগীদেরও উপযুক্ত শাস্তি হওয়া দরকার।
ভিকটিম নারী বলেন, আমি না বুঝেই ফজর আলীর বিরুদ্ধে মামলাটি করেছি। পরিবার ও এলাকার কারও সাথে পরামর্শ ছাড়াই মামলা করে আমি এখন আমার স্বামীর চাপের মুখে আছি। স্বামী এবং আমার পরিবারের লোকজন মামলা চালাতে অনীহা প্রকাশ করছে। আমি আমার সন্তানদের নিয়ে শান্তিতে থাকতে চাই। কারও বিরুদ্ধে মামলা মোকদ্দমা ভালো লাগে না। আমি মামলাটি তুলে ফেলব।
মুরাদনগর থানার ওসি জাহিদুর রহমান বলেন, নতুন কোনো ভিডিও এখনো আমাদের দৃষ্টিগোচর হয়নি। ভিকটিম মামলা তুলে নিতে চায়-সেটা মনে হয় সঠিক নয়। আমরা মামলা নিয়ে কাজ করছি। সিনিয়র অফিসাররা তা তদারকি করছেন। নতুন ভিডিও হাতে পেলে তা খতিয়ে দেখা হবে। পাশাপাশি ভাইরালের সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। তিনি বলেন, পুলিশের পাশাপাশি র্যাব, সিআইডি, পিবিআই, সেনাবাহিনীসহ গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তারা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। প্রত্যেকেই তাদের জায়গা থেকে মামলাটি নিয়ে কাজ করছেন।
