নওহাটা পৌরসভার ১০ রাস্তা সংস্কার
কাজ না করলেও ২০ কোটি টাকার সিংহভাগ পরিশোধ
তানজিমুল হক, রাজশাহী
প্রকাশ: ০৫ জুলাই ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
ছবি: সংগৃহীত
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
রাজশাহীর নওহাটা পৌরসভায় ২০ কোটি টাকা ব্যয়ে ১০টি রাস্তা নির্মাণ ও সংস্কারকাজে তৈরি হয়েছে চরম অচলাবস্থা। তিন দফা মেয়াদ বাড়িয়েও কাজ শেষ করতে পারেনি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। কাজের অগ্রগতি না থাকলেও তিন দফায় সাড়ে ১৪ কোটি টাকা বিল পরিশোধ করেছে পৌরসভা। অভিযোগ উঠেছে নিুমানের সামগ্রী দিয়ে নির্মাণ ও সংস্কারকাজের।
ইতোমধ্যে একটি রাস্তার সুরক্ষা দেওয়াল (প্রটেকশন ওয়াল) ৩০ মিটার ভেঙে পুকুরের মধ্যে নেমে গেছে। বেড়েছে জনভোগান্তি। কাজ শেষ না করেই সিংহভাগ বিল পরিশোধ করায় পৌরবাসীর মধ্যে তীব্র ক্ষোভ ও অসন্তোষ দেখা দিয়েছে। তবে পৌর কর্তৃপক্ষের বক্তব্য, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে কাজ শেষ করতে গত মে মাসে সর্বশেষ এক মাস সময় দেওয়া হয়। তবে তারা ব্যর্থ হয়েছে। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটি কাজ শেষ করতে না পারলে জামানত বাজেয়াপ্ত করা হবে। প্রয়োজনে নতুন ঠিকাদার নিয়োগ দিয়ে বাকি কাজ শেষ করা হবে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, পৌরসভা এলাকায় রাস্তা নির্মাণ ও সংস্কারের কাজটি করছে জুয়েল ইলেকট্রনিক্স নামের একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। এটির স্বত্বাধিকারী রাজশাহী মহানগরীর উপকণ্ঠ ভুগরইলের বাসিন্দা ওয়াশিমুল হক। কার্যাদেশ দেওয়া হয় ২০২৩ সালের ১১ ডিসেম্বর। শেষ করার মেয়াদ ছিল পরের এক বছর। কিন্তু শেষ না হলে দ্বিতীয় দফায় আরও এক বছর মেয়াদ বৃদ্ধি করা হয়। সর্বশেষ ২৭ মে তৃতীয় দফায় এক মাস সময় দেওয়া হয়। কিন্তু দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি হয়নি।
এদিকে পৌরসভার দুয়ারি থেকে পাকুড়িয়া স্কুল পর্যন্ত আড়াই কিলোমিটার রাস্তার একটি অংশে ৩০ মিটার সুরক্ষা দেওয়াল ভেঙে গেছে। দেওয়ালটির অর্ধেকের বেশি অংশ পুকুরের মধ্যে নেমে যায়। ফলে কয়েক হাজার মানুষ চলাচলে ভোগান্তিতে পড়েন। পরে পবা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার হস্তক্ষেপে বালু ও মাটি ফেলে রাস্তাটি সাময়িকভাবে চলাচলের উপযোগী করা হয়। অথচ নতুন এক কিলোমিটার রাস্তা নির্মাণ এবং আড়াই কিলোমিটার সংস্কারে বরাদ্দ রয়েছে ৬ কোটি ১৭ লাখ ৮ হাজার ৯১৭ টাকা।
স্থানীয় পাকুড়িয়া দক্ষিণপাড়া গ্রামের বাসিন্দা শফিকুল ইসলাম বলেন, শুরু থেকেই রাস্তাটির নির্মাণকাজে নিুমানের সামগ্রী ব্যবহার করা হয়েছে। প্রতিবাদ করলেও ঠিকাদারের লোকজন শোনেননি। উলটো গ্রামের লোকজনকেই চাঁদাবাজি মামলায় ফাঁসানোর হুমকি দেওয়া হয়েছে। এ কারণে কেউ আর মুখ খোলার সাহস পাননি। বুধ ও বৃহস্পতিবার সরেজমিন দেখা যায়, বাগধানি এলাকায় একটি ৫০০ মিটার রাস্তার কাজের কোনো অগ্রগতি হয়নি। রাস্তাটির সংস্কার এক বছর আগে শুরু হয়। পুরোনো রাস্তার উপরের অংশ তুলে ফেলার কারণে নিচু হয়ে বৃষ্টির পানি জমেছে। খোদ পৌর কর্তৃপক্ষ বলছে, কাজটিতে বরাদ্দ রয়েছে প্রায় অর্ধকোটি টাকা। শেষ হয়েছে মাত্র ৫০ শতাংশ।
এলাকার বাসিন্দা আরিফুল ইসলামের বক্তব্য, দেড় মাস ধরে বৃষ্টি হচ্ছে। সামান্য বৃষ্টিতেই রাস্তাটি ডুবে যাচ্ছে। মানুষ চলাফেরা করতে পারছে না। হালকা যানবাহনও এ রাস্তায় আসতে চায় না। এ কারণে মহল্লার মানুষ চরম ভোগান্তির মধ্যে পড়েছেন।
পৌরসভার আলাই বিদিরপুর থেকে ওই এলাকার নদীর বাঁধ পর্যন্ত সাড়ে সাতশ মিটার রাস্তা কেবল ইটের খোয়া ফেলে রোলিং করা হয়েছে। এ কাজটিতে বরাদ্দ রয়েছে ১ কোটি ৩১ লাখ ৩ হাজার টাকা। ভারি বৃষ্টিপাতের কারণে ইতোমধ্যে খোয়া উঠে গেছে। সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারের ম্যানেজার ইউনূস স্বীকার করেছেন, ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও তারা রাস্তাটির কাজ শেষ করতে পারেননি।
স্থানীয় বাসিন্দা শরিফুল ইসলাম বলেন, খানাখন্দে ভরা রাস্তাটি চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। এলাকার মানুষ সীমাহীন ভোগান্তির মধ্যে রয়েছেন। কয়েকবার পৌরসভায় যোগাযোগ করা হয়েছে। কিন্তু প্রতিকার নেই। এছাড়া পিল্লাপাড়া জামে মসজিদ এলাকায় সাড়ে পাঁচশ মিটার, পুঠিয়াপাড়া আনসার ক্যাম্প ও এর পার্শ্ববর্তী এলাকায় দুই কিলোমিটার, বসন্তপুর সিরাজের মোড় থেকে রসুলপুর পশ্চিমপাড়া পর্যন্ত পাঁচশ মিটার, চৌবাড়িয়া হতে এ এলাকার শেষ সীমান্ত পর্যন্ত প্রায় দুই কিলোমিটার, পাকুড়িয়া বটতলার মোড় থেকে পাকুড়িয়া প্রাইমারি স্কুল পর্যন্ত ১ হাজার ৩০০ মিটার, বায়াহাট থেকে বালিয়াডাঙা জলিলের বাড়ি পর্যন্ত ১ হাজার ১০০ মিটার এবং বারুইপাড়া মোড় থেকে আরশেদের বাড়ি পর্যন্ত ৫০০ মিটার রাস্তার কাজেরও অগ্রগতি নেই।
সরেজমিন দেখা যায়, এসব কাজের ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ শেষ হয়েছে। ১০টি রাস্তার প্রতিটিতে সড়কবাতি স্থাপনের জন্য বরাদ্দ রয়েছে। তবে এখন পর্যন্ত কোনো রাস্তায়ই সড়কবাতির পোল স্থাপন করা হয়নি। অথচ পৌর কর্তৃপক্ষ তিন দফায় ১৪ কোটি ৪৪ লাখ ৪৯ হাজার টাকা পরিশোধ করেছে।
এদিকে দ্রুত কাজ শেষ করতে তাগিদ দেওয়ার জন্য ২৭ মে পৌর কর্তৃপক্ষ এবং ঠিকাদারের প্রতিনিধির মধ্যে বৈঠক হয়েছে। পৌর প্রকৌশল বিভাগের প্রধান নির্বাহী প্রকৌশলী শিব্বির আহমেদ আজমি এবং ঠিকাদারের প্রতিনিধি বাবু লালসহ সংশ্লিষ্টরা বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন। কাজ শেষ করার জন্য বৈঠকে এক মাসের সময়সীমা বেঁধে দেওয়া হয়। তবে এক মাসেও এ কাজ শেষ করতে পারেনি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। এ ব্যাপারে ঠিকাদারের প্রতিনিধি বাবু লাল বলেন, কিছু সীমাবদ্ধতার কারণে আমরা কাজ করতে পারছি না। আবারও সময়সীমা বৃদ্ধির জন্য আবেদনের প্রস্তুতি নিচ্ছি।
নির্বাহী প্রকৌশলী শিব্বির আহমেদ আজমি বলেন, আমরা তিন দফা সময় দিলেও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটি কাজ শেষ করতে পারেনি। ঠিকাদারের এক কোটি টাকা কার্যসম্পাদন জামানত (বিডি) জমা রয়েছে। প্রয়োজনে কাজ বাতিল করে সেটি সরকারি কোষাগারে জমা দেওয়া হবে। পুনরায় টেন্ডার দিয়ে নতুন ঠিকাদারের মাধ্যমে বাকি কাজ শেষ করা হবে। কাজের অগ্রগতি সন্তোষজনক না হওয়ার পরও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে সিংহভাগ বিল প্রদান প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বিল বেশি দেওয়া হলে সে ব্যাপারে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান জুয়েল ইলেকট্রনিক্সের স্বত্বাধিকারী ওয়াসিমুল হক বলেন, রাস্তার কাজের শুরু থেকেই স্থানীয়দের সঙ্গে জমি নিয়ে কিছু বিরোধ ছিল। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে অগ্রিম বৃষ্টিপাত। সময় দেওয়ার জন্য পৌর কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ করেছি। সময় পেলে আমরা দ্রুত বাকি কাজ শেষ করব।
