Logo
Logo
×

শেষ পাতা

স্মৃতিমেদুর আসাদ

রক্তমাখা সেই শার্ট এবং প্রিয়তমাকে লেখা চিঠি

Icon

গাজী সাদেক

প্রকাশ: ১৫ আগস্ট ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

রক্তমাখা সেই শার্ট এবং প্রিয়তমাকে লেখা চিঠি

স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশে সরকার গঠনকারী দলগুলো নিজেদের রাজনৈতিক দলের প্রধানকে একক ও প্রধান নেতৃত্ব হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করেছে। যে কারণে অন্যসব রাজনৈতিক নায়করা দুঃখজনকভাবে আড়ালে থেকে গেছেন। তাদেরই একজন আমানুল্লাহ মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান (আসাদ)।

তিনি যেই আন্দোলনে প্রাণ দিয়েছেন, সেই আন্দোলনে আইয়ুব খানের মতো স্বৈরাচারের পতন হয়েছিল। ওই আন্দোলনে পুলিশের গুলিতে আসাদের মৃত্যু গণ-আন্দোলনের আগল খুলে সারা দেশে বিক্ষোভের স্ফুলিঙ্গ ছড়িয়ে দিয়েছিল; যা অনেকটা নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থানে নূর হোসেন কিংবা চব্বিশের জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে প্রাণ দেওয়া আবু সাঈদের মতোই।

ওই সময় শহীদ আসাদের রক্তমাখা শার্ট হয়ে উঠেছিল এ জাতির প্রাণের পতাকা। প্রিয়তমাকে লেখা শেষ চিঠিটিও এ জাতির অনুপ্রেরণার অন্যতম অনুষঙ্গ। আসাদ শহীদ হওয়ার কিছুদিন আগে শেষ চিঠিতে তার প্রিয়তমাকে লেখেন-‘লক্ষ্মীটি..., হয়ত ভাববে এসবই আমার অলস মস্তিষ্কের উদ্ভট কল্পনা, কিন্তু এটা স্থির নিশ্চিত জেনো-এদেশ একদিন এ সমস্ত কৃষক শ্রমিক মেহনতী মানুষেরই হবে।’

কিন্তু কবে? সেই প্রশ্নও রেখে গেছেন চিঠির শেষাংশে।

আসাদের রক্তমাখা শার্ট উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানপরবর্তী মুক্তিযুদ্ধকে ত্বরান্বিত করেছিল এবং নব্বই ও চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থানে ছাত্র-জনতার বিজয় নিশান হয়ে পথ দেখিয়েছে। সেই শার্টটি আজও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর কিংবা জাতীয় জাদুঘরে স্থান পায়নি। দেশ স্বাধীন হওয়ার ৫৪ বছর পরও আসাদের আত্মত্যাগের যথাযথ রাষ্ট্রীয় মূল্যায়ন হয়নি। তার অবদান ক্রমেই মানুষের স্মৃতি থেকে ম্লান হচ্ছে, হারিয়ে যাচ্ছে স্মৃতিচিহ্নও।

১৯৯১ সালে ডাকসুর উদ্যোগে ঢাকা মেডিকেল কলেজের জরুরি বিভাগের প্রবেশপথের পাশে ‘গণজাগরণ’ নামে ভাস্কর্য স্থাপন করা হলেও সেটি পরবর্তীকালে উধাও হয়ে যায়। এরপর আর পুনঃস্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। চানখাঁরপুল মোড়ে প্রস্তাবিত শহীদ আসাদ স্মৃতি জাদুঘরের কাজও অসমাপ্ত। একইভাবে আসাদ গেট ও আসাদ অ্যাভিনিউ সংস্কারেও কোনো উদ্যোগ নেই।

শহীদ আসাদ ১৯৪২ সালের ১০ জুন নরসিংদীর হাতিরদিয়ায় জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা মৌলবি মোহাম্মদ আবু তাহের ছিলেন একজন ধর্মপ্রাণ শিক্ষক, মা মতি জাহান খাদিজা খাতুন ছিলেন ইসলামিক ট্রাস্ট স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা প্রধান। ছয় ভাই ও দুই বোনের মধ্যে আসাদ ছিলেন চতুর্থ। ১৯৬৯ সালের ২০ জানুয়ারি পাকিস্তানি স্বৈরশাসক আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে মিছিলে নেতৃত্ব দিতে গিয়ে পুলিশের গুলিতে ঢাকা মেডিকেল কলেজের প্রধান ফটকের সামনে শহীদ হন আসাদ।

২০১৮ সালে তাকে মরণোত্তর স্বাধীনতা পদক দেওয়া হয়। ৯ আগস্ট (শনিবার) সকাল ১০টায় সরেজমিন নরসিংদীর শিবপুরের ধানুয়া গ্রামে শহীদ আসাদের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায় সুনসান নীরবতা, যেন স্তব্ধ পুরো পরিবেশ। বাড়িতে পাওয়া যায় মো. রাকিন নামে আসাদের চাচাতো ভাইয়ের এক নাতিকে, তিনি আসাদের বেড়ে ওঠা বাড়িটি ঘুরে দেখান। পরিত্যক্ত বাড়ির একটি কক্ষে মিনারা বেগম নামে এক বৃদ্ধা থাকেন।

আসাদের সমাধিসংলগ্ন গড়ে উঠেছে মসজিদ ও হাফিজিয়া মাদ্রাসা। বেলা ১১টায় শিবপুর বাজারে কথা হয় শহীদ আসাদের চাচাতো ভাই তমিজউদ্দিনের নাতি মো. আবিদুল হক ত্বকির সঙ্গে। তিনি বলেন, আসাদের সমাধিতে প্রায় প্রতিদিন নানা শ্রেণির মানুষ শ্রদ্ধা জানাতে আসেন। বিশেষ করে, ২০ জানুয়ারি বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে শ্রদ্ধা জানানো হয়। তবে প্রশাসনিকভাবে কোনো আয়োজন বা খোঁজখবর নেওয়া হয় না।

২০১৮ সালে পরিবারের উদ্যোগে শেষবার আসাদ স্মৃতি ফুটবল ও ক্রিকেট টুর্নামেন্টের আয়োজন হয়েছিল, এরপর থেকে তেমন কার্যক্রম হয়নি। ইউএনও ফারজানা ইয়াসমিন শহীদ আসাদ দিবসের কর্মসূচি নিয়ে মোবাইলে মন্তব্য করতে রাজি হননি। আসাদের বাড়ি যাওয়ার রাস্তার উন্নয়নে স্থানীয় জনপ্রতিনিধির মাধ্যমে প্রস্তাব পাঠানোর আশ্বাস দিয়েছেন। এদিন সকাল ৯টায় সরকারি শহীদ আসাদ কলেজের গেটে কয়েকজন শিক্ষার্থীর সঙ্গে কথা হলে তারা আসাদের শহীদ হওয়ার সময়, স্থান ও কারণ সঠিকভাবে বলতে পারেননি। পরে ক্যাম্পাস ঘুরে দেখা যায়, অফিস ও স্টাফকক্ষে আসাদের ছবি ছাড়া আর কোনো স্মৃতিচিহ্ন নেই।

অধ্যক্ষ অধ্যাপক নাসির উদ্দিন জানান, প্রতিবছর নবীনবরণে শিক্ষার্থীদের শহীদ আসাদের ভূমিকা ও অবদান সম্পর্কে জানানো হয়। সামনে ধাপে ধাপে ‘আসাদ শরবত’ নামে পুকুর সংস্কার, প্রধান ফটকে আসাদ স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ ও গ্রন্থাগার সংস্কার করা হবে। বেলা সাড়ে ১১টায় শহীদ আসাদ কলেজিয়েট গার্লস হাইস্কুল অ্যান্ড কলেজে গিয়ে দেখা মেলে শহীদ আসাদের রাজনৈতিক সহকর্মী ও তার তিন বছরের অনুজ আবুল হারিস রিকাবদার (কালামিয়া)-এর।

১৯৮৭ সালে তিনি নিজ এলাকায় প্রতিষ্ঠানটি গড়ে তোলেন, যেখানে আসাদের নামে দেশের একমাত্র স্মৃতিস্তম্ভ রয়েছে। কালামিয়া বর্তমানে শিবপুর উপজেলা বিএনপির সভাপতি। তিনি বলেন, একই গ্রামে বাড়ি হওয়ায় আসাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ চলাফেরা ছিল। আসাদের বাবা ছিলেন মনোহরদীর হাতিরদিয়া ছাদত আলী হাইস্কুলের প্রতিষ্ঠাতা হেডমাস্টার। ওই স্কুলের হেডমাস্টার কোয়ার্টারেই আসাদের জন্ম। তবে তার শৈশব কেটেছে শিবপুরে ধানুয়া গ্রামের পৈতৃক ভিটায়।

রক্ষণশীল পরিবারে বেড়ে ওঠা আসাদ রাজনীতিতে জড়াবেন, সেটা শুরুতে টের পাননি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন আসাদ রাজনীতিতে সক্রিয় হন এবং ছিলেন মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর অনুসারী। ১৯৬৭ সালে ভাসানীর নির্দেশ ও আবদুল মান্নার ভূঁইয়ার পরামর্শে আসাদ গ্রামে ফিরে আসেন। সেই সময়ে আসাদের নেতৃত্বে কালামিয়াসহ অন্যরা কৃষকের অধিকার সম্পর্কে তাদের সচেতন করেন এবং সংগঠিত করেন।

এক বছরের মধ্যে তারা শিবপুর, মনোহরদী, রায়পুরা, বেলাব ও নরসিংদী সদরের কৃষক নিয়ে সফল সমিতি গড়ে তোলেন। তিনি আরও বলেন, ১৯৬৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর রাজবন্দিদের মুক্তি ও পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে মওলানা ভাসানী ‘হাট হরতাল’-এর ডাক দেন। তখন মনোহরদীর হাতিরদিয়ায় আসাদের নেতৃত্বে কর্মসূচি পালিত হয়। পুলিশ কয়েকজন সহকর্মীকে গ্রেফতার করলে মুক্তির দাবিতে সংঘর্ষ বাধে। এতে পুলিশের গুলিতে তিনজন নিহত ও আসাদ মাথায় আঘাতপ্রাপ্ত হন। তবুও তিনি সাইকেলে ঘোড়াশাল এবং সেখান থেকে ট্রেনে ঢাকায় গিয়ে ঘটনাটি পরদিন জাতীয় দৈনিকে প্রকাশ করান। এরপর আসাদের সঙ্গে আর যোগাযোগ হয়নি।

শহীদ আসাদের আরেক রাজনৈতিক সহযোদ্ধা ছিলেন তোফাজ্জল হোসেন মাস্টার, তিনি বর্তমানে নরসিংদী জেলা বিএনপির সহসভাপতি। দুপুর ১২টায় দলীয় অফিসে স্মৃতিচারণা করে বলেন, আসাদ তার বড় ভাইয়ের মতো ছিলেন। হাতিরদিয়ায় ‘হাট হরতাল’ পালনকালে তিনি নিজে ও আরও দুজন পুলিশের হাতে আটক হন। এরপর তারা নারায়ণগঞ্জ কারাগারে ছিলেন। ১১ দিন পর জামিনে মুক্তি পেলে জেলগেটে তাদের ফুল দিয়ে বরণ করেন আসাদ। ওই মামলায় ১৯৬৯ সালের ১৭ জানুয়ারি কোর্টে হাজিরা দিতে গেলে আসাদও সেখানে আসেন। সেদিনই ছিল তার শেষ দেখা।

১০ আগস্ট (রোববার) শহীদ আসাদের ছোট ভাই, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক পরিচালক ডা. এএম নুরুজ্জামান সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত প্রতিবেদককে ঢাকার আসাদ গেট, আসাদ অ্যাভিনিউ, আসাদ স্মৃতিস্তম্ভ ও আসাদ স্মৃতি জাদুঘর ঘুরে দেখান। তিনি বলেন, ‘আসাদের আত্মত্যাগের যথাযথ রাষ্ট্রীয় মূল্যায়ন হয়নি। এ কারণেই তার রক্তাক্ত শার্ট পরিবারের কাছে সংরক্ষিত।’

ডা. নুরুজ্জামান বলেন, তাদের পরিবার কখনো আসাদকে কেন্দ্র করে ব্যক্তিগত বা রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের চেষ্টা করেনি। তাই রাষ্ট্রের কাছে তাদের কিছু দাবি রয়েছে, সেগুলো হলো-শহীদ আসাদের জীবনী আবারও পাঠ্যবইয়ে অন্তর্ভুক্ত করা। ঐতিহাসিক আসাদ গেট ও আসাদ অ্যাভিনিউ সংস্কার। আসাদ অ্যাভিনিউ থেকে বছিলা ব্রিজ পর্যন্ত সরকারিভাবে স্বীকৃতি দিয়ে গেজেট প্রকাশ। শিবপুরের ‘ইটাখলা চত্বরকে ‘আসাদ চত্বর’ হিসাবে স্বীকৃতি। সরকারি শহীদ আসাদ কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে উন্নীত করা। আসাদের সমাধি ও সেখানে যাওয়ার রাস্তার সংস্কার।

শহীদ আসাদের স্মৃতিস্তম্ভ সংস্কার এবং স্মৃতি জাদুঘরের অসমাপ্ত কাজ সম্পন্ন করা। ‘আসাদ স্কয়ার’ নামে ২১তলা ভবন নির্মাণ প্রকল্প বাস্তবায়ন। ২০ জানুয়ারি শহীদ আসাদ দিবসে রাষ্ট্রীয় ছুটি ঘোষণা। স্মৃতিচিহ্ন পরিদর্শনকালে নুরুজ্জামানের সঙ্গে থাকা দুর্নীতিবিরোধী জাতীয় সমন্বয় কমিটির সম্পাদক সারোয়ার ওয়াদুদ চৌধুরী বলেন, স্বাধীনতার পর শেখ মুজিব একদলীয় শাসনব্যবস্থা কায়েম করতে গিয়ে গণতন্ত্রের ভিত্তি নষ্ট করে দিয়েছেন। ফলে চব্বিশে এসে সেই আসাদের প্রেরণায় আবু সাঈদকে প্রাণ দিতে হলো।’

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম