Logo
Logo
×

শেষ পাতা

গণ-অভ্যুত্থানের এক বছর

আবু সাঈদের রক্তের দাগ বন্ধুদের শার্টে

Icon

রংপুর ব্যুরো

প্রকাশ: ১৬ জুলাই ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

আবু সাঈদের রক্তের দাগ বন্ধুদের শার্টে

ফাইল ছবি

রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শেষ বর্ষের ছাত্র আবু সাঈদ জীবন দিয়ে বাংলাদেশের নতুন ইতিহাস রচনা করেছেন। ২০২৪ সালের ১৬ জুলাই তার রক্তের দাগ লেগে আছে সাজুসহ বন্ধু ও সহপাঠীদের শার্টে। সেই রক্তই জুলাই আন্দোলনকে বেগবান করেছে। তার মৃত্যু তৎকালীন সরকারের পতন করেছে ত্বরান্বিত। ছাত্র-জনতা-শিক্ষক-কর্মচারী ও সাধারণ মানুষ এই আন্দোলনে যুক্ত হন। সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কার আন্দোলনে পুলিশ গুলি চালালে রংপুরে নিহত হন আবু সাঈদ। সেই ঘটনার দিন পুরো বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। একপর্যায়ে আবু সাঈদকে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় সড়কে পড়ে যেতে দেখা যায়। সে সময় পুলিশ তার দিকে আগ্নেয়াস্ত্র তাক করে গুলি চালায়। গুলিবিদ্ধ হয়ে পড়ে গেলে সাজুসহ তার সহপাঠীরা তাকে ধরাধরি করে জরুরি চিকিৎসার জন্য রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান। সেখানে কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।

সে সময় আহত আবু সাঈদকে যারা রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান তাদের মধ্যে বেরোবির শিক্ষার্থী সাজু অন্যতম। তিনি বলেন, আমার সাদা-কালো শার্টে আবু সাঈদের রক্ত। সেই রক্ত আমার বিবেককে প্রসারিত করেছে। ভয়কে জয় করতে ১৬ জুলাই আমার জীবনের বিরাট অবদান রেখেছি। সেদিনের মিছিল রংপুর শহরের স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়-পলিটেকনিকসহ সব শিক্ষার্থীর মিলনমেলায় পরিণত হয়েছিল। এর মধ্যেই পুলিশ লাঠিচার্জ ও গুলি শুরু করলে আমরা ছত্রভঙ্গ হয়ে যাই।

কিন্তু আবু সাঈদ রোড ডিভাইডার অতিক্রম করে গেটের সামনে দু-হাত প্রসারিত করে, গুলির সামনে দাঁড়িয়ে যায়। গেট থেকে ৫-৬ ফিট দূরত্ব থেকে পুলিশ গুলি করে। তাকে লক্ষ্য করে পরপর গুলি চালানোয় সে আর দাঁড়াতে পারেনি।

সাজু বলেন, আবু সাঈদ রাস্তা পার হয়ে দাঁড়িয়ে যেতে চাইলে সে পড়ে যায়, লায়ন্স স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষার্থী আয়ানসহ ৩-৪ জন তুলে ধরার চেষ্টা করে। আমি ততক্ষণে তাদের সঙ্গে যুক্ত হই। আবু সাঈদকে নিয়ে যাওয়ার সময়ও গুলি থামেনি। তার মধ্যে পার্কের মোড়ে এসে একটি রিকশায় আমি উঠি, সঙ্গে আরও দুজন। মাহিগঞ্জ কলেজের শিক্ষার্থী নিপুণ, আরেকজন রিকশায় জায়গা না হওয়ায় ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের কাছে নেমে যায়। সেখানেই আমরা দ্রুত যাওয়ার জন্য আবু সাঈদকে অটোতে করে নিই। আমরা কোতোয়ালি রোড হয়ে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাই। আমি দেখি আবু সাঈদের শরীর গুলিতে ক্ষতবিক্ষত, রক্ত জমাট বেঁধে আছে, নাক ও মুখে রক্ত। মাথার আঘাতের রক্ত আমার শার্টের হাতায় লেগে আছে। এই অবস্থায় তার শরীর নিথর হয়ে আছে।

রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ৩ তলায় ১৪নং ওয়ার্ডে যেতে বলেন চিকিৎসকরা। সেখানে পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর ডাক্তার আবু সাঈদকে মৃত ঘোষণা করেন। তখন সময় বিকাল ৩টা ৫ মিনিট। তার লাশ ইমার্জেন্সির নিচে রাখা হয়। আবু সাঈদের বন্ধুসহ জুনিয়ররা লাশের পাশে কান্নাকাটি শুরু করে। ক্যাম্পাসের সবাইকে জানানো হয়। আবু সাঈদের লাশ শিক্ষার্থীরা বেরোবি ক্যাম্পাসে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলে হাসপাতালের পরিচালক প্রথমে বাধা দেন। শিক্ষার্থীরা হইচই শুরু করলে তিনি চলে যান। পরে বেরোবির শিক্ষক তুহিন ওয়াদুদ ও উমর ফারুক আসেন। ২৫-৩০ জন শিক্ষার্থী আবু সাঈদের লাশ স্ট্রেচারে করে মেইন রোডে মিছিল করি। এ সময় মিছিলে অভিভাবক হিসাবে ছিলেন আহসানুল আরেফিন তিতু, অ্যাডভোকেট কামরুন্নাহার খানম শিখা, আনোয়ার হোসেন বাবলু। আমরা মেডিকেল থেকে পুলিশ লাইন মোড় যাওয়া পর্যন্ত দুবার পুলিশের বাধার সম্মুখীন হই। পরে পুলিশ লাইন মোড়ে পুলিশ ভ্যান এসে আমাদের কাছ থেকে লাশ কেড়ে নেয়। আমাদের ওপর হামলাও চালায়। পরে আমরা সব শিক্ষার্থী কাছারি বাজার ডিসির মোড়ে অবস্থান নিই।

আবু সাঈদকে হাসপাতালে নেওয়ার পর আসেন বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষক ড. তুহিন ওয়াদুদ। তিনি গণমাধ্যমকে বলেন, আবু সাঈদের ‘হাত, বুক, পিঠ, মুখসহ শরীরের বিভিন্ন স্থানে বুলেটের আঘাতের চিহ্ন ছিল। মাথার পেছনে ফুটো হয়ে রক্ত ঝরছিল।’

বিশ্ববিদ্যালয় গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক তাবিউর রহমান প্রধান বলেন, ‘আবু সাঈদ নিহতের ঘটনা বিশ্বকে নাড়া দিয়েছে। এটি একটি বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ড। আমরা ছাত্র হত্যার বিচার চাই।’

দুনিয়া কাঁপানো ওই দৃশ্যটি মাত্র ৮ হাত দূর থেকে ক্যামেরাবন্দি করেন যমুনা টেলিভিশনের ভিডিও সাংবাদিক আলমগীর হোসেন : যা মুহূর্তেই ছড়িয়ে যায় সারা দুনিয়ায়। যমুনা টেলিভিশনের ভিডিও ধারণকারী আলমগীর হোসেন বলেন, আমরা সেদিন সকাল ১০টা থেকে আন্দোলন ফলো করতে থাকি। যখন আবু সাঈদকে গুলি করা হয় তার ৮ হাত দূর থেকে আমি ক্যামেরা অপারেট করছিলাম। যখন দেখলাম সবাই চলে গেলে শুধু আবু সাঈদ সেখানে আছে। এবং হাত তুলে আছে। তখন প্রথমে তাকে আমি ফোকাস করি। আমি দেখলাম। আমার ডান পাশে গেটের সামন থেকে পুলিশ বন্দুক তাক করেছে। শুট করা মাত্রই সাঈদ এবং পুলিশকে বারবার ফোকাস করি। পরপর গুলি হয় কয়েকটি। একটা গুলি লাগার সঙ্গে সঙ্গে আমি বলি গুলি খাইছে, গুলি খাইছে একটা। যেটা আমার ক্যামেরাও রেকর্ড হয়। পরে সে ডিভাইডারের পাশে চলে যায়। সেখানে একজন তাকে প্রথমে ধরে। পরে আরও বেশ কয়েকজন আসে। আমি যতদূর জুম করতে পারি ক্যামেরা। সেটা ধারণ করি।

যমুনা টেলিভিশনের সিনিয়র করসপনডেন্ট ও রংপুর বিভাগীয় প্রধান মাজহারুল মান্নান বলেন, আবু সাঈদ গুলিবিদ্ধ হওয়ার দৃশ্য মোটামুটি ১০ হাত দূর থেকে স্বচক্ষে দেখেছি। সাঈদকে তার সহপাঠীরা পার্কের মোড়ে নিয়ে যান। সেখানে কোনো রিকশা ছিল না। একটি রিকশা জোর করে এনে সাঈদকে নিয়ে তিনজন হাসপাতালের দিকে নিয়ে যান। আমি লক্ষ্য করি কৃষি অফিসের সামনে গিয়ে একজন শিক্ষার্থী নেমে যান। পরে আরও কিছুদূর গিয়ে অটোতে করে সাঈদকে হাসপাতালে নিয়ে যান তারা। দ্রুত নিয়ে যাওয়ার জন্য জীবন বীমার মোড় হয়ে থানার সামনে দিয়ে অটো নেওয়া হয়। আমি পরবর্তীতে ওই তিন শিক্ষার্থীর সঙ্গে কথা বলি ও বক্তব্য ধারণ করি। তারা হলেন-মাহিগঞ্জ কলেজের শিক্ষার্থী নিপুর রায়, ইমেজ পলিটেকনিকের শিক্ষার্থী সাজু বাসেফোর এবং রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী সাঈদের সিনিয়র সহপাঠী কবিরুল হাসান মিজু। কৃষি অফিসের সামনে গিয়ে মিজু নেমে গিয়েছিল। হাসাপাতালে নিয়ে গেলে জরুরি বিভাগ থেকে সাঈদকে ভর্তি করানোর কথা বলা হয়। উপরে সার্জারি ওয়ার্ডে নিয়ে যাওয়া হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। লাশ যখন জরুরি বিভাগের মেডিকেল অফিসারের রুমের সামনে আনা হয়-শিক্ষার্থীরা হাসপাতালের স্ট্রেচারে করেই তারা লাশ ক্যাম্পাসে নিয়ে যাওয়ার জন্য বেরিয়ে পড়েন। পথে মিছিল দিতে থাকেন। লাশ হাসপাতাল থেকে বের করে নিয়ে যাওয়ার পর ডেথ সার্টিফিকেট দেয় কর্তৃপক্ষ। তাতে মৃত্যুর সময় উল্লেখ করা হয় ৩টা ৫ মিনিট।

সাঈদের মৃত্যুর খবর শোনার পর ক্যাম্পাসের সামনে বিভিন্ন স্থান থেকে শিক্ষার্থীরা আসতে শুরু করেন। থাকে আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, যুবলীগ, তাঁতীলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারী হেলমেট ও মুখে গামছা বেঁধে রাম-দা, বেকি, আগ্নেয়াস্ত্রসহ বিভিন্ন অস্ত্র নিয়ে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালায়। তাদের সঙ্গে পুলিশও হামলে পড়ে। শিক্ষার্থীরা গাছের ডাল ও লাঠি দিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। কিন্তু তারা পুলিশের টিয়ার শেল, সাউন্ড গ্রেনেড ও গুলির সামনে বেশিক্ষণ দাঁড়াতে পারছিলেন না। দফায় দফায় চলে এই সংঘর্ষ। পরে বিকাল ৫টার পর পুলিশ ও সরকারদলীয় এবং বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের লোকজন পিছু হটে। শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাসে প্রবেশ করে বিভিন্ন হলে ভাঙচুর চালান। ছাত্রলীগ নেতার কারে এবং ভিসির বাংলোয় আগুন দেন। পুলিশ ও র‌্যাবের লোকজন বাংলোয় আটকে পড়া ভিসি, তার সহধর্মিণী ও অন্যদের সেখান থেকে উদ্ধার করে নিরাপদে নিয়ে যান।

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম