Logo
Logo
×

শেষ পাতা

ঈশা খাঁর শৌর্য-বীর্যের সাক্ষী রোয়াইলবাড়ি দুর্গ

অযত্ন-অবহেলায় পড়ে আছে, সংরক্ষণের দাবি নেত্রকোনাবাসীর

Icon

কামাল হোসাইন, নেত্রকোনা

প্রকাশ: ১৭ জুলাই ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

ঈশা খাঁর শৌর্য-বীর্যের সাক্ষী রোয়াইলবাড়ি দুর্গ

ছবি: যুগান্তর

‘রোয়াইলবাড়ি’ শব্দটি আরবি ও বাংলা শব্দের সমন্বয়ে গঠিত। রোয়াইল শব্দটি এসেছে আরবি ‘রেইল’ বা ‘রালাহ’ শব্দ থেকে, যার অর্থ ‘অশ্বারোহী সৈন্যদল’। আর বাংলায় ‘বাড়ি’ হলো ঘর বা বাসস্থান। তাই রোয়াইলবাড়ি শব্দের পূর্ণ অর্থ দাঁড়ায় ‘অশ্বারোহী সৈন্যদলের বাড়ি’। বাংলার প্রাচীন শাসনকর্তাদের ইতিহাস-ঐতিহ্যমণ্ডিত এক ঐতিহাসিক স্থান। একসময় কত ঘটনাই না ঘটেছে এ দুর্গে। বাংলার সুলতান হুসেন শাহ, নছরৎ শাহ ও ঈশা খাঁর অশ্বারোহী বাহিনীর ঠক ঠক শব্দে কীভাবেই না কেঁপেছে এই রোয়াইলবাড়ির মাটি; সে ইতিহাস আজ পুরোপুরি জানা না গেলেও তাদের অহংকার ও শৌর্য-বীর্যের সাক্ষী হয়ে আজও ঠায় দাঁড়িয়ে আছে প্রাচীন দুর্গটি।

কালক্রমে রোয়াইলবাড়ি এখন একটি পুরো গ্রাম ও ইউনিয়নের নাম। নেত্রকোনার কেন্দুয়া উপজেলা সদর থেকে সাত কিলোমিটার দূরে গ্রামটির অবস্থান। রোয়াইলবাড়ি দুর্গের পশ্চিম পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে বেতাই নদী। ঈশা খাঁর স্মৃতিবিজড়িত আরেক ঐতিহাসিক স্থান কিশোরগঞ্জের করিমগঞ্জ উজেলার জঙ্গলবাড়ি দুর্গও রোয়াইলবাড়ি থেকে খুব বেশি দূরে নয়।

কেন্দুয়ায় অযত্ন-অবহেলায় পড়ে আছে রোয়াইলবাড়ি দুর্গটি। কেন্দুয়া উপজেলা সদর থেকে ১২ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে মৃতপ্রায় বেতাই নদীর পাড়ে ঐতিহাসিক দুর্গটির অবস্থান। এটি ‘কোটবাড়ি দুর্গ’ নামেও অনেকের কাছে পরিচিত। প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর আশির দশকে দুর্গটিকে পুরাকীর্তি হিসাবে ঘোষণা করে। এরপর ঐতিহাসিক এ স্থাপনাটি দিনদিন ভ্রমণপিপাসুদের কাছে আকর্ষণীয় পর্যটন স্থানে পরিণত হয়। দূর-দূরান্ত থেকে প্রতিদিন অসংখ্য মানুষ বেড়াতে আসেন বাংলার প্রাচীন শাসনকর্তাদের স্থাপনাটি দেখতে। যদিও ভ্রমণপিপাসুদের সুবিধার জন্য আজও কোনো ব্যবস্থাই নেওয়া হয়নি সেখানে। বলা যায়, দুর্গটি অবহেলিত ও অরক্ষিত। ঐতিহাসিক এ স্থাপনাটি সংরক্ষণের দাবি জানিয়েছেন নেত্রকোনাবাসী।

স্থানীয় ইতিহাসবেত্তার মতে, ১৪৯৮ খ্রিষ্টাব্দে সুলতান আলাউদ্দিন হুসেন শাহ কামরূপের রাজা নিলাম্বরের বিরুদ্ধে প্রচণ্ড যুদ্ধ পরিচালনা করে কামরূপ রাজ্য অধিকার করেন। পরে তার পুত্র নছরৎ শাহ কামরূপ রাজ্য শাসন করেন। এর কিছুদিন পর তিনি প্রতিপক্ষের আক্রমণের মুখে বিতাড়িত হন এবং কামরূপ থেকে পালিয়ে এসে পূর্ব ময়মনসিংহের (বর্তমানে নেত্রকোনা জেলার অন্তর্গত) রোয়াইলবাড়িতে আশ্রয় নেন। তখন তিনি এ অঞ্চলটির নামকরণ করেন ‘নছরৎ ও জিয়াল’ (কারও কারও মতে ‘নছরৎ আজিয়াল’)। পরবর্তী সময়ে পুরো প্রদেশটিই (বৃহত্তর ময়মনসিংহ) ‘নছরৎশাহী পরগনা’ নামে পরিচিত হয় এবং আকবর শাহের সময় পর্যন্ত পরগনাটি ওই নামেই পরিচিত ছিল। এরপর মসনদে আলী ঈশা খাঁ এ অঞ্চলে বিশাল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে কিশোরগঞ্জের জঙ্গলবাড়ি ও নেত্রকোনার রোয়াইলবাড়ি দুর্গের নিয়ন্ত্রণ নেন। স্থানীয়রা জানান, রোয়াইলবাড়ি থেকে জঙ্গলবাড়ি পর্যন্ত যাতায়াতের জন্য একটি রাস্তাও ছিল, যা বর্তমানে পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। কিন্তু প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর এ স্থাপনাটি ঠিক কার সময়ে নির্মাণ করা হয়েছিল, সে ব্যাপারে এখনো নিশ্চিত নয়।

স্থানীয় গবেষক আলী আহম্মদ খান আইয়্যুব বলেন, স্থাপত্যশৈলী এবং উদ্ধার করা জিনিসপত্র দেখে মনে হয়, এটি ১৫ শতকের শেষদিকে নির্মিত। ধারণা করা যায়, এটি সৈন্যবাহিনী বা পদাতিক বাহিনীর আউটপোস্ট ছিল। রোয়াইলবাড়ি দুর্গের বিস্তীর্ণ অংশ দুই-আড়াই যুগ আগেও মাটির নিচে চাপা পড়েছিল। প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর ১৯৯১ থেকে ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত সেখানে খননকাজ চালায়। এ সময় মাটির নিচ থেকে বেরিয়ে আসে ইটের দেওয়ালবেষ্টিত দুর্গ, মূল প্রবেশদ্বার (সিংহদ্বার), বহু কক্ষবিশিষ্ট একাধিক ইমারতের চিহ্ন, শান বাঁধানো ঘাটসহ দুটি বড় পুকুর, দুটি পরিখা, বুরুজ ঢিবি বা উঁচু ইমারত (টাওয়ার), বার দুয়ারি ঢিবি, কবরস্থান, মসজিদ, মিহরাব, চওড়া প্রাচীর, সুড়ঙ্গপথ; লতাপাতা ও ফুল-ফলে আঁকা রঙিন প্রলেপযুক্ত কারুকাজ; পোড়ামাটির অলংকৃত ইট, টালি, জ্যামিতিক মোটিফ, টেরাকোটা, বর্শা, প্রস্তরখণ্ড এবং লোহা ও চিনামাটির নানা জিনিসপত্র।

২০১৬-১৭ অর্থবছরে রোয়াইলবাড়ি দুর্গে পুনরায় খননকাজ পরিচালনা করে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর। সেবারের খননের মূল উদ্দেশ্য ছিল দুর্গের দক্ষিণদিকের তোরণ উন্মোচন ও গেটের বৈশিষ্ট্য জানা। কিন্তু এ দুটির পাশাপাশি ফুল-লতা-পাতার নকশা অঙ্কিত আলংকারিক পাথর, মুসলিম যুগের টাইলস, মৃৎপাত্রের টুকরা, লোহার তৈরি পাথর জোড়া লাগানোর হুকসহ আরও অনেক কিছু পাওয়া যায় সেখানে। আবিষ্কার করা হয় ১০ কোণাকার ও ১০ বাহুবিশিষ্ট চারটি ওয়াচ টাওয়ার। এ ধরনের ওয়াচ টাওয়ার এবং গেটের বৈশিষ্ট্য বাংলাদেশের আর কোনো প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনে পাওয়া যায়নি। তাই এটি ব্যতিক্রম।

সরেজমিন দেখা যায়, পুরো দুর্গ এলাকাটি তিনভাগে বিভক্ত। মূল দুর্গের পূর্বদিকে দুটি পুকুর, যার অস্তিত্ব এখনো বিদ্যমান। দক্ষিণদিকের মাটির দেওয়ালের দুপাশে দুটি পরিখা। একটি পরিখা বেতাই নদী থেকে আসা নৌযানগুলো নোঙর করার জন্য ব্যবহৃত হতো বলে অনুমান করা হয়। ধারণা করা হয়, দুর্গের উত্তর ও দক্ষিণ দেওয়ালে বড় বড় পাথরখণ্ড দিয়ে নির্মিত আরও দুটি প্রবেশপথ ছিল। খননের পর এখানে কারুকার্যখচিত যে মসজিদের ধ্বংসাবশেষ পাওয়া গেছে; অনেকের মতে, এটিই দেওয়ান জালাল নির্মিত ‘মসজিদ-এ-জালাল’ বা ‘জালাল মসজিদ’।

স্থানীয়রা বলেন, এ মসজিদের ১৫টি গম্বুজ ছিল। এছাড়া মসজিদের কাঠামোয় ছিল ১২টি দরজা, পাঁচটি খুতবা পাঠের মেহরাব (মিম্বর) এবং মার্বেল পাথরের তৈরি বিশাল কয়েকটি খিলান। মসজিদের দেওয়ালগুলোয় সূর্যমুখী ফুলের নকশা আঁকা ছিল। দুর্গের দক্ষিণদিকের খোলা ময়দানটিকে সৈন্যবাহিনীর প্যারেড গ্রাউন্ড হিসাবে মনে করা হয়। এছাড়াও দুর্গের বিভিন্ন অংশে বেশ কয়েকটি ভবন বা ইমারতের ধ্বংসাবশেষ পাওয়া যায়। মসজিদের ৩০ মিটার উত্তরে একটি প্রাচীন কবরস্থান চিহ্নিত করা হয়েছে। এলাকাবাসী এটিকে ‘নিয়ামত বিবির মাজার’ ও ‘ডেঙ্গুমিয়ার সমাধি’ নামে চেনেন।

স্থানীয়রা জানান, প্রতিদিনই বিভিন্ন এলাকা থেকে প্রচুর ভ্রমণপিপাসু দুর্গটি দেখতে আসেন। শীত মৌসুমে লোকসমাগম বেশি হয়। দুর্গে গিয়ে কথা হয় নেত্রকোনা জেলা শহর থেকে আসা পল্লব চক্রবর্তীর সঙ্গে। স্থানীয় লেখক ও কবি রহমান জীবনকে নিয়ে বেড়াতে এসেছিলেন তিনি। তারা বলেন, জায়গাটি অনেক সুন্দর। কিন্তু এখানে ভ্রমণপিপাসুদের আকৃষ্ট করার কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। কোনো রেস্টরুম, পানি, টয়লেট বা থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা নেই। দুর্গ থেকে রোয়াইলবাড়ি বাজার অনেক দূরে। ওই রাস্তাটি কাঁচা। কাদা আর খানাখন্দে ভরা। নেত্রকোনা জেলা প্রশাসক বনানী বিশ্বাস বলেন, ইতোমধ্যে জেলা প্রশাসনের সহযোগিতায় সেখানে বাউন্ডারি ওয়াল নির্মাণ করা হয়েছে। ভবিষ্যতে আরও কিছু কাজ করার পরিকল্পনা রয়েছে। ঐতিহাসিক এ স্থানটি সংরক্ষণের জন্য যথাযথ কর্তৃপক্ষকে অবহিত করা হবে।

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম