Logo
Logo
×

শেষ পাতা

আতঙ্কের জনপদ রাউজানে বারো মাসে ১৫ খুন

Icon

চট্টগ্রাম ব্যুরো ও রাউজান প্রতিনিধি

প্রকাশ: ০৯ জুলাই ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

আতঙ্কের জনপদ রাউজানে বারো মাসে ১৫ খুন

ফাইল ছবি

চট্টগ্রামের রাউজান আবারও সন্ত্রাস ও আতঙ্কের জনপদে পরিণত হয়েছে। পান থেকে চুন খসলেই এখানে ঘটছে খুনের ঘটনা। কী দিনে, কী রাতে, খুনের কোনো সময় নেই। রাতের আঁধারে যেমন গোপন আততায়ীরা নামছে হত্যার মিশনে, তেমনি প্রকাশ্য দিবালোকে ফিল্মি স্টাইলেও ঘটছে খুনের ঘটনা। মসজিদে নামাজ পড়ে বের হওয়া লোককেও দেওয়া হচ্ছে না রেহাই। প্রবাস ফেরত ব্যক্তিকেও প্রাণ দিতে হচ্ছে বুলেটের আঘাতে। গত ১২ মাসে এই জনপদে ঘটেছে ১৩টি খুনের ঘটনা। এর মধ্যে ৯টি হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে রাজনৈতিক বিরোধে। বাকিগুলো ব্যবসায়িক, আধিপত্য বিস্তার ও অন্যান্য কারণে। সর্বশেষ সোমবার প্রকাশ্যে স্ত্রী-সন্তানের সামনে যুবদল নেতা মোহাম্মদ সেলিমকে গুলি করে হত্যা করেছে চিহ্নিত সন্ত্রাসীরা। একটি সিএনজি ট্যাক্সিতে এসে সশস্ত্র কয়েকজন যুবক (যার মধ্যে কেউ কেউ বোরকা পরিহিত) ঠান্ডা মাথায় যুবদল নেতাকে গুলি করে সিএনজি অটোরিকশা নিয়ে পালিয়ে যায়। এর মধ্যে দুই ঘাতককে এলাকাবাসী চিনতে পেরেছেন।

এদিকে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রাউজানে একের পর এক সংঘটিত হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় এ পর্যন্ত ১৩টি মামলা হয়েছে রাউজান থানায়। এর মধ্যে ৭টি মামলায় আসামিরা অজ্ঞাত। বাকি মামলাগুলোতে এজাহারভুক্ত অনেক আসামি থাকলেও তাদের গ্রেফতার করা হচ্ছে না। আবার আসল অপরাধীদের পরিবর্তে এসব মামলায় আওয়ামী লীগের লোকজনকেও আসামি করা হচ্ছে। যে কারণে প্রকৃত অপরাধীরা পার পেয়ে যাচ্ছে বলে সংশ্লিষ্টরা অভিযোগ করেছেন।

৫ আগস্টের আগে রাউজানে আওয়ামী লীগের ৬ বারের এমপি এবিএম ফজলে করিম চৌধুরীর রাজত্ব থাকলেও পটপরিবর্তনের পর এখানে বিএনপির দুই গ্রুপ সক্রিয় হয়ে উঠে। বিএনপির কেন্দ্রীয় ভাইস চেয়ারম্যান গিয়াস উদ্দিন কাদের চৌধুরী এবং চট্টগ্রাম উত্তর জেলা বিএনপির সভাপতি গোলাম আকবর খোন্দকারের অনুসারীরা রাউজানে আধিপত্য বিস্তারে মরিয়া হয়ে উঠেছে। অভিযোগ উঠেছে, ফজলে করিমের অনুসারী অনেক ক্যাডার এখন বিএনপি নেতাদের ছাত্রছায়ায় চলে গেছে। তারাও নিজেদের স্বার্থে আধিপত্য ধরে রাখতে এদের ব্যবহার করছেন। সন্ত্রাসীদের ওপর নেতার ছায়া থাকায় পুলিশ প্রশাসনও অনেকটা ‘অসহায়’ বলে সংশ্লিষ্টরা অভিযোগ করেছেন। রাউজানে খুনোখুনির ঘটনায় অভিযোগের তির যখন বিএনপি নেতা গিয়াস কাদের ও গোলাম আকবর খোন্দকারের দিকে তখন তারা দুজনই সংবাদ সম্মেলন করে রাউজানের পরিস্থিতির জন্য পরস্পরকে দায়ী করেছেন।

যদিও এর আগে জেলা পুলিশ সুপার সাইফুল ইসলাম সানতু যুগান্তরকে বলেন, বেশ কয়েকটি হত্যাকাণ্ডের রহস্য তারা উদ্ঘাটন করেছেন। আসামিও গ্রেফতার হচ্ছে। এখানে কে কোন রাজনৈতিক দলের সেটা বিবেচনার সুযোগ নেই। অপরাধী যেই হোক, অপরাধ বিবেচনায় তাদের গ্রেফতার ও শাস্তির মুখোমুখি করার চেষ্টা করা হচ্ছে।

১২ মাসে ১৫ খুন : ৫ আগস্টের পর রাউজানে প্রায় এক বছরে ১৫টি হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে। এর মধ্যে ১০টি হত্যাকাণ্ডই রাজনৈতিক কারণে বলে দাবি করেছেন সংশ্লিষ্টরা। কয়েকজন আওয়ামী লীগ ও শ্রমিক লীগ নেতা খুনের শিকার হলেও বেশিরভাগই যুবদলের অন্তর্ঘাতমূলক হত্যাকাণ্ড বলে সূত্র জানিয়েছে। রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডগুলোর মধ্যে সর্বশেষ ৬ জুলাই বোরকা পরা একদল অস্ত্রধারী সন্ত্রাসী একটি বাজারে প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা করে মুহাম্মদ সেলিম নামের (৪০) এক যুবদল নেতাকে। তিনি উপজেলার কদলপুর ইউনিয়নের ৬ নম্বর ওয়ার্ডের সমশের পাড়া গ্রামের আমির হোসেনের ছেলে। কদলপুর ইউনিয়ন যুবদলের সদস্য সচিব ছিলেন সেলিম। চাচির জানাজা শেষে স্ত্রী-শিশু সন্তানসহ মোটরসাইকেলে ওষুধ কিনতে গিয়েছিলেন তিনি। তাদের সামনেই বোরকা পরা একদল সশস্ত্র যুবক সেলিমকে গুলি করে সিএনজি অটোরিকশা নিয়ে পালিয়ে যায়। বালুমহালের দখলদারিত্ব নিয়ে এ হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে।

৫ আগস্টের সরকার পরিবর্তনের পর রাউজানে প্রথম খুনের ঘটনা ঘটে ২৮ আগস্ট। ওই দিন বিকালে পৌরসভার ৯ নম্বর ওয়ার্ডের চৌধুরী মার্কেট এলাকায় পিটিয়ে হত্যা করা হয় রাঙামাটির কাউখালী উপজেলার বেতবুনিয়া ইউনিয়নের শ্রমিক লীগ নেতা আবদুল মান্নানকে (২৮)। তিনি বেতবুনিয়া সুগারমিল ডাকবাংলো এলাকার কবির আহাম্মদের ছেলে। ১ সেপ্টেম্বর সাবেক সংসদ-সদস্য ফজলে করিম চৌধুরীর বাগানবাড়ি থেকে মো. ইউসুফ মিয়া (৬৫) নামে এক ব্যক্তির মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। নিহত ইউসুফ রাউজান পৌরসভার ৯ নম্বর ওয়ার্ডের আবদুল শুক্কুর মিয়ার বাড়ির মৃত শামসু মিয়ার ছেলে। তাকে রাতের আঁধারে দুর্বৃত্তরা হত্যা করে। ১১ নভেম্বর নিখোঁজের ৩ দিনের মাথায় রক্তাক্ত অবস্থায় হাফেজ মাওলানা আবু তাহের (৪৮) নামে এক মাদ্রাসা শিক্ষকের মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। তিনি রাউজানের চিকদাইর ইউনিয়নের ৩ নম্বর ওয়ার্ডের আকবর শাহ (রহ.) বাড়ির মৃত আবদুল মান্নানের ছেলে। রাজনৈতিক বিরোধের জেরে এই হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয় বলে জানান স্থানীয়রা। চলতি বছরের ২৪ জানুয়ারি উপজেলার নোয়াপাড়া এলাকায় গ্রামের বাড়িতে জুমার নামাজ পড়তে মসজিদে যাওয়ার সময় সন্ত্রাসীদের গুলিতে নিহত হন নগরীর খাতুনগঞ্জের আড়তদার মো. জাহাঙ্গীর আলম (৫৫)। তিনি শহর থেকে মোটরসাইকেলে বাড়িতে গিয়েছিলেন। জাহাঙ্গীর আলম নোয়াপাড়া ইউনিয়নের ৪ নম্বর ওয়ার্ডের নিরামিশপাড়ার মৃত আবু ছৈয়দ মেম্বারের ছেলে। তাকে স্থানীয় যুবদল সন্ত্রাসীরা খুন করেছে বলে পুলিশ জানিয়েছে। ১৯ ফেব্রুয়ারি মুহাম্মদ হাসান (৩৫) নামে এক যুবলীগ কর্মীকে ঘর থেকে তুলে নিয়ে পিটিয়ে হত্যা করে মুখোশধারী সন্ত্রাসীরা। নিহত হাসান নোয়াপাড়া ইউনিয়নের ২ নম্বর ওয়ার্ডের আহমেদ হোসেন মেম্বারের বাড়ির মো. বজল আহমেদ ড্রাইভারের ছেলে। তাকেও রাজনৈতিক বিরোধে হত্যা করা হয়েছে বলে জানায় পুলিশ। ১৫ মার্চ ইফতার মাহফিল নিয়ে বিএনপি নেতাদের বিরুদ্ধে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেওয়াকে কেন্দ্র করে প্রতিপক্ষের মারধর ও ছুরিকাঘাতে খুন হন কমর উদ্দিন জিতু (৩৬) নামে এক যুবদল কর্মী। জিতু হলদিয়া ইউনিয়নের উত্তর সর্ত্তা গ্রামের মুহাম্মদ আলীর ছেলে। ২১ মার্চ পূর্ব গুজরা ইউনিয়নের ৭ নম্বর ওয়ার্ডের হোয়ারাপাড়া এলাকার মোবারক খালের পূর্ব পাশে খোলা জমি থেকে রক্তাক্ত অবস্থায় মো. রুবেল (৩৫) নামে এক তরুণের মরদেহ উদ্ধার করা হয়। গরু চোর সন্দেহে তাকে গণপিটুনি দিয়ে হত্যা করা হয় বলে জানিয়েছে পুলিশ। নিহত রুবেল নগরীর বায়েজিদ বোস্তামী থানা এলাকার মৃত নুরুল আলমের ছেলে। ১৯ এপ্রিল রাতে খুন হন যুবদল কর্মী মানিক আবদুল্লাহ (৩৬)। ১৫ জন মুখোশধারী সন্ত্রাসী এসে ভাত খাওয়া অবস্থায় তার মুখে বন্দুকের নল ঢুকিয়ে হত্যা করে পালিয়ে যায়। ২২ এপ্রিল রাউজান উপজেলা সদরের কাছে ৮ নম্বর ওয়ার্ডে গাজিপাড়া গ্রামে খুন হন ইব্রাহিম (২৮) নামের এক যুবদল কর্মী। তার বাবার নাম মোহাম্মদ আলম।

অরাজনৈতিক ৫ হত্যাকাণ্ড : নিখোঁজের ৪ দিন পর ২৯ অক্টোবর মঙ্গলবার দুপুরে উপজেলার উরকিরচর ইউনিয়নের ৭ নম্বর ওয়ার্ডের মইশকরম এলাকা থেকে পুলিশ অর্ধগলিত একটি লাশ উদ্ধার করে। এই লাশটি ছিল আজম খানের (৫২)। এ ঘটনায় অজ্ঞাতনামা আসামিদের বিরুদ্ধে রাউজান থানায় হত্যা মামলা করেন নিহতের স্ত্রী লাকী আকতার।

৪ এপ্রিল পারিবারিক দ্বন্দ্বে মায়ের পেটের দুই ছোট ভাইয়ের ধারালো অস্ত্র ও লোহার রডের আঘাতে খুন হন বড় ভাই প্রকৌশলী মো. নূর আলম বকুল (৪৩)। তিনি রাউজান উপজেলার হলদিয়া ইউনিয়নের ইয়াসিন নগর গ্রামের ৭ নম্বর ওয়ার্ডের মো. মুছার ছেলে। ১৭ এপ্রিল রাউজান উপজেলার পাহাড়তলী ইউনিয়নের মাহামুনি দিঘী থেকে মো. জাফর (৪০) নামের এক ব্যক্তির লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। নিহত জাফর রাউজান উপজেলার পাহাড়তলী ইউনিয়নের শেখপাড়া গ্রামের মো. ইব্রাহিমের ছেলে। তাকে হত্যা করে দিঘীর পানিতে লাশ ফেলে দেওয়া হয় বলে অভিযোগ নিহতের ভাই সাইফুল ইসলামের। এ ঘটনায়ও পুলিশ কাউকে গ্রেফতার করতে পারেনি।

রাউজানে বালু দিয়ে মস্তক এবং গাছের পাতা দিয়ে শরীর ঢাকা অবস্থায় রুপন নাথ (৪২) নামের এক যুবকের লাশ উদ্ধার করা হয়। ২৫ জুন উপজেলার বাগোয়ান ইউনিয়নের যুগীপাড়ার কর্ণফুলী নদীর পাড়ের বোট ঘাটা এলাকায় তার লাশ পাওয়া যায়। রুপন বাগোয়ান ইউনিয়নের ৫ নম্বর ওয়ার্ডের পশ্চিম নাথ পাড়ার ননী গোপাল নাথের ছেলে। ৩ জুলাই ধূমপান করাকে কেন্দ্র করে মারামারিতে লিপ্ত হয় এলাকার কিশোরদের দুটি পক্ষ। তা থামাতে গিয়ে ঘুসিতে আলমগীর নামে এক যুবদল নেতা নিহত হন। তিনি উপজেলার উরকিরচর ইউনিয়ন যুবদলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ছিলেন।

এছাড়া প্রতিদ্বন্দ্বী গ্রুপগুলোর মধ্যে হামলা-মারামারিতে আহত হয়েছেন আরও কয়েকশ লোক। যাদের অনেকে আহত কিংবা পঙ্গুত্ব নিয়ে দিন কাটাচ্ছেন। এলাকায় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এক সময় ফজলে করিমের অনুসারী সন্ত্রাসীদের কারণে বিএনপি-জামায়াত এমনকি আওয়ামী লীগের অনেকেই রাউজানে বাড়িঘরে যেতে পারেননি। এখন তার চেয়েও ভয়ানক অবস্থা। কোনো কোনো এলাকায় সন্ধ্যার আগেই বাড়ি ফেরেন মানুষ। এই খুনোখুনির কারণে অনেকেই আর শহর ছেড়ে যান না গ্রামের বাড়িতে। কোনো কোনো পরিবার তল্পিতল্পা গুটিয়ে চলে এসেছেন শহরে।

রাউজান থানার ওসি মনিরুল ইসলাম ভূঁইয়া যুগান্তরকে বলেন, হত্যাকাণ্ডগুলোর বেশিরভাগ হয়েছে এলাকায় আধিপত্য বিস্তার ও রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের জেরে। প্রতিটি ঘটনায় মামলা হয়েছে। আসামিও গ্রেফতার হচ্ছে। তবে বেশির ভাগ মামলায় অজ্ঞাতনামা আসামি দেওয়ার কারণে প্রকৃত আসামিদের গ্রেফতারে বেগ পেতে হচ্ছে। সর্বশেষ কদলপুরের সেলিম হত্যার ঘটনায় মঙ্গলবার বেলা ৩টা পর্যন্ত মামলা হয়নি। তবে ওই ঘটনায় ১ আসামিকে গ্রেফতার করা হয়েছে বলে জানান তিনি।

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম