Logo
Logo
×

শেষ পাতা

শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন সংগ্রহশালা

শিল্পচর্চার বাতিঘর

Icon

আতাউল করিম খোকন, ময়মনসিংহ

প্রকাশ: ২১ জুলাই ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

শিল্পচর্চার বাতিঘর

শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন বাংলাদেশে আধুনিক চিত্রকলার পথিকৃৎ, শিক্ষক ও সংগঠক। যার নাম শুনলেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে ১৯৪৩-র দুর্ভিক্ষের ছবি, রেখাচিত্রে আঁকা গরু, গরুর গাড়ি ও সাঁওতাল রমণীর ছবি। তিনি তুলির ছোঁয়ায় তুলে ধরেছেন নিঃশব্দ প্রতিবাদের ভাষা আর মানবিক চেতনার চিরন্তন ছাপ। তার এসব অমর সৃষ্টিকর্মগুলো প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে পৌঁছে দিতে শিল্পীর শৈশব-কৈশোরের স্মৃতিবিজড়িত ব্রহ্মপুত্র নদের তীরে গড়ে তোলা হয়েছে ‘শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন সংগ্রহশালা’। এটি এখন শিল্পচর্চার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। শিল্পীর আঁকা ছবি দেখতে প্রতিদিন ভিড় করছেন শিক্ষার্থীসহ চিত্রকলাপ্রেমীরা।

জানা যায়, সংগ্রহশালার ভবনটি ছিল বার্টন নামে একজন ব্রিটিশ পাট ব্যবসায়ীর। পরবর্তীতে তৎকালীন রাজনীতিক যুক্তফ্রন্ট সরকারের অর্থমন্ত্রী নলিনী রঞ্জন সরকার বাড়িটি ক্রয় করেন। দেশ ভাগের পর তিনি বাড়িটি ছেড়ে চলে গেলে অর্পিত সম্পত্তি হিসাবে সরকারি কাজে ব্যবহৃত হতে থাকে। একপর্যায়ে জয়নুলের স্মৃতি ধরে রাখতে সেখানে সংগ্রহশালা প্রতিষ্ঠা করা হয়। ১৯৭৫ সালে বাংলাদেশের তৎকালীন উপ-রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম এ সংগ্রহশালা উদ্বোধন করেন।

দীর্ঘদিন এটি ময়মনসিংহ জেলা প্রশাসনের মাধ্যমে পরিচালিত হয়। ১৯৯৯ সাল থেকে এটি জাতীয় জাদুঘরের অধীনে পরিচালিত হয়ে আসছে। দেশব্যাপী শিল্পাচার্যের বিভিন্ন শিল্পকর্ম সংগ্রহ করে এখানে সংরক্ষণ করা হয়। শিল্পাচার্যের আঁকা ৭০টি চিত্রকর্ম নিয়ে সংগ্রহশালার যাত্রা শুরু হলেও বর্তমানে এখানে ১৮৯টি মৌলিক শিল্পকর্ম এবং একটি শিল্পকর্মের ডিজিটাল অনুকৃতি রয়েছে। আছে শিল্পাচার্যের ব্যবহৃত ৮০টি নিদর্শন, ৫৩টি আলোকচিত্র, জয়নুলের জীবন বৃত্তান্ত। ১৯৮২ সালে সংগ্রহশালা থেকে ১৭টি বিখ্যাত চিত্রকর্ম চুরি হয়ে যায়। পরবর্তীতে দশটি চিত্রকর্ম পাওয়া গেলেও বাকি সাতটি চিত্রকর্ম আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। বর্তমানে সংগ্রহশালাটি সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন জাতীয় জাদুঘরের একটি শাখা হিসাবে পরিচালিত হচ্ছে।

সরেজমিন সংগ্রহশালাটি ঘুরে দেখা যায়, দোতলা ভবন। দ্বিতীয় তলায় ৩টি গ্যালারিতে শিল্পাচার্যের শিল্পকর্ম, ব্যক্তিগত নিদর্শন ও আলোকচিত্র প্রদর্শিত হচ্ছে। নিচতলায় দাপ্তরিক কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত তিনটি গ্যালারির মধ্যে প্রথমটিতে ৫৩টি আলোকচিত্র, জয়নুলের সংক্ষিপ্ত জীবনবৃত্তান্ত, সংগ্রহশালার কি-লেভেল এবং জয়নুলের একটি পোট্রেট প্রদর্শিত হচ্ছে। দ্বিতীয় গ্যালারিতে রয়েছে ৩০টি মৌলিক শিল্পকর্ম ও একটি ডিজিটাল অনুকৃতি। এছাড়াও শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের ব্যবহৃত স্ক্রেইপার ১টি, স্প্যাচুলা ৩টি, স্ক্রাচার ১টি, ব্রাশ ২৮টি, কালার প্যালিট ১টি, তারপিন তেলের বোতল ৩টি এবং রংয়ের ২১টি টিউব প্রদর্শিত করা হয়েছে। তৃতীয় গ্যালারিতে রয়েছে মোট ৩১টি মৌলিক শিল্পকর্ম।

এছাড়াও জয়নুল আবেদিনের ব্যবহৃত ঈজেল ১টি, কাঠের খাট ১টি, রেদার ব্যাগ ১টি, প্যালিকেন কালির দোয়াত ২টি, খাগের কলম ২টি, মেটাল ক্লিপ ২টি, মোম ১টি, চশমা ১টি, কাঠ কয়লা ৬ টুকরা, ব্রাশ হোল্ডার ১টি এবং ২ জোড়া জুতা প্রদর্শিত হয়েছে।

সংগ্রহশালার মূল ফটকের সামনেই রয়েছে পাথর নির্মিত জয়নুল আবেদিনের ভাস্কর্য। সংগ্রহশালার উত্তরে ব্রহ্মপুত্র নদ, দক্ষিণে রয়েছে সরকারি কর্মকর্তাদের বাসভবন, সামনে অর্থাৎ পূর্বে জয়নুল আবেদিন পার্ক ও পশ্চিমে অর্থাৎ পেছনে রয়েছে আবাসিক এলাকা। সংগ্রহশালাটি চারদিকে ইট লোহার দেওয়াল দ্বারা বেষ্টিত এবং মূল ফটক লোহার তৈরি। মূল ভবনের সামনে ব্রোঞ্জ নির্মিত শিল্পাচার্যের আরেকটি ভাস্কর্য রয়েছে। এখানে রয়েছে ছোট একটি মাঠ। মাঠের দক্ষিণ পাশে রয়েছে একটি মঞ্চ। এখানে পহেলা বৈশাখসহ বিভিন্ন দিবসে শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। মূল ভবনের চারপাশে বিভিন্ন রঙিন ফুল ও পাতাবিশিষ্ট গাছের বাগান থাকায় মনোরম পরিবেশ বিরাজ করে।

দর্শনার্থীরা জানান, সংগ্রহশালা ঘুরে দেখার অনুভূতি অসাধারণ, যা ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়। মনোমুগ্ধকর পরিবেশে শিল্পাচার্যের অমর সৃষ্টি দেখে যে কেউ অভিভূত হবে।

সংগ্রহশালার উপ-কিপার মুকুল দত্ত যুগান্তরকে জানান, সংগ্রহশালাটি দেখতে প্রতিদিন গড়ে দুইশ দর্শনার্থী আসেন। শনি থেকে বুধবার প্রতিদিন সকাল সাড়ে ১০টা থেকে বিকাল সাড়ে ৫টা পর্যন্ত জাদুঘর দর্শনার্থীদের জন্য খোলা থাকে। শুক্রবার খোলা থাকে বেলা ৩টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত। টিকিটের মূল প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য ২০ টাকা, শিশুদের জন্য ১০ টাকা, সার্কভুক্ত দর্শকদের জন্য ৩০০ টাকা এবং বিদেশি দর্শকদের জন্য ৫০০ টাকা। তিনি জানান, এখানে জয়নুল শিশু চারুপীঠে শিশু-কিশোরদের সৃজনশীল প্রতিভা বিকাশ এবং চারুকলা শিক্ষার ব্যবস্থা রয়েছে। প্লে থেকে দশম শ্রেণির ছাত্রছাত্রীদের চারুকলা শিক্ষা দেওয়া হয়। এছাড়া শিল্পীদের চিত্রকলা চর্চা এবং অবকাশ যাপনের জন্য এখানে একটি তিন কক্ষ বিশিষ্ট কটেজ আছে।

মুকুল দত্ত বলেন, শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের উল্লেখযোগ্য শিল্পকর্মের মধ্যে রয়েছে-দুর্ভিক্ষ, শম্ভুগঞ্জঘাট, ফসল মাড়াই, মই দেয়া, কালবৈশাখী, খেয়াপাড়, ঝড়ের মুখে, গুণটানা, নদী ও জেলে নৌকা। শিল্পী জয়নুলের অসংখ্য শিল্পকর্ম আন্তর্জাতিক অঙ্গনে প্রশংসিত হয়েছে। এমন আরও কয়েকটি চিত্রকর্ম কাক, মাছ ধরা, গেরিলা, কেশ বিন্যাস, দুই বোন, সাঁওতাল দম্পতি, বিদ্রোহ, সংগ্রাম, নবান্ন ও মনপুরা-৭০ ইত্যাদি।

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম