‘সব সাধকের বড় সাধক আমার দেশের চাষা’
এই কবিতাই অমর করেছে রাজিয়া খাতুন চৌধুরানীকে
আবুল খায়ের, কুমিল্লা
প্রকাশ: ১২ জুলাই ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
কবি রাজিয়া খাতুন চৌধুরানীর সংস্কার করা বাড়ি/ ছবি: সংগৃহীত
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
কৃষকের প্রতি কবি রাজিয়া খাতুন চৌধুরানীর মমত্ববোধ আজও ফিরে মানুষের মুখে মুখে। বিখ্যাত ‘চাষী’ কবিতা লিখে তিনি দেশের সাহিত্যমোদী মহল ও কৃষক-শ্রমিকের মনে জায়গা করে নেন। ‘সব সাধকের বড় সাধক আমার দেশের চাষা/দেশ মাতারই মুক্তিকামী, দেশের সে যে আশা।’ কবি রাজিয়া খাতুন চৌধুরানীর চাষি কবিতার অংশবিশেষ এটি। কবি তার প্রতিটি কবিতায় দেশের মেহনতি মানুষের অবদান তুলে ধরেছেন। জমিদারকন্যা-বধূ হয়েও কৃষকের জন্য মমত্ববোধ দরদ তার এসব কবিতায় ফুটে ওঠে। পরলোকবাসী এ কবি কুমিল্লার সুয়াগাজীর জমিদার পরিবারের আশরাফ উদ্দিন আহমদ চৌধুরীর স্ত্রী ছিলেন।
‘চাষী’ কবিতাটি পত্রিকায় পড়ে স্বয়ং নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু ধন্যবাদ জানানোর জন্য কবির কলকাতার বাসায় ছুটে এসেছিলেন। এও কম গৌরবের ঘটনা নয়। রাজিয়া খাতুন অনেক কবিতা, গল্প ও প্রবন্ধ লিখেছেন। তার গল্পগ্রন্থ ‘পথের কাহিনী’ ও কাব্যগ্রন্থ ‘উপহার’। এগুলো ছাড়া অন্য লেখা পুস্তকাকারে প্রকাশিত হয়নি।
পারিবারিক সূত্র জানায়, কবি রাজিয়া খাতুন চৌধুরানী ১৯০৭ সালে নোয়াখালী জেলার হরিরামপুরে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম জমিদার পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। বাবার কর্মক্ষেত্রের সুবাদে কলকাতায় থেকে লেখাপড়া করেন। তার বাবা আবদুর রশিদ খান ছিলেন কলকাতা পৌরসভার ভারপ্রাপ্ত মেয়র। শিক্ষা জীবনে অল্প বয়সেই তিনি সাহিত্য চর্চায় মনোনিবেশ করেন। ব্যক্তি জীবনে তিনি মানবপ্রেম এবং শ্রমজীবী মানুষকে নিয়ে চর্চা ও সাহিত্য সাধনা করেন। মাত্র ২৭ বছর বয়সে তিনি স্রষ্টার ডাকে এ পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে ১৯৩৪ সালে পরলোকগমন করেন। সে সময় কলকাতার বাড়িতে অবস্থানের সুবাদে তাকে সেখানের গোবরা কবরস্থানে লাশ দাফন করা হয়। ক্ষণজন্মা মহীয়সী এ নারীর অকাল প্রয়াণে নোয়াখালী ও কুমিল্লার দুই জমিদার পরিবার এক নক্ষত্রকে হারায়। সে সময় তার রচিত ‘চাষী’ কবিতা সাহিত্য অঙ্গনে বেশ সাড়া ফেলে। মৃত্যুর পর গুণী এ কবির স্মৃতি কিংবা তার কর্ম সংরক্ষণে কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। ফলে আস্তে আস্তে আড়াল হয়ে যাচ্ছে কবি রাজিয়া খাতুন চৌধুরানীর স্মৃতি। কবির নামে গড়ে উঠেনি কোনো ফাউন্ডেশন কিংবা সংগঠন। তাকে নিয়ে নেই কোনো চর্চা। সরকারি উদ্যোগে গড়ে উঠেনি কোনো প্রতিষ্ঠান। স্বজনদের মাঝেও তাকে নিয়ে তেমন আগ্রহ দেখা যায়নি।
কবির নাতি ইমরান চৌধুরী বলেন, আমার নানি বাংলার কৃষক শ্রমিক মেহনতি মানুষকে নিয়ে ভাবতেন। বিশেষ করে কৃষকদের সাধনা তিনি তার কবিতায় তুলে ধরেছেন। তার রচিত ‘চাষী’ কবিতা এখনো সাহিত্যাঙ্গনে আলোচিত। অল্প বয়সে তিনি কলকাতায় মারা যান। তাকে নিয়ে আমরা পারিবারিকভাবে চর্চা করি। নানির আদর্শ বুকে ধারণ করে চলি। তার অবদানকে স্বীকৃতি দিতে হলে সরকারিভাবে উদ্যোগ নিতে হবে।
রাজিয়া খাতুন কৃষক শ্রমিক মেহনতি মানুষকে দুহাতে বিলিয়ে দিতেন। তার উদার মনের কথা এখনো এলাকার প্রবীণ ও ইতিহাসবিদদের মুখে শোনা যায়।
রাজিয়া খাতুনের স্বামী কুমিল্লার সুয়াগাজীর জমিদার আশরাফ উদ্দিন আহমদ চৌধুরী ছিলেন বেঙ্গল কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক। নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু ছিলেন সভাপতি। দেশ ভাগের পর আশরাফ উদ্দিন আহমদ চৌধুরী যুক্তফ্রন্টের আবু হোসেন মন্ত্রিসভায় শিক্ষামন্ত্রী ছিলেন। তার তত্ত্বাবধানেই বর্ধমান হাউজকে বাংলা একাডেমিতে রূপান্তর করা হয়। তাদের তিন মেয়ে এক ছেলের মধ্যে জীবিত আছেন রাবেয়া চৌধুরী।
রাবেয়া চৌধুরী বিএনপির কেন্দ্রীয় ভাইস চেয়ারম্যান ও চারবারের সাবেক সংসদ-সদস্য। তার বয়স এখন ৯০-এর বেশি। রাবেয়া চৌধুরী ৪ বছর বয়সে মা কবি রাজিয়া খাতুনকে হারান। চার দশকের রাজনীতির দীর্ঘ পথপরিক্রমা ও চারবারের সংসদ-সদস্য হয়েও তার কোনো গাড়ি-বাড়ি নেই। মায়ের আদর্শ ধারণ করে কৃষক শ্রমিক মেহনতি মানুষের সঙ্গে সেতুবন্ধ তৈরি করেছেন।
রাবেয়া চৌধুরীর ছেলে ইমরান চৌধুরী বলেন, ‘নানা-নানুর আদর্শ ধারণ করেছেন মা। চারবার এমপি হলেও রাজনীতির কালো পথে হাঁটেননি। আমাদেরও হাঁটতে দেননি। ১৯৭৭-৭৮ সালের দিকে জাতীয় মহিলা সংস্থা কুমিল্লার চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করে সবার নজর কাড়েন তিনি। তৎকালীন রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবদুস সাত্তার ১৯৭৮ সালে ‘জাগদল’ গঠন করলে সাবেক মন্ত্রী ফাতেমা কবিরের সঙ্গে বেগম রাবেয়া চৌধুরীকেও বৃহত্তর কুমিল্লার যুগ্ম আহ্বায়ক নির্বাচিত করেন। লায়ন্স ক্লাব অব কুমিল্লার প্রেসিডেন্ট হিসাবে আর্তমানবতার সেবায়ও কাজ করেন। রাবেয়া চৌধুরী বিয়ে করেন চাচাতো ভাই নাসির আহমদ চৌধুরীকে।
ইতিহাস গবেষক আহসানুল কবীর বলেন, কুমিল্লা টাউন হলে ত্রিশের দশকে কৃষক সম্মেলন হয়েছিল। সেখানে স্বামী রাজনীতিবিদ আশরাফ উদ্দিন চৌধুরীর অনুরোধে ‘চাষী’ কবিতাটি লেখেন রাজিয়া চৌধুরানী। সেটি সম্মেলনের উদ্বোধনী সংগীত হিসাবে গাওয়া হয়েছিল। জমিদার কন্যা ও বধূ হওয়ার পরও তার কৃষকের জন্য মমত্ববোধ ও দরদ এই কবিতায় ফুটে ওঠে। এতে প্রমাণিত হয় তিনি দরদি মনের মানুষ ছিলেন। তিনি অল্প বয়সে প্রয়াত হন। এতে জাতি একজন প্রতিভাবান কবিকে হারিয়েছে। ভক্ত ও শুভাকাঙ্ক্ষীদের অভিযোগ, কবি রাজিয়া খাতুন চৌধুরানী তার যোগ্যতার মূল্যায়ন পাননি।
কুমিল্লার সুয়াগাজী সাহেব বাড়িতে গিয়ে কথা হয় কবি রাজিয়া চৌধুরানীর মেয়ে রাবেয়া চৌধুরীর সঙ্গে। বয়সের ভারে তিনি এখন অনেকটাই ন্যুব্জ। রাজনীতিতেও সক্রিয় নন। তবে কথার মধ্যেই দেশের প্রতি, মানুষের প্রতি তার মমত্ববোধ লক্ষ্য করা যায়। ছাত্র-জনতার বিপ্লবের মাধ্যমে স্বৈরাচার সরকারের পতন হওয়ায় তিনি সবাইকে ধন্যবাদ জানান। তিনি বলেন, মা রাজিয়া খাতুন চৌধুরানীকে দেখার স্মৃতি খুব মনে নেই। তবে মায়ের আদর্শ লালন করছি।
কবির ভক্ত ও শুভাকাঙ্ক্ষীদের দাবি, রাজিয়া খাতুন চৌধুরানীর অবদানের স্বীকৃতি দিতে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিতে হবে। সরকারি উদ্যোগে একটি সংগ্রহশালা প্রতিষ্ঠা করতে হবে। কবির জন্ম এবং প্রয়াণ দিবসে অনুষ্ঠানের আয়োজন করতে হবে। এতে এই গুণীর আত্মা শান্তি পাবে।
