Logo
Logo
×

শেষ পাতা

বাড়বে বাণিজ্য, নিশ্চিত হবে নিরাপত্তা

সম্ভাবনার নতুন দিগন্ত পার্বত্য চট্টগ্রাম সীমান্ত সড়ক

Icon

আলাউদ্দীন শাহরিয়ার, বান্দরবান

প্রকাশ: ১৯ জুলাই ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

সম্ভাবনার নতুন দিগন্ত পার্বত্য চট্টগ্রাম সীমান্ত সড়ক

পার্বত্য চট্টগ্রাম সীমান্ত সড়কের পথে পথে প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য ধরা দিয়েছে। আঁকাবাঁকা সড়কটির চারদিকে সবুজের সমারোহ। কখনো উঁচুনিচু পাহাড়ের সারি, কখনো মেঘে ঢাকা পথটি গোটা পার্বত্য চট্টগ্রামকে যুক্ত করেছে সড়ক নেটওয়ার্কে। বান্দরবানের কেওক্রাডং পর্বতশৃঙ্গের ওপর দিয়ে এঁকেবেঁকে চলে যাওয়া পিচঢালা সড়কটিই বাংলাদেশের সবচেয়ে উঁচু সড়ক হিসাবে স্থান পেতে যাচ্ছে। কেওক্রাডং পাহাড়ের সর্বোচ্চ চূড়ায় সড়কটির উচ্চতা দাঁড়াচ্ছে ৯৬৫ মিটার। এত উঁচুতে দেশে আর কোনো সড়ক নির্মাণ হয়নি এখন পর্যন্ত। এর আগে থানচি উপজেলার বাকলাই-লিক্রে সড়কের সাদ্রাহাফং পাহাড়ের রেমংপাড়া স্থানটি ছিল সবচেয়ে উঁচু সড়ক। যার উচ্চতা ৯২২ মিটার। এই স্থানটিকে ছাড়িয়ে এখন কেওক্রাডং সড়কটি দেশের সর্বোচ্চ উঁচু সড়কপথ। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন সেনাবাহিনীর ২৬ কনস্ট্রাকশন ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল আবু নোমান মো. মইনুল ইসলাম।

সংশ্লিষ্টদের তথ্যমতে, ২০১৮ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম সীমান্ত সড়ক অনুমোদনের পর ২০২০ সালের জানুয়ারিতে সড়কটির নির্মাণ কাজ শুরু হয়। সেনাবাহিনীর ২৬ কনস্ট্রাকশন ব্যাটালিয়ন বান্দরবানের রুমা উপজেলার বগালেক থেকে কেওক্রাডং হয়ে ধুপানিছড়া পর্যন্ত ১৬ কিলোমিটার সড়কটির নির্মাণ কাজ করেছে।

পার্বত্য চট্টগ্রাম সীমান্ত সড়কের প্রথম পর্যায়ের ৩১৭ কিলোমিটারের একটি অংশ বান্দরবানের এই সড়কটি। এটি শুধু দেশের সর্বোচ্চ সড়কই নয়; এটি এলাকার পর্যটন, শিক্ষা, চিকিৎসা, কৃষিসহ দুর্গম এলাকার আর্থসামাজিক অবস্থার উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে আশা করা হচ্ছে।

কোন কোন এলাকা অন্তর্ভুক্ত : পার্বত্য চট্টগ্রাম সীমান্ত সড়কটি বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি থেকে শুরু হয়ে রাঙামাটির রাজস্থলী উপজেলা সদর, বিলাইছড়ি উপজেলার ফারুয়া ও জুরাইছড়ি উপজেলার দুমদুম্যা হয়ে মিয়ানমার ও ভারত সীমান্তে পৌঁছাবে। সড়কটি বরকল ও বাঘাইছড়ি এবং খাগড়াছড়ির দীঘিনালা, পানছড়ি, মাটিরাঙ্গা হয়ে রামগড় উপজেলা সীমান্তে গিয়ে শেষ হবে। সীমান্তবর্তী এলাকাগুলোতে পাহাড়ের ভেতর দিয়ে নির্মিত হচ্ছে আঁকাবাঁকা এ সড়ক। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে সীমান্তবর্তী দেশগুলোর সঙ্গে সড়ক পথে সংযুক্ত হবে বাংলাদেশের পার্বত্য তিন জেলা। ২০৩৬ সালের মধ্যে বান্দরবান, খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটি-তিন পার্বত্য জেলার ১২টি উপজেলার ওপর দিয়ে পুরো ১০৩৬ কিলোমিটার সড়ক নির্মাণ কাজ শেষ হওয়ার কথা। প্রথম ধাপের ৩১৭ কিলোমিটার সড়ক নির্মাণ শেষ হয়েছে ৩০ জুন। এতে খরচ হয়েছে প্রায় ৩৪৮০ কোটি টাকা। পুরো কাজ শেষ হলে এটি হবে বাংলাদেশের দীর্ঘ সড়ক নেটওয়ার্ক। এ সড়ক ভারতের মিজোরাম ও ত্রিপুরা রাজ্য এবং মিয়ানমারের আরাকান রাজ্যের সঙ্গে সড়ক নেটওয়ার্কে বাংলাদেশের যুক্ত হওয়ার পথ প্রশস্ত করবে।

সড়ক ঘিরে গড়ে উঠেছে পর্যটন কেন্দ্র : পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক পরিষদের চেয়ারম্যান কাজী মুজিবুর রহমান বলেন, সীমান্ত সড়কটির বিভিন্ন জায়গায় গড়ে উঠেছে পর্যটন কেন্দ্র ও নানা স্থাপনা। সেই সঙ্গে নিরাপত্তা বাহিনীর ক্যাম্প। স্থানীয় পাহাড়ি জনগোষ্ঠী গড়ে তুলেছে কাজুবাদাম, আম, লিচু, কফি, আনারসসহ নানা ফলের বাগান।

বাড়বে নিরাপত্তা : বছরজুড়েই পাহাড়ের দুর্গম এলাকার মানুষকে জিম্মি করে চলে চাঁদাবাজি, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ও নির্যাতন। দুর্গমতার কারণে সেখানকার সাধারণ মানুষ এসব অপরাধীদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে সাহস করে না। সীমান্ত সড়ক নির্মাণ হলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নিয়মিত টহল ও যাতায়াতে স্থানীয়দের সাহস ও আস্থা বাড়বে। তারা সহজেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সহায়তা নিতে পারবে। চাঁদাবাজি, অপহরণ, নির্যাতন, সন্ত্রাসী কার্যক্রম কমে আসবে। ফলে স্থানীয় জনগণের জীবনের নিরাপত্তাও বহুগুণে বেড়ে যাবে।

জেলা হোটেল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন সভাপতি সিরাজুল ইসলাম বলেন, সীমান্ত সড়কটি যুক্ত হবে রুমা উপজেলায় অবস্থিত সাজানো-গোছানো গ্রাম মুনলাই পাড়া, পাহাড়ের চূড়ায় রহস্যময় বগালেক, দার্জিলিংপাড়া, দেশের সবচেয়ে উঁচু গ্রাম পাসিং পাড়া, কেওক্রাডং পাহাড়, মিয়ানমার-ভারত সীমান্ত ঘেঁষা সুংসং পাড়া, রোমানা পাড়া, ধুপানিছড়া আর ভারত-মিয়ানমার-বাংলাদেশের যৌথ ত্রি-সীমানা (তিন মুখ) পিলার। যাওয়া যাবে আকর্ষণীয় প্রাকৃতিক লেক রাইংক্ষ্যং পুকুর। দর্শনীয় স্থানটিতে পর্যটকদের যাতায়াতও প্রতিনিয়তই বাড়ছে।

দূরদূরান্ত থেকে আসছেন দর্শনার্থীরা : স্থানীয় কেওক্রাডং এলাকার ব্যবসায়ী লালা বম ও বাগানচাষি জুয়াল থাং বম বলেন, সীমান্ত সড়কটি ভ্রমণে দূরদূরান্ত থেকে দর্শনার্থীরা ছুটে আসছেন। আগেও পাহাড় চূড়া ভ্রমণে আসতেন পর্যটকরা। তবে এখন মনোরম পরিবেশে পিচঢালা সড়কপথে পর্যটকরা সহজেই ঘুরে বেড়াতে পারছেন। গোটা কেওক্রাডং পাহাড় এলাকায় উৎপাদিত নানা জাতের ফল পরিবহণ করে বিভিন্ন জায়গায় নেওয়া যাচ্ছে। ভ্রমণকারীদের কাছেও বিক্রি করতে পারছি। সড়কটির কারণে দূরদূরান্তের পাড়াবাসীরাও লাভবান হচ্ছে।

সেনাবাহিনীর ২৬ কনস্ট্রাকশন ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল আবু নোমান মো. মইনুল ইসলাম বলেন, দেশের অন্যতম সর্বোচ্চ পর্বত শৃঙ্গের ওপর দিয়ে সড়কটির নির্মাণ কাজ ছিল কঠিন চ্যালেঞ্জের। সড়কটি নির্মাণের সময় সন্ত্রাসী তৎপরতা, বিরূপ আবহাওয়া, দুর্গম যোগাযোগ ব্যবস্থা ও নানা পারিপার্শ্বিক অবস্থায় খুব বেগ পেতে হয়েছিল সেনা সদস্যদের। তবে সব চড়াই-উতরাই পেরিয়ে সড়কটি এখন স্থান করে নিয়েছে দেশের সবচেয়ে উঁচু সড়কে। এটি আমাদের জন্য অনেক বড় পাওয়া। এছাড়াও সীমান্তে পুলিশ, বিজিবির পেট্রোলিং সহজ হওয়ার মাধ্যমে আন্তঃসীমান্ত অস্ত্র চোরাচালান ও সন্ত্রাসীদের চলাচল নিয়ন্ত্রণে এ পার্বত্য সড়ক নেটওয়ার্ক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। এরই মধ্যে স্থানীয় সন্ত্রাসী গ্রুপগুলোর সীমান্ত সড়কের বিরোধিতা থেকে বোঝা যায়, এ সড়ক নেটওয়ার্ক তাদের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে। তিনি আরও বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম সড়কের ফলে রামগড়-সাবরুম, থেগামুখ স্থলবন্দর, ঘুমধুম-মংডু ও মিয়ানমারের চিন রাজ্যের সঙ্গে যোগাযোগ ও বাণিজ্য সুযোগ বাড়বে। সীমান্ত হাটগুলো কার্যকর হতে পারবে। পার্বত্য চট্টগ্রামে ব্যাপকভাবে ব্যবসায়িক ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড সৃষ্টি হবে। আঞ্চলিক বাণিজ্য ও অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র হয়ে উঠবে পার্বত্য চট্টগ্রাম।

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম