Logo
Logo
×

শেষ পাতা

২৪ ঘণ্টায় ২০৪ ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি

বেশি ঝুঁকিতে শিশু ও বয়স্করা

চলতি বছর ১ থেকে ১৫ বছর বয়সি ২,৪৫৫ শিশু ডেঙ্গু নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি

Icon

জাহিদ হাসান

প্রকাশ: ০৫ জুলাই ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

বেশি ঝুঁকিতে শিশু ও বয়স্করা

ছবি: সংগৃহীত

দেশে এপ্রিল থেকে অক্টোবর মাস পর্যন্ত ভাইরাসজনিত জ্বরের প্রকোপ বেশি থাকে। চলতি মৌসুমেও বিভিন্ন বয়সি নারী-পুরুষ জ্বরে আক্রান্ত হচ্ছেন। এর সঙ্গে ভাইরাল ফিভার, করোনা ও চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত হচ্ছেন অনেকে। তবে ডেঙ্গুতে বেশি ঝুঁকিতে পড়ছেন শিশু ও বয়স্করা। বৃহস্পতিবার সকাল থেকে শুক্রবার সকাল ৮টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গুজ্বর নিয়ে ২০৪ জন বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। তাদের মধ্যে ৪১ জনই এক থেকে ১৫ বছর বয়সি। চলতি বছরে ডেঙ্গু নিয়ে দুই হাজার ৪৫৫ জন এই বয়সি শিশু-কিশোর হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন।

চিকিৎসা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জ্বর কোনো রোগ নয়; এটি রোগের একটি উপসর্গ। জ্বর হওয়াকে কোনো রোগের সতর্কবার্তা বলা যেতে পারে। তবে ডেঙ্গুজ্বরের প্রথম লক্ষণ দেখা দেওয়ার ৩-৭ দিনের মধ্যে অনেকে সংকটাপন্ন অবস্থায় চলে যেতে পারেন। জ্বর ভালো হওয়ার ২৪-৪৮ ঘণ্টা পর রক্তচাপ কমে রোগী শকে চলে যেতে পারে। ডেঙ্গু শক সিনড্রোম হয়ে লিভার, কিডনি, ফুসফুস, ব্রেন ড্যামেজের লক্ষণ শুরু হতে পারে। ইন্টারনাল ব্লিডিং হতে পারে। বেশি ঝুঁকি দেখা দিতে পারে শিশু, বয়স্ক ও দীর্ঘমেয়াদি রোগাক্রান্তদের। তাই জ্বর হলেই রোগ নির্ণয়সহ নিয়মিত ফলোআপ চিকিৎসা নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন চিকিৎসকরা।

ডেঙ্গু সংক্রমণের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, গত বছরের ডেঙ্গুর ঢেউ এ বছরের জানুয়ারি পর্যন্ত ছিল। জানুয়ারিতে এক হাজার ১৬১ জন ডেঙ্গু নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়। ফেব্রুয়ারি-মার্চে কিছুটা কমলেও এপ্রিল থেকে লাফিয়ে বাড়ছে। এপ্রিলে ৭০১, মে’তে এক হাজার ৭৭৩, জুনে ৫৯৬১ এবং জুলাইয়ে চার দিনেই ভর্তির সংখ্যা এক হাজার ৩৬৪ জনে দাঁড়িয়েছে। শুক্রবার পর্যন্ত ডেঙ্গু নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি ১১ হাজার ৬৬০ জনে দাঁড়িয়েছে। আর মৃত্যু হয়েছে ৪৫ জনের।

জাতীয় প্রতিষেধক ও সামাজিক চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান’ (নিপসম)-এর কীটতত্ত্ব বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ড. মো. গোলাম ছারোয়ার যুগান্তরকে বলেন, এবার ডেঙ্গু শুধুমাত্র এডিস ইজিপ্টাই মশার কামড়েই ছড়াচ্ছে না, এডিস অ্যালবোপিক্টাস মশার কামড়েও হচ্ছে। গত বছর মশার লার্ভার মৌসুম জরিপে দেখা গেছে শহরে এডিস মশার ৯৯ শতাংশই এডিস ইজিপ্টাই এবং গ্রামাঞ্চলে ৯৫ শতাংশ এডিস এলবোপিক্টাস। শহর-গ্রাম সবখানেই ডেঙ্গুর জীবাণুবাহী এডিস মশার লার্ভার ঘনত্বের পরিমাণ নির্দিষ্ট মানদণ্ডের চেয়ে বেশি পাওয়া যাচ্ছে। বিশেষ করে ঢাকা ও চট্টগ্রাম ডেঙ্গুর প্রধান বাহক এডিস ইজিপ্টাই মশা এবং বরিশালসহ বিভিন্ন এলাকায় এডিস অ্যালবোপিক্টাস মশা বেশি দেখা যাচ্ছে। শহরাঞ্চলে কমবেশি লার্ভিসাইড ও এডাল্টিসাইড স্প্রে হলেও গ্রামাঞ্চলে নিয়মিত হচ্ছে না।

জ্বর নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি রোগীদের বিষয়ে চিকিৎসকরা বলেন, ঠাণ্ডা বা সর্দি-কাশিতে বেশি জ্বর হয়। শরীরের ভেতরে কোনো কারণে ব্যাকটেরিয়া বা ভাইরাসের সংক্রমণ হলেও জ্বর হতে পারে। তবে এডিস মশার কামড়ে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী বিশেষ করে, শিশু, বয়স্ক ও দীর্ঘমেয়াদি রোগাক্রান্তদের শারীরিক জটলতা দেখা দিতে পারে। যথাসময়ে সঠিক চিকিৎসা না হলে রোগীর মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে।

শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের শিশু বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. এএসএম মাহমুদুজ্জামান যুগান্তরকে বলেন, শিশুর জ্বরের সঙ্গে তীব্র মাথাব্যথা, চোখের পেছনে ব্যথা, হাড় বা মাংসে ব্যথা বা শরীরে মারাত্মক ব্যথা, বমি ভাব বা বমি করা, চামড়ায় ফুসকুড়ি, চুলকানি, লাল লাল দাগ, খাবারে অরুচি ও ডায়রিয়া এগুলোর মধ্যে যে কোনো ২-৩টি লক্ষণ থাকলেই ডেঙ্গু সন্দেহ করতে হবে। সতর্কসংকেত হলো- তীব্র পেট ব্যথা, ক্রমাগত বমি (দিনে তিনবার বা তার চেয়ে বেশি), দাঁতের মাড়ি থেকে রক্তপাত, চোখে রক্ত জমাট, রক্তবমি, কালো পায়খানা, শ্বাসকষ্ট বা পেটে ভারী বোধ করা, টেস্টে পিসিভি (হেমাটোক্রিট) বেড়ে যাওয়া ও রক্তের প্লাটিলেট দ্রুত কমতে থাকা। লক্ষণগুলো থাকলে রোগীকে অবশ্যই হাসপাতালে ভর্তি করাতে হবে। তিনি আরও বলেন, ডেঙ্গুজ্বরের প্রথম লক্ষণ দেখা দেওয়ার ৩-৭ দিনের মধ্যে কেউ সংকটাপন্ন অবস্থায় চলে যেতে পারেন। ফলে জ্বর কমে যাওয়া মানেই সেরে যাওয়া নয় বরং এটা হতে পারে শেষের শুরু। জ্বর ভালো হওয়ার ২৪-৪৮ ঘণ।টা পরই বরং রক্তচাপ কমতে কমতে রোগী শকে চলে যেতে পারে। ডেঙ্গুতে সাধারণত জ্বর ছেড়ে যাওয়ার পর ভয়টা বেশি। তখন প্লাজমা লিকেজ হয়ে রোগী শকে চলে যেতে পারে। তখন রক্তের ঘনত্ব বাড়তে থাকে। কখনো পেটে, বুকে পানি জমে। সেই সঙ্গে প্লাটিলেট কমতে শুরু করে। কেউ দ্বিতীয়, তৃতীয়বারের মতো ডেঙ্গু আক্রান্ত হলে সেক্ষেত্রে শক ও রক্তপাতের ঝুঁকি বেশি হয়। 

রোগতত্ত্ববিদরা বলেন, ডেঙ্গুতে শিশু, বয়স্ক থেকে শুরু করে সবারই শক সিন্ড্রোমের লক্ষণগুলো হলো-অত্যধিক দুর্বলতা, অবসাদ বা অস্থিরতা। রক্তচাপ ডেঙ্গু পূর্ববর্তী অবস্থা থেকে কমে যাওয়া। রোগীর প্রস্রাব কমে যাওয়া ও শ্বাসকষ্ট, দ্রুত শ্বাস-প্রশ্বাস নেওয়া ইত্যাদি। উপসর্গগুলো নজরে রাখতে হবে। এগুলোর এক বা একাধিক লক্ষণ দেখামাত্রই দ্রুত চিকিৎসক বা হাসপাতালে নিতে হবে। জ্বর হলে নিকটস্থ হাসপাতালে চিকিৎসকের পরামর্শে ডেঙ্গু পরীক্ষা করাতে হবে। রিপোর্ট নেগেটিভ হলেও উপসর্গগুলো খেয়াল করতে হবে। কারণ এবার কখনো কখনো পরীক্ষায়ও ডেঙ্গু ধরা পড়ছে না। সেক্ষেত্রে সিবিসি (টোটাল ব্লাড কাউন্ট) রিপোর্টে কম থাকলে প্রয়োজনে আবার পরীক্ষা করাতে হবে।

ইমেরিটাস অধ্যাপক ডা. এবিএম আব্দুল্লাহ যুগান্তরকে বলেন, ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়ার ক্ষেত্রে যাদের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা কম তারা ঝুঁকিপূর্ণ। এক্ষেত্রে শিশু, বয়স্ক, রোগাক্রান্ত ব্যক্তি ডায়াবেটিস, লিভার, কিডনি, হার্টের সমস্যা, ক্যানসার আক্রান্ত ও গর্ভবতীরা বেশি ঝুঁকিতে থাকেন। ফলে ডেঙ্গু ছাড়াও কোনো ধরনের জ্বর বা রোগ যেন না হয় সেদিকে জোর দিতে হবে। আইইডিসিআর উপদেষ্টা ডা. মোশতাক হোসেন বলেন, বয়স কম এবং বেশি উভয়ের জন্যই ডেঙ্গুর সংক্রমণ শারীরিক ঝুঁকি তৈরি করতে পারে। কারণ তাদের অপুষ্টি ও রোগব্যাধি বেশি হয়। তাদের সুরক্ষিত রাখতে ব্যক্তিগত, পরিবারিক, সামাজিক ও সরকারি সব পর্যায়ে ব্যাবস্থা নেওয়া উচিত। ডেঙ্গুর প্রতিকার ও প্রতিরোধে জনগণ ও প্রশাসন সমন্বিতভাবে ঘরে ও বাইরে মশা নির্মূলে কাজ করতে হবে।

২৪ ঘন্টায় আরও ২০৪ রোগী ভর্তি : গত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গুতে কেউ মারা না গেলেও আরও ২০৪ জন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। তাদের মধ্যে বরিশাল বিভাগে (সিটি করপোরেশনের বাইরে) ১০১ জন, চট্টগ্রাম বিভাগে (সিটি করপোরেশনের বাইরে) ৯ জন, ঢাকা বিভাগে (সিটি করপোরেশনের বাইরে) ২২ জন, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ১৯ জন, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ৩৮ জন, ময়মনসিংহ বিভাগে (সিটি করপোরেশনের বাইরে) পাঁচজন, রাজশাহী বিভাগে (সিটি করপোরেশনের বাইরে) ১০ জন রয়েছেন। ২৪ ঘণ্টায় ২৫৪ জন ডেঙ্গুরোগী হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র পেয়েছেন। চলতি বছরে এ পর্যন্ত মোট ১০ হাজার ৩৩৬ জন রোগী হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র পেয়েছেন। চলতি বছরের ভর্তি রোগীদের মধ্যে ৫৯ দশমিক ১ শতাংশ পুরুষ এবং ৪০ দশমিক নয় শতাংশ নারী। 


Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম