এক দশকে বিএসএফের হাতে নিহত দুই শতাধিক
পদ্মার চরাঞ্চল সীমান্ত যেন ‘মৃত্যু উপত্যকা’
রাজশাহী ব্যুরো
প্রকাশ: ০৩ আগস্ট ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
টাকার লোভে সীমান্ত অতিক্রম করে নদীপথে সাঁতরে গরু-মহিষ আনতে গিয়ে অকাতরে প্রাণ দিচ্ছে বাংলাদেশি রাখালরা। পদ্মায় ভাসিয়ে চোরাচালানের গরু আনতে গিয়ে বিএসএফের পাতা ফাঁদে প্রাণ দিচ্ছে রাখালরা। বর্ষায় যখন পদ্মা ভরে যায় তখন প্রতিবছরই এভাবে বিএসএফের গুলি ও নির্যাতনে প্রাণ হারায় অসংখ্য বাংলাদেশি রাখাল, যার কোনো হিসাব নেই। রাখালরা প্রাণ হাতের মুঠোয় নিয়ে জীবন বাজি রেখে সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতে ঢুকে পড়ে। পদ্মায় গরু-মহিষ ভাসিয়ে ফেরার পথে কেউ কপালগুণে সাঁতরে কূলে উঠতে পারে, আবার অনেকেই আর কোনো দিনই ঘরে ফেরে না। এরপর নিহত রাখালদের পরিবারে শুরু হয় আজীবনের কান্না আর আহাজারি।
স্থানীয়দের মতে, ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী-বিএসএফের হাতে দেশের সবচেয়ে বেশি হতাহতের ঘটনা ঘটে চাঁপাইনবাবগঞ্জের পদ্মার চরাঞ্চলের ২৫ কিলোমিটার ভয়ংকর এই সীমান্তে। বিএসএফ আটক বাংলাদেশি রাখালদের নৃশংসভাবে নির্যাতন চালিয়ে হত্যা করে। জানাজানি হলে কখনো লাশ ফেরত দিয়ে থাকে। কখনো গোপনে বাংলাদেশিদের লাশ পদ্মায় ভাসিয়ে দেয়।
জানা গেছে, চাঁপাইনবাবগঞ্জের ২৫ কিলোমিটার দীর্ঘ নদী সীমান্তে বাংলাদেশি রাখালদের হতাহত ও নিখোঁজের ঘটনা নিত্যদিনকার ঘটনায় পরিণত হয়েছে। এলাকাবাসীর মতে, চাঁপাইনবাবগঞ্জে পদ্মার তীরবর্তী দুর্গম চরাঞ্চলের এই ২৫ কিলোমিটার সীমান্ত ভয়ংকর এক ‘মৃত্যু উপত্যকা’। মূলত, ভাড়ায় গরু ও মাদক আনতে জীবন বাজি রেখে বাংলাদেশি কিশোর-যুবকরা সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতে যাচ্ছে। বিএসএফের গুলি ও নির্যাতনে তারা যখন লাশ হয়ে ফেরে, তখন ঘটনা জানাজানি হয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নিহত রাখালদের লাশ গোপনে কবর দেওয়া হয়। সীমান্ত ফাঁড়ির বিজিবি ও থানা পুলিশ কিছুই জানতে পারে না। এলাকাবাসীর আরও অভিযোগ, সীমান্তের এই জীবন-মরণ খেলা বন্ধ হবে না যদি না মানুষকে সচেতন করা যায়।
এদিকে চাঁপাইনবাবগঞ্জের ভয়ংকর এই ২৫ কিলোমিটার নদী সীমান্তে রয়েছে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) সক্রিয় ৫টি ফাঁড়ি। কিন্তু তারা এই ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত অনুপ্রবেশ ঠেকাতে ব্যর্থ হচ্ছে। যদিও বিজিবির স্থানীয় কর্মকর্তারা বরাবরই দাবি করে আসছেন তারা অনুপ্রবেশ ঠেকাতে সাধ্যমতো সব ধরনের পদক্ষেপই নিয়ে থাকেন। কিন্তু পদ্মার চরাঞ্চলের দুর্গম এই সীমান্তে সার্বক্ষণিক টহল পরিচালনা অনেক কঠিন কাজ। এসব সীমান্ত এলাকায় নেই সড়কপথ। রাত নামলেই ডুবে যায় অন্ধকারে। এই ফাঁকে রাখালরা হয়তো ভারতে ঢুকে পড়ে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কয়েক বছর আগে চাঁপাইনবাবগঞ্জের বাখের আলী, জোহরপুর টেক, জোহরপুর, ওয়াহেদপুর, ফতেপুর ও রঘুনাথগঞ্জ সীমান্ত ফাঁড়ি এলাকায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় অনুমোদিত করিডর ব্যবস্থা ছিল। তখন বিএসএফের সম্মতিতেই আসত গরু-মহিষ। ভারত থেকে আসা গরু-মহিষ শুল্ক পরিশোধের মাধ্যমে বৈধ করার একটি সাময়িক ব্যবস্থা চালু ছিল। কিন্তু ২০১৮ সালের পর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় করিডর ব্যবস্থা বাতিল করে। তখন থেকে চোরাইপথে ভারত থেকে গরু-মহিষ আনার প্রবণতা বাড়তে থাকে। পাশাপাশি এই সীমান্তে বিএসএফের গুলিতে ও নির্যাতনে হতাহতের সংখ্যাও বাড়ে।
খোঁজ নিয়ে আরও জানা গেছে, চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর উপজেলার বাখের আলী, সুন্দরপুর, জোহরপুর নারায়ণপুর, শিবগঞ্জ উপজেলার বিশরশিয়া, দশরশিয়া, গাইপাড়া, খাঁকচাপাড়া সীমান্ত এলাকায় গড়ে উঠেছে গরু ও মাদক পাচার সিন্ডিকেট। গরু ও মাদক আনতে তারা যুবক-তরুণদের সঙ্গে মোটা অঙ্কের টাকায় মৌখিক চুক্তি করছে। এক জোড়া গরু পদ্মায় ভাসিয়ে আনতে পারলে দেওয়া হয় ৩০ থেকে ৪০ হাজার টাকা। মাদকের চালান আনতে পারলে দেওয়া হয় ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকা। সিন্ডিকেটের সদস্যরা গভীর রাতে পদ্মার মাঝখানে নৌকা ভাসিয়ে অপেক্ষা করতে থাকে। সংকেত পেলে রাখালসহ গরু নিয়ে কূলে উঠে যায়।
গরু সিন্ডিকেটের একজন সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ভারতে এক জোড়া গরু বা মহিষের দাম ৪০ থেকে ৫০ হাজার টাকা। গরু ভাসিয়ে আনা রাখালদের আরও ৩০ হাজার টাকা দিয়ে মোট দাম পড়ে ৮০ থেকে ৯০ হাজার টাকা। এই এক জোড়া গরু শিবগঞ্জের তক্তিপুর হাটে উঠালেই বিক্রি হয় দুই থেকে আড়াই লাখ টাকায়। অন্য খরচ মিটিয়েও একেকটি গরুতে লাভ হয় ৮০ থেকে ৯০ হাজার টাকা। পদ্মায় গরু ভাসিয়ে আনার এই ব্যবস্থা মরণখেলা।
জানা যায়, চাঁপাইনবাবগঞ্জের এই সীমান্ত এলাকা বর্ষাকালে বিচ্ছিন্ন দ্বীপে পরিণত হয়। জেলার মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে যোগাযোগে আট কিলোমিটার প্রশস্ত পদ্মা নদী পাড়ি দিতে হয়। পদ্মার পেটের ভেতরে থাকা সীমান্তের ২৫টি চরগ্রামে লক্ষাধিক মানুষ বসবাস করে। টাকার লোভে এসব গ্রামের যুবক-তরুণরা রাতের আঁধারে সীমান্ত পেরিয়ে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলার হাসানপুর, নুরপুর, ছাপঘাটি, জঙ্গিপুর প্রভৃতি সীমান্ত গ্রামে গিয়ে উঠে। সড়কপথ বেয়ে তারা ফারাক্কার চার কিলোমিটার ভাটিতে ভারতের ধুলিয়ান ঘাটে গরু-মহিষ নিয়ে অপেক্ষা করে। রাত বাড়লেই তারা গরু-মহিষ নিয়ে পদ্মায় ঝাঁপ দেয়। পদ্মার তীব্র স্রোতে ভাটিতে ভেসে বাংলাদেশের জলসীমা ও তীরে উঠতে তাদের সময় লাগে ৩০ থেকে ৪৫ মিনিট। ভাগ্যক্রমে দু-একজন ভেসে বাংলাদেশে আসতে পারলেও অনেকেই বিএসএফের হাতে মাঝ নদীতেই ধরা পড়ে যায়। তখন তাদের বরণ করতে হয় নির্ঘাত মৃত্যু। বিএসএফ ধরা পড়া রাখালদের ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে বা রাইফেলের বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে নৃশংস কায়দায় হত্যা করে লাশ মাঝ নদীতে ভাসিয়ে দেয়। বিএসএফ কখনো কখনো হত্যার পর রাখালদের লাশের সঙ্গে বড় পাথর বেঁধে ডুবিয়ে দেয়। ওই সব লাশ আর কখনোই কেউ খুঁজে পায় না। কখনো কখনো কারও কারও লাশ পদ্মার ভাটিতে ভেসে উঠে। পরিবারের সদস্যরা লাশ নিয়ে গোপনে কবর দেন।
চরাঞ্চলের স্থানীয় একাধিক জনপ্রতিনিধি নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, ২০১৪ সাল থেকে অদ্যাবধি গরু ও মাদক আনতে গিয়ে এই সীমান্তে দুশতাধিক বাংলাদেশি বিএসএফের হাতে নিহত হয়েছে। নিহতদের অধিকাংশেরই কোনো রেকর্ড নেই। গত ২৮ জুলাই রাতে গরু ভাসাতে গিয়ে ধরা পড়ে বিএসএফের নির্যাতনে নিহত হয় চরাঞ্চলের মতিউর রহমানের ছেলে সৈবুর রহমান (২৮)। গত ৩১ জুলাই সৈবুরের ক্ষত-বিক্ষত লাশ পাওয়া যায় পদ্মার গোদাগাড়ী এলাকায়। গত ৩১ জুলাই সৈবুরের লাশ গোপনে দাফন করে পরিবার। এই ঘটনার তিন দিন আগে সীমান্ত অতিক্রম করে গরু আনতে গিয়ে বিএসএফের হাতে ধরা পড়ে বিশরশিয়া গ্রামের ধুলুর ছেলে বেনজির আলী (২৬)। শনিবার দুপুরে বেনজিরের পরিবারের সঙ্গে কথা বললে তারা জানায়, বেনজিরের কোনো খোঁজ পায়নি পরিবার। এর আগে গত ১৯ জুলাই রাতে জোহরপুর সীমান্তে বিএসএফের হাতে নিহত হয় লাল চাঁন মিয়া (৩০)। নাচোল উপজেলার নেজামপুর গ্রামের জেবেল আলীর ছেলে লালচাঁন গরু আনতে গিয়ে বিএসএফের হাতে নিহত হয়। গোপনে লাশ এনে দাফন করে পরিবার। এদিকে এর আগে বিশরশিয়া চরাঞ্চলের ভাসাই আলীর ছেলে লুটু (৩৫), বাসিশের ছেলে মহসিন (২৫), দবিবুরের ছেলে বাসির আলী (২৩), নারায়ণপুর গ্রামের আব্দুল্লাহ (৪০), নিশিপাড়া চরের মংলু আলীর ছেলে ডালিম (২৪), দশরশিয়া গ্রামের বেলাল হোসেনের ছেলে সফিকুল (৩৫), সাতরশিয়া গ্রামের আমিরুলের ছেলে মাতিন (২৫), কালুপুর গ্রামের হাবিবুর রহমান হাবু (৩৫), বুলুর ছেলে আলমগীর (২৮) বিএসএফের গুলিতে নিহত হন।
স্থানীয়রা আরও জানান, ২০১৪ সাল থেকে ২০২৫ সালের জুলাই পর্যন্ত চরাঞ্চলের এই সীমান্তে দুশতাধিক বাংলাদেশি নিহত হয়েছে। জানতে পেরে বিজিবি প্রতিবাদ করলে বিএসএফ কারও কারও লাশ ফেরত দিলেও নিহত অধিকাংশেরই লাশ ফেরত দেওয়া হয়নি।
সীমান্তের এই ভয়ংকর পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে চাইলে চাঁপাইনবাবগঞ্জের ৫৩ বিজিবি ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লে. কর্নেল ফাহাদ মাহমুদ রিংকু বলেন, চাঁপাইনবাবগঞ্জের পদ্মার পেটে থাকা চরাঞ্চলের এই সীমান্ত এলাকাটি অত্যন্ত দুর্গম, যা মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন। সীমান্ত অতিক্রমের বিষয়ে বিজিবি সর্বদা কঠোর নজরদারি করছে। কিন্তু বর্ষাকালে গোটা চরাঞ্চলে চলাচলের কোনো রাস্তা থাকে না। দুর্গম এলাকায় রাতের আঁধারে কে কীভাবে কখন সীমান্তের কাছে যায় টের পাওয়া যায় না। গরু-মহিষ ভাসাতে গিয়ে কেউ হতাহত হলে পরিবার বা এলাকাবাসী বিজিবিকে কোনো তথ্য দেয় না। গরু চোরাচালান এখন অতি লাভজনক হওয়ায় টাকার লোভে অনেকেই যাচ্ছে। বিজিবি অনুপ্রবেশ রোধে সার্বক্ষণিক কাজ করছে।
