গ্রামীণ সাংবাদিকতার পথিকৃৎ
মুছে যাচ্ছে কাঙাল হরিনাথের স্মৃতি
এএম জুবায়েদ রিপন, কুষ্টিয়া
প্রকাশ: ২০ জুলাই ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
কাঙাল হরিনাথ মজুমদার। গ্রামীণ সাংবাদিকতার পথিকৃৎ। ইংরেজ ও দেশের জমিদারদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে ছিলেন প্রতিবাদী। অসহায় ও নিষ্পেষিত মানুষকে রক্ষায় খুব অল্প বয়সেই সাংবাদিকতা পেশাকে হাতিয়ার হিসাবে গ্রহণ করেছিলেন। পূর্ব বাংলার প্রথম পত্রিকা ‘গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা’র জনক কাঙাল হরিনাথ প্রায় পৌনে ২০০ বছর পরও মানুষের মনে জাগ্রত হয়ে আছেন। কিন্তু অযত্ন-অবহেলায় হারিয়ে যাচ্ছে তার স্মৃতিচিহ্ন। বাস্তভিটার ঘরগুলোর দেওয়াল খসে পড়ছে। নষ্ট হয়ে যাচ্ছে কাঙাল কুটিরের ছাপাখানা। এসব রক্ষায় সরকার উদ্যোগ নিলেও তার চতুর্থ বংশধর অশোক মজুমদারের পরিবারের নানা অযৌক্তিক দাবির কারণে তা বাস্তবায়ন হয়নি। অভিযোগ রয়েছে, স্মৃতি জাদুঘরেও নানাভাবে অসহযোগিতা করেছেন তার এই বংশধর।
জানা গেছে, ১৮৩৩ সালের ২২ জুলাই কুষ্টিয়ার কুমারখালীর কুণ্ডুপাড়ায় (ব্রিটিশ ভারতের নদীয়া জেলা) হতদরিদ্র পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন কাঙাল হরিনাথ। তার বাবার নাম হলধর মজুমদার ও মায়ের নাম কমলিনী দেবী। অর্থের অভাবে বেশিদূর পড়াশোনা করতে পারেননি। তবে ছোটবেলা থেকেই খুব প্রতিবাদী ও অসাধারণ প্রতিভাবান ছিলেন। ব্রিটিশ শাসনামলে ১৮৬৩ সালে মাত্র ৩০ বছর বয়সে ‘গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা’ নামের পত্রিকা সম্পাদনা করেন তিনি। সামাজিক সমস্যা, নির্যাতন-নিপীড়ন, শোষণ-অত্যাচার, দুর্নীতিসহ অত্যাচারী ইংরেজ, জমিদার, সরকারি কর্মকর্তা ও মহাজনদের অপকর্মের সংবাদ প্রকাশ করতেন। ১৮৭৩ সালে নিজ বাড়িতে পত্রিকাটির নিজস্ব ছাপাখানা প্রতিষ্ঠা করেন। ১৮ বছর পর আর্থিক সংকট, আইনি জটিলতাসহ বিভিন্ন কারণে বন্ধ হয়ে যায় ছাপাখানাটি। ১৮৯৬ সালের ১৬ এপ্রিল তিনি মৃত্যুবরণ করেন। কাঙাল হরিনাথের বাস্তুভিটায় গিয়ে দেখা যায়, সবশেষ ২০০৯ সালে বাস্তুভিটায় নির্মিত হওয়া একটি ছোট জাদুঘর ও পাঠাগার ভবন (জেলা প্রশাসনের মাধ্যমে)। এ পর্যন্তই শেষ। তারপর আর কোনো উন্নয়ন বা সংস্কারের ছোঁয়া লাগেনি। ইতিহাস-ঐতিহ্যের নিদর্শন প্রাচীন বাংলার প্রথম ছাপাখানাটি অযত্ন-অবহেলায় ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। ঘরের দেওয়াল খসে পড়েছে। জানালা-দরজা, মেঝে ও টিনের ছাউনি নষ্ট হয়ে গেছে। তার বসতবাড়ির জরাজীর্ণ অবস্থা। চারপাশে বিভিন্ন গাছপালার ঝোপ, ময়লা-আবর্জনা স্তূপ।
জানা যায়, এই সেই ছাপাখানা যেখানে পদচারণা ছিল আধ্যাত্মিক সাধক ফকির লালন শাহর। কাঙাল হরিনাথ এখানে বসেই ১ হাজার বাউল গান ও ৩৭টি বই লিখেছেন। তার অনুপ্রেরণা ও সহায়তায় ‘বিষাদ সিন্ধু’র রচয়িতা মীর মশাররফ হোসেন, জলধর সেন, চন্দ্র শেখর করসহ অনেকের মধ্যে সাহিত্যানুরাগ সঞ্চারিত হয়েছিল। স্থানীয়রা বলছেন, এভাবে অবহেলায় পড়ে থাকলে তার স্মৃতিচিহ্ন বিলীন হয়ে যাবে।
কুমারখালীর সাহিত্যিক, সাংবাদিক ও স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তার চতুর্থ বংশধর অশোক মজুমদারের পরিবারের কারণে বাস্তুভিটার এই বেহাল অবস্থা। স্থানীয় যুবক কালাম হোসেন বলেন, পরিবারটি কাঙাল হরিনাথকে কোনো রকম মূল্যায়ন করেনি। এ কারণেই আজ কাঙাল কুটিরের এমন বেহাল অবস্থা। তারা একদিকে সরকারকে কিছু করতে দেয়নি, অন্যদিকে নিজেরাও কাঙাল কুটিরকে আবর্জনার স্তূপ বানিয়ে রেখেছে।
জানা গেছে, ২০১৭ সালে বাস্তুভিটার বাইরে ‘কাঙাল হরিনাথ স্মৃতি জাদুঘর’ (জাতীয় জাদুঘর কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে) নির্মাণকালে একটি কমিটি করা হয়েছিল। তারা চেষ্টা করেছিলেন সরকারি বিধিবিধান মেনে জাদুঘরটি কাঙাল হরিনাথের বসতবাড়িতেই নির্মাণ করতে। কিন্তু অশোক মজুমদারের পরিবারের কিছু অযৌক্তিক দাবির কারণে সেটি করা সম্ভব হয়নি। পরে তার বাস্তুভিটার পাশেই কুমারখালী পৌরসভাসংলগ্ন সরকারি ২৮ শতক জমির ওপর ৮ কোটি টাকা ব্যয়ে জাদুঘর নির্মাণ করে সরকার। এরপরও নানাভাবে অসহযোগিতা করতে থাকে পরিবারটি। কাঙাল হরিনাথের ব্যবহৃত সব স্মৃতিচিহ্ন ও মূল্যবান সম্পদ আটকে রাখেন অশোক মজুমদারের স্ত্রী গীতারানী মজুমদার, দুই ছেলে দেবাশীষ মজুমদার ও দীপংকর মজুমদার। বাধ্য হয়ে ২০১৮ সালে কোনো স্মৃতিচিহ্ন ছাড়াই জাদুঘর উদ্বোধন করা হয়। পরে জাদুঘরে কাঙাল হরিনাথের ব্যবহৃত আসল জিনিসের পরিবর্তে নকল জিনিস প্রদর্শনের আয়োজন করতে বাধ্য হয় কর্তৃপক্ষ। কারণ তার স্মৃতিচিহ্নগুলো জিম্মি করে সরকারের কাছে অযৌক্তিক দাবি করে পরিবারটি। পরিবারটি স্মৃতিচিহ্নগুলো জিম্মি করে সরকারের কাছে পাঁচটি দাবি করে। এগুলো হলো-এক, অশোক মজুমদারের দুই ছেলে ও তাদের বউদের জাদুঘরে চাকরি। দুই, জীবিত থাকা পর্যন্ত তাকে সম্মানি প্রদান। তিন, তার দুই ছেলের জন্য আবাসনের ব্যবস্থা। চার, কাঙাল হরিনাথের ব্যবহৃত কাঙাল কুটির ভবনটি সংস্কার ও সীমানা প্রাচীর নির্মাণ করে দেওয়া। পাঁচ, কাঙাল হরিনাথের সমাধিঘরটি মেরামত করা।
তবে এসব অভিযোগ অস্বীকার করে দেবাশীষ মজুমদার বলেন, পুরাতন ছাপাখানা ও বাস্তুভিটা যতদিন যাচ্ছে তত নষ্ট হচ্ছে। যতদিন যাবে তত নষ্ট হবে। আমাদের কি করার আছে। আমাদের কোনো দাবি নেই, আমাদের বলারও কোনো কিছু নেই। সরকারকে সেখানে জাদুঘর করতে বা সংরক্ষণ করতে কখনো বাধা দিইনি। আমাদের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ মিথ্যা।
এদিকে স্মৃতি জাদুঘর নির্মাণের ৫ বছর পর ২০২৩ সালে ওই পরিবারের সঙ্গে জাতীয় জাদুঘর কর্তৃপক্ষের একটি চুক্তি স্বাক্ষর হয়। সেই চুক্তিমতে চতুর্থ বংশধর অশোক মজুমদারের ছেলে ও ছেলের বউকে চাকরি এবং নগদ ২০ লাখ টাকা দিতে হবে। চুক্তি অনুযায়ী দুজনকে চাকরি ও নগদ টাকা নিয়ে ছাপাখানার মেশিনসহ যন্ত্রাংশ জাদুঘরের কাছে হস্তান্তর করে ওই পরিবার।
কাঙাল হরিনাথ প্রেস ক্লাবের সভাপতি কেএম আর শাহিন বলেন, কাঙাল হরিনাথের গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা পত্রিকা ভারত উপমহাদেশের প্রথম বাংলা পত্রিকা। সে সময় মথুরানাথ মুদ্রণ যন্ত্র নামে একটি ছাপাখানাও তিনি প্রতিষ্ঠা করেন। সে মেশিনটি বাস্তুভিটা থেকে জাদুঘরে আনা হয়েছে একটি চুক্তির মাধ্যমে।
স্মৃতি জাদুঘরের রেপ্লিক ম্যানুফ্যাকচারার ও ইনচার্জ তাপস কুমার মন্ডল বলেন, কাঙাল হরিনাথের অনেক নিদর্শন স্থানীয় কিছু ব্যক্তিবর্গের কাছে সংরক্ষিত আছে। এগুলো সংগ্রহ করতে পারলে আমাদের জাদুঘরের গ্যালারিটা আরও সমৃদ্ধ হতো। আপনাদের সহযোগিতায় সেগুলো পেলে খুব ভালো হয়।
