Logo
Logo
×

শেষ পাতা

নজরুল-প্রমীলার স্মৃতিধন্য তেওতা

Icon

মতিউর রহমান, মানিকগঞ্জ

প্রকাশ: ০৬ জুলাই ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

নজরুল-প্রমীলার স্মৃতিধন্য তেওতা

যমুনা নদীর পাড়ঘেঁষা মানিকগঞ্জের শিবালয় উপজেলার তেওতা জমিদার বাড়ি। এতে জড়িয়ে আছে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম ও তার পত্নী প্রমীলা দেবীর প্রেমের অমলিন উপাখ্যান। এ বাড়ির পুকুর ঘাট, নাটমন্দির ও নবরত্ন মঠ সবই তাদের অমর প্রণয়ের সাক্ষী। এই জমিদার বাড়ি লাগোয়া ছিল প্রমীলার বাবার বাড়ি। জানা গেছে, পঞ্চদশ শতকের শুরুতে পাচুসেন নামে এক পিতৃহীন যুবক তার সততা ও আন্তরিক চেষ্টায় তামাকের ব্যবসা করে প্রচুর অর্থ-সম্পদের মালিক হন। তিনি দিনাজপুর অঞ্চলে প্রথম জমিদারি ক্রয় করে তার পাচু নাম পরিবর্তন করে পঞ্চনন্দ সেন নাম গ্রহণ করেন। পঞ্চনন্দ সেনের পুত্র শঙ্কর রায় বাহাদুর তৎকালীন নাগপুরের নীলকুঠির ম্যানেজার উডীন সাহেবের কাছ থেকে জায়গা কিনে তেওতা জমিদার বাড়ি প্রতিষ্ঠা করেন।

এ জমিদার বাড়ির নবরত্ন মঠটির শিলালিপি থেকে জানা যায়, এ মঠটি ১৭০২-১৭০৩ খ্রিষ্টাব্দে স্থাপিত। বাড়ির উত্তর দিকের ভবনগুলো নিয়ে হেম শংকর এস্টেট এবং দক্ষিণ দিকের ভবনগুলো নিয়ে জয় শংকর এস্টেট গঠিত। প্রতিটি এস্টেটের সামনের অংশে যে অট্টালিকা আছে তা বর্গাকৃতির এবং এর মাঝখানে আছে দৃষ্টিনন্দন নাট মন্দির। এ মন্দিরে পূজা ও নাচ-গানের আসর হতো। এস্টেটের পূর্বদিকে ছিল অন্দরমহল। দক্ষিণ দিকে ভবনের নিচে ভূগর্ভে আজও একটি চোরা কুঠি রয়েছে, যা এ এলাকায় অন্ধকূপ নামে পরিচিত ছিল। এটি ক্রমান্বয়ে ভরাট হয়ে গেছে। সেখানে এখন সাপ বিচ্ছুর আস্তানা। জমিদার বাড়ির পশ্চিমের সামনের একটি ভবনে রয়েছে দুটি কয়েদখানা। সাধারণ প্রজারা খাজনা দিতে বিলম্ব করলে তাদের এখানে বন্দি করে রাখা হতো। তবে কয়েদখানাটি এখন আর নেই। সেই স্থানটি প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণার জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে। জমিদার বাড়ির সামনে টলমলে দিঘিতে ছিল সানবাঁধানো ঘাট। ঘাটসংলগ্ন প্রায় ৮০ ফুট উচ্চতাবিশিষ্ট নবরত্ন মঠ। চারতলাবিশিষ্ট এই নবরত্নের প্রথম ও দ্বিতীয় তলার চারদিকে ক্ষুদ্রাকৃতির মঠ বা রত্ন রয়েছে। মোট নয়টি রত্ন থাকায় একে নবরত্ন নাম দেওয়া হয়।

বসন্ত কুমার ও তার দ্বিতীয় স্ত্রী গিরিবালা দেবীর একমাত্র সন্তান আশালতা সেনগুপ্ত (প্রমীলা) ১৯০৮ সালে তেওতা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি তেওতায় পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেছেন। বসন্ত কুমার ত্রিপুরায় রাজদরবারে চাকরি করতেন। কাকা ইন্দ্র কুমার ত্রিপুরায় কোর্ট অব ওয়ার্ডসের ইন্সপেক্টর ছিলেন। ইন্দ্র কুমার চাকরি সূত্রে কুমিল্লার কান্দির পাড়ে বাড়িঘর করে পরিবার নিয়ে বসবাস করতেন। হঠাৎ বসন্ত কুমারের মৃত্যুতে আশালতার মা অসহায় হয়ে পড়লে তার কাকা ইন্দ্র কুমার আশালতা ও তার মা গিরিবালাকে কুমিল্লায় নিয়ে যান। কাজী নজরুল তার বন্ধু আলী আকবর খানের সঙ্গে কুমিল্লায় বেড়াতে এলে ইন্দ্র কুমার সেনগুপ্তের বাড়িতে আশালতার সঙ্গে দেখা হয়। অচিরেই তা প্রেমে রূপ নেয়। নজরুল আশালতার টানে পাঁচবার কুমিল্লায় আসেন এবং বিয়ের আগে তেওতায় আসেন দুই-তিনবার। শেষবার জেল মুক্ত হয়ে কুমিল্লায় এলে আশালতা ও নজরুলের প্রেমের বিষয়টি জানাজানি হয়ে যায়। একপর্যায়ে নজরুল কলকাতায় চলে যান। সামাজিক চাপে শেষ পর্যন্ত বাধ্য হয়ে গিরিবালাও আশালতাকে নিয়ে কলকাতায় চলে যান। ১৯২৪ সালে গিরিবালা দেবীর একান্ত ইচ্ছায় নজরুল ও আশালতার বিয়ে হয়। বিয়ের পর কবি আশালতার নাম রাখেন ‘প্রমীলা’।

এদিকে প্রত্নতত্ব বিভাগ জমিদার বাড়ির নবরত্ন মঠ, বাড়ির উত্তরের অংশে পূজার ঘর ও পশ্চিমের কয়েদখানার দুটি কক্ষের নতুন অবয়ব দিয়েছে। এছাড়া দক্ষিণের দুটি রুমে কবি ও তার পত্নীর কিছু দুর্লভ ছবি রাখা হয়েছে দর্শনার্থীদের জন্য। প্রত্নতত্ব অধিদপ্তরের কেয়ারটেকার মাসুদ রানা জানান, তারা দুজন এই জমিদার বাড়িটি দেখভাল করেন। মাঝে মধ্যে তাদের বড় কর্তারা ঘুরে যান।

শিবালয় নজরুল-প্রমীলা সাংস্কৃতিক গোষ্ঠীর সভাপতি অবসরপ্রাপ্ত প্রবীণ শিক্ষক অজয় কুমার চক্রবর্তী যুগান্তরকে বলেন, নজরুল ও প্রমীলার স্মৃতিধন্য তেওতায় সরকারি উদ্যোগে গবেষণা কেন্দ্র স্থাপন ও ঐতিহ্যবাহী জমিদার বাড়ি সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা জরুরি। এ স্থানটি সরকারিভাবে পর্যটন এলাকা ঘোষণা করা যেতে পারে। তিনি তেওতায় প্রমীলা-নজরুল নামে পূর্ণাঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনেরও দাবি জানান।

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম