আলো অন্ধকারে যাই
জীবন ও জগৎকে দেখার নির্মোহ দর্পণ
উম্মে সায়মা
প্রকাশ: ১৯ ডিসেম্বর ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
সাহিত্যের আঙিনায় কবিতার স্থানটি বরাবরই অভিজাত এবং স্পর্শকাতর। আলোচ্য কাব্যগ্রন্থটি জীবনের বিচিত্র অভিজ্ঞতায় ঋদ্ধ একজন কবির আত্মোপলব্ধির এক অনবদ্য দলিল। ১৯৫৬ সালে মাগুরায় জন্মগ্রহণকারী কবি রবীন্দ্রনাথ রায় চৌধুরী পেশাগত জীবনে আমলাতন্ত্রের গণ্ডিতে থেকেও হৃদয়ে লালন করেছেন এক নিভৃতচারী কবিসত্তা। ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতকোত্তর এবং দীর্ঘ সরকারি চাকরির অভিজ্ঞতায় ঋদ্ধ তার কবিতার ক্যানভাস, তাই স্বাভাবিকভাবেই বিস্তৃত ও বহুমাত্রিক। কবির নিজের জবানিতে, ‘সব বাঙালিরই জীবনে কোনো না কোনো সময় কবি হওয়ার সাধ জাগে’-এই আপ্তবাক্যটি দিয়ে তিনি বিনয়ের সঙ্গে নিজের কাব্যপ্রয়াসকে ‘হাস্যকর প্রচেষ্টা’ বললেও, তার ‘আলো অন্ধকারে যাই’ কাব্যগ্রন্থের কবিতাগুলো মোটেও হালকা চালের নয়। ‘বিরান ভূমি’ কিংবা ‘একটি প্রার্থনার পূর্বকথন’-এর মতো কবিতায় সমসাময়িক সমাজের অবক্ষয়, মূল্যবোধের পতন এবং বুদ্ধিবৃত্তিক দেউলিয়াপনার যে চিত্র তিনি এঁকেছেন, তা তীক্ষ্ণ ও সাহসী। এলিয়টের ‘ওয়েস্টল্যান্ড’-এর অনুষঙ্গ টেনে তিনি যখন হতাশার অবিশ্বস্ত হাওয়া কিংবা মাদকের নীল দংশনের কথা বলেন, তখন পাঠক এক রূঢ় বাস্তবের মুখোমুখি হন। সমাজে চাটুকারিতা, পেশিশক্তি এবং নীতিহীনতার যে দাপট চলছে, তার বিরুদ্ধে কবির উচ্চারণ অনেকটা দ্রোহের মতো শোনায়।
প্রেম ও নারীর সান্নিধ্য কবির কবিতায় এসেছে এক ভিন্ন মাত্রায়। ‘যে আমারে কাঁদায়’ বা ‘নীলকণ্ঠ’ কবিতায় রোমান্টিকতা আছে, কিন্তু তা চিরাচরিত মিলনান্তক প্রেম নয়। হেলেন, ক্লিওপেট্রা কিংবা বনলতা সেনের উপমা টেনে তিনি নারীর শাশ্বত রূপ ও রহস্যময়তাকে তুলে ধরেছেন, আবার একইসঙ্গে নারীর অবহেলা ও প্রত্যাখ্যানকে বরণ করে নিয়েছেন ‘নীলকণ্ঠ’ হয়ে। তার প্রেমানুভূতিতে শরীরী আবেদনের চেয়ে মনস্তাত্ত্বিক দহন ও একাকিত্বের সুরই প্রবল। অন্যদিকে, মৃত্যুচিন্তা এই কাব্যগ্রন্থের অন্যতম শক্তিশালী দিক। ‘অন্তর্জলিযাত্রা’ এবং ‘মরণের পরে’ কবিতা দুটিতে জীবনের নশ্বরতা এবং আধুনিক যান্ত্রিক সভ্যতার নির্মম চিত্র ফুটে উঠেছে। মৃত্যুর পর শবদাহের আয়োজনে স্বজনদের চেয়ে ফেসবুকের ‘লাইক’ কিংবা ভিডিও গেমের প্রতি আসক্তি-সমসাময়িক মানুষের এ আবেগহীনতাকে কবি ব্যঙ্গাত্মক অথচ করুণভাবে উপস্থাপন করেছেন। তিনি দেখিয়েছেন, মৃত্যুর পরও মানুষ আসলে কতটা একা।
তবে এতসব হতাশা ও অন্ধকারের মাঝেও কবি আশাবাদী। ‘তবুও মানব থেকে যায়’ কবিতায় তিনি কনফুসিয়াস, সক্রেটিস কিংবা যিশুর উদাহরণ টেনে মানুষের জয়-পরাজয়ের গান গেয়েছেন। দানবীয় শক্তির বিনাশ এবং মানবতার জয়ে তার অটুট বিশ্বাস এ গ্রন্থটিকে নেতিবাচকতার গণ্ডি থেকে মুক্তি দিয়েছে।
এই কবিতার কয়েকটি লাইন:
পৃথিবীর সবচেয়ে বয়োজ্যেষ্ঠ মানুষদের একজন আমি/বৃদ্ধ কনফুসিয়াস, সেও বয়সে কনিষ্ঠ আমার;/আমি দেখেছি মানুষের সমস্ত উত্থান-পতন/বেবিলন-আসিরিয়ায় গড়ে ওঠা/আবার অন্ধকারে ডুবে যাওয়া-/তাও প্রত্যক্ষ করেছি আমি/আমার চোখের ’পরে/বারবার ব্যর্থ হলো মানুষের মুক্তির কতো আয়োজন।
ভাষাশৈলীর বিচারে ‘আলো অন্ধকারে যাই’ গ্রন্থের কবিতাগুলোয় তৎসম শব্দের গাম্ভীর্য এবং আধুনিক শব্দভান্ডারের (যেমন : প্লে স্টেশন, ফেসবুক, এইডস) সাবলীল মিশ্রণ লক্ষণীয়।
পরিশেষে বলা যায়, রবীন্দ্রনাথ রায় চৌধুরী বিনয়ের সঙ্গে ‘Poetry is not everybody's cup of tea’ বলে সান্ত্বনা খুঁজলেও, এ কাব্যগ্রন্থটি সংবেদনশীল পাঠকের মনে গভীর রেখাপাত করতে সক্ষম। এটি শুধু কিছু পঙ্ক্তির সমষ্টি নয়; বরং একজন অভিজ্ঞ মানুষের দেখা জগৎ, জীবন, প্রেম ও মৃত্যুর এক নির্মোহ জবানবন্দি। যারা জীবনের রূঢ় বাস্তবতা ও রোমান্টিক বিষণ্নতার যুগলবন্দি পছন্দ করেন, তাদের জন্য এ বইটি একটি অনন্য উপহার হতে পারে। ধ্রুব এষ-এর প্রচ্ছদ ভাবনায় গ্রন্থটি প্রকাশ করেছে কালারলাইন প্রিন্টার্স।
