Logo
Logo
×

সাহিত্য সাময়িকী

গল্প

মহিমা কোথায়

Icon

সুশান্ত মজুমদার

প্রকাশ: ১৯ ডিসেম্বর ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

বৃষ্টিমুখর দুপুর ফুরিয়ে গেলে ধূসর আকাশের বিকাল হয়ে ওঠে কৃষ্ণময়। অযোগ্য ময়লা রাস্তার ভাঙা টুকরো টুকরো অংশে ওই বৃষ্টির জল জমে আছে। চামেলিবাগের সরু ঘুরপ্যাঁচে প্রয়োজন ছাড়া এলাকার মানুষও মরা দিনে তেমন চলাচল করে না। নতুন-পুরোনো বিল্ডিংয়ের বারান্দা-দেওয়াল-গেট ধরে ছাইছায়া সন্ধ্যা নীরবতা ছড়িয়ে নেমে আসে।

সকালে ডানে মোচড় কাটা রাস্তার দেওয়ালঘেঁষে খণ্ডকালীন বাজার বসে। এলাকার আটপৌরে নারী ক্রেতাদের সংখ্যাই বেশি। এ সময় চালু থাকে সাধারণ মনুষ্যির কোলাহল। বাজার মুছে গেলে কথার সঙ্গে কমতে থাকে পায়ের চলাচল।

উত্তরের মালিবাগ থেকে চিকন একটা রাস্তা একাধিক মোচড় কেটে শান্তিনগরের বড় রাস্তায় মিশেছে। লাগোয়া মৌচাকের ফুটপাত থেকে নাতি-নাতনির মোজা কিনে আমি মালিবাগে ফিরছি। বেখেয়ালে রাস্তার ময়লা জলে পা ভিজে গেলে মেজাজ জ্বলে ওঠে। দারুণ এক অস্বস্তি। নিরুপায় আমি দুপাশের বাড়ির চেহারায় দৃষ্টি ফেলে ধীরলয়ে হাঁটি। অধিকাংশ বাড়ি নতুন-আকাশ ঢেকে দিয়েছে দালানের ঘাড়। দিনের রোদ তাই ওপরেই আটকে থাকে। এখানের পুরোনো বুড়ো একটা বাড়ি ভাঙা হচ্ছে-লাট দেওয়া ইট-সুরকি-পলেস্তারা। পাশের দেওয়ালের পুরো পিঠে বাসা ভাড়া থেকে মালামাল টানা অনেক বিজ্ঞপ্তির কাগজ সাঁটা।

হঠাৎ কোত্থেকে যেন নিস্তব্ধতা ছিঁড়ে গায়েবি ডাক ভেসে এলো-‘মহিমা, এই মহিমা।’ আমার পা জমে যায়। অমন সুন্দর নাম ধরে যে নারী ডাকছেন তার কণ্ঠ বেশ সুরেলা। এ মহিমা কী শিশু, কিশোরী না যুবতি কেউ। মহিমা-শ্রুতিসুখকর নামের মেয়েকে দেখার আগ্রহে আমি বাড়ির ওপর নজর টেনে আনি। কোন বাড়ির ভেতরের ঢাক? দোতলা-তিনতলার ব্যালকনিতে কোনো মুখ দেখা যায় না। রুম না, স্বরের জোর কোনো সামনের অংশ থেকে এসেছে, নচেৎ নিচের রাস্তা অবধি ছড়াল কেন? কোথায় মহিমা? সুন্দর অসুন্দর যে চেহারার হোক, এমন বিরল নামের মুখ আদৌ দেখা গেল না। মহিমাকে পরিষ্কার দেখার জন্য দৃষ্টি ফেলে আমি তন্নতন্ন করি। না, নতুন-পুরোনো বাড়ির জালানা, ফালি বারান্দায় কোনো মুখ নেই।

তবে কি আমি ভুল শুনেছি? নিজের ভেতর থেকে প্রশ্ন উঠে আমার সুস্থতায় টোকা দেয়। যদি ভুলই শুনি, মহিমা শব্দটা আমার মধ্যে এলো কোত্থেকে! মহিমা মানে মহত্ত্ব, মর্যাদা, উৎকর্ষ, সম্মান যাই হোক, এমন যাচ্ছেতাই অপরিচ্ছন্ন পুরোনো গন্ধ ও জং ধরা এলাকায় কিসের গৌরব? অহেতুক এমন হিসাব-নিকাশ করে আমি বাঁ’পাশে মুখ ফেরাই। দেখি, অনেকখানি জায়গা ওপর থেকে নিচে পাটের পাতলা চটে ঢাকা। তার আড়াল থেকে আসছে জমানো বৃষ্টির জল পড়ার আওয়াজ। নতুন বিল্ডিংয়ের কাজের জন্য এখানে পুরোনো বাড়িটা চট দিয়ে ঘেরাও করা হয়েছে। ধুর, ধারালো চরম বিরক্তিতে আমি কাটাকুটি হই। বড় রাস্তার কয়েক গজ ভেতরে চামেলিবাগের শুরুর মুখে আমার ভাড়া বাসা। কতবার যাই-আসি। তাহলে নতুন আগন্তুকের মতো নিজের সঙ্গে নিজের এ আচরণ কেন? ফালতু সাবেকি কাবু ঘরবাড়ি ভেঙে তৈরি বহুতল ভবনে রাজধানী ঢাকা এখন ঢাকা পড়েছে-কোথাও ফাঁকা জায়গা নেই, চলছে উন্নয়নের নামে ডেভেলপারদের লাভ ও লোভে মোড়ানো গর্বের গাঁথুনি।

এই মাত্র আমার পাশ দিয়ে মন্থর পায়ে পরস্পর কথা চালাচালি করে বয়স্ক দুজন হেঁটে গেলেন। শোনা গেল তাদের স্বরের বিরক্তি। বুঝি, সাধ্য থাকলে রাজ্যপাট নিকুচি করে তারা নর্দমায় নিয়ে ফেলতেন। সত্যি তো চারপাশ এখন দুষ্কৃতদের শাসনে। তাদের ভাষণ শুনলে মুখ ম্লান হয়ে আসে। যেখানে-সেখানে সন্ত্রাস। শ্বাসের বাতাস পর্যন্ত নষ্ট। সময় গুজরানে পিঠ বাঁকা হয়ে যাচ্ছে। পেট জব্দ করা জিনিসের আগুনে দাম-সংসারে উপর্যুপরি অনটন। চোর-ছ্যাঁচ্চঢ়, গুন্ডা-বদমাশ, মুখোশ পরা শয়তান-ট্যাটনদের হাতে চলে গেছে দশের তালা-চাবি। পাহারাদার ল্যাজ গুটিয়ে যে যার আস্তানায় নির্জীব। এ চামেলিবাগের এক পেশিবাজ কিছু দিন আগেও টিনের ছাউনির মেসের ঠান্ডা ফ্লোরে রাত কাটিয়েছে, এখন সে নতুন একটা ফ্ল্যাটের মালিক। তার চারতলার ফ্ল্যাটের টবের ফুলগাছ দেখভাল করে চোয়াল ফোলা দুই সাগরেদ। শান্তিনগরের বাজার থেকে চাঁদা বাবদ মাছ-মাংস-তরকারি ফ্ল্যাটে পৌঁছে যায়। এমনই ব্যাপক উলটাপালটা সময় যে যানজটের নামে রাস্তা ছেড়ে ফুটপাতে চলছে মোটরসাইকেল। মাস দুই আগে শান্তিনগরের ছয়তলা মার্কেটের উত্তর পাশে সকালে ফুটপাত দিয়ে হাঁটার সময় আমার পেছনে ধাক্কা লাগে। দেখি, সানগ্লাস পরা বিদ্রোহী গোছের এক যুবক মোটরসাইকেলওয়ালা। আমার চশমা ছিটকে নিচে পড়ে ভেঙে যায়। মোটরসাইকেল থেকে হালকা আফসোসের শব্দ হয়-‘স্যরি।’ ব্যস, ক্ষতিপূরণ হয়ে গেল। উষ্মা প্রকাশের বিন্দুমাত্র সাহস আমার হলো না। মানুষ ও সাইকেলের ভিড়ে পায়ের নিচের একচিলতে জায়গা ধরে রাখা দুষ্কর। বা’পাশ দখল করেছে এক সারি চেয়ার। গুন্ডা-পান্ডারা খোশ মেজাজে আড্ডায় মশগুল। কাছের টং দোকান থেকে আসছে পান-সিগারেট-চা। এক ছোকরা চাওয়ালা হঠাৎ ফুকরে ওঠে-‘মামু, চায়ের লগে কি গুঁড়া দিমু?’ চায়ের সঙ্গে গুঁড়া? দিনদিন দুর্বোধ্য হয়ে উঠছে মানুষের সঙ্গে তার বচন-আচরণ।

সজাগ হয়ে বুঝি আমি গুটানো পায়ে হাঁটছি। খা খা রাস্তার এমাথা থেকে ওমাথা আমি ছাড়া মানুষের ছায়াও নেই। পায়ের নিচে বৃষ্টির জল, বালিকাদা। আমার ভেজা স্যান্ডেল আরেকটু সচল হয়। আকাশের যে খণ্ডাংশ আবাসিক বাড়ির ফাঁক দিয়ে দেখা যাচ্ছে ওখানে শুয়ে আছে আষাঢ়। না, মহিমাকে দেখা গেল না। বিভিন্ন বারান্দায় আলো জ্বলছে-কোনো মুখ নেই। ভেজা রাস্তাটা কি ডানে না বামে গেছে? কী আশ্চর্য, দিনদিন এতবার হেঁটেও এখন আমি কেন রাস্তা শনাক্ত করতে পারছি না! নির্ঘাত, আমার মাথার মধ্যে প্যাঁচ লেগেছে। এই মহিমা ডাক আমার চেতনা কি লুপ্ত করে দিয়েছে?

পর দিন মেঘলা সকালে রুমের ঠান্ডায় বসে থাকতে থাকতে পয়লা হালকা, ধীরে ধীরে জোরালো টান আমি অনুভব করি। বাহাত্তর বয়সে কালো সুতোর এপারে এসে পড়া এ মানুষটি গত দিনের বিকাল থেকে বুঝি ছেলেমানুষির জালে আকটে পড়েছি। কী এক ঘোরের মধ্যে চামেলিবাগের রাস্তায় আমি চলে এসেছি। অস্থায়ী বাজারটা চালু হয়েছে। আশপাশের বাসিন্দা এখানের ত্রেতা। আমিও সংসার সচল রাখতে এখান থেকে কেনাকাটা করি। সাহেব-পটের বিবিরা ঠাটবাট বজায় রাখতে আদৌ এখানে আসে না। সচরাচর যা দেখি, খাটতে খাটতে ঘায়েল বাসার বুয়ারা মুখের পান-জর্দার গন্ধ ছড়িয়ে তরিতরকারি, মাছ, মসলার দরদামে ব্যস্ত। আমাকে দেখে টাক মাথার প্রৌঢ় তরকারিওয়ালা ভাঙা স্বরে আগেই জানিয়ে দেয়-‘দাম কিন্তুক বাড়তি। বাজারে মাল নাইক্কা।’ দৃষ্টি ধরে তার চেহারা আমি নিড়িয়ে নিই। আমার কিছুই কেনার নেই। মাছ বিক্রেতা রুগ্ণ যুবক ভেজা হাত তার লুঙ্গিতে মুছে আমার কানের কাছে ফিসফিস করে-‘আপনের কাছদে আগের দামই নিমু।’ সামান্য এই কথা অসামান্য করে বলে আমাকে সে যেন ধন্য করল। তার ঠোঁটে এক ফালি ফাজিল হাসি ঝুলে আছে।

ভিড়ের ফাঁকফোকর দিয়ে উদ্দেশ্যহীন আমি এগিয়ে যাই। চামেলিবাগের সবচেয়ে পুরোনো চারতলা বাড়ির নিচে ওষুধের, পাশের খোপ সাইজের ছোট্ট আয়তনে মুদি দোকান। কবে হলো? আরে, ডানের বাড়িটার সরু সিঁড়ি ধরে ওপরে উঠলে একটা বিউটি পার্লার। গয়না পরা সাজুগুজু এক নারীর মুখের ছবি দিয়ে লাল রঙের বাহারি সাইনবোর্ডও আছে। আগে তো দেখিনি। আমার ভাড়া বাসার কাছাকাছি এ এলাকায় অনেক দিন আমি কি আসিনি? আমার স্মরণ খোঁড়াখুঁড়ি করেও উত্তর পাই না। হয়তো গতকালের অপরিচ্ছন্ন পড়ন্ত বেলায় এখানের কোনো না কোনো বাসা থেকে মহিমা ডাক ভেসে এসেছিল। আরে, চট দিয়ে ঢাকা জায়গাটা কই? গায়েব হলো কি করে? কাল যা ছিল, আজ তা নেই-হয় নাকি! লাইটপোস্টের গোড়ায় পান-সিগারেটের বাক্স নিয়ে বসা ছেলেটাকে ব্যপারটা জিজ্ঞেস করি। আমার ওপর স্থির নজর ধরে ক্রমে সে বিস্ময়ে জমে যায়।-‘কি কইতাছেন? অমন কিছু আছিল না।’ এবার আমি শক্ত হয়ে যাই-তাহলে গতকাল আমি কি দেখেছি? কয়েক গজ সামনে এগিয়ে এবার কলা বিক্রেতাকে জিজ্ঞেস করি। সে কোনো ভুল মানুষ দেখছে ভেবে মুখ ঘুরিয়ে নেয়। মহামুশকিল। ঘর-সংসার, দিনকালের জটিল সময় আমি কি ফোঁপরা হয়ে গেছি। বাজারফেরত এক প্রবীণকে কয়েক লাইনে বৃত্তান্ত বলতেই তিনি তার লম্বা সাদা দাড়ির মধ্যে আঙুল চালাতে চালাতে উপরমুখে আকাশ ধরে কোনো মারফতি বিষয় মনে করে হেঁটে যান।

গতকালের ভেজা রাস্তার পিঠ রোদের অভাবে পুরো শুকায়নি। আষাঢ়ের বৃষ্টি যখন-তখন নেমে এলে আবার খানাখন্দে জল জমবে। সামনে গিয়ে রাস্তাটা কোমর বেঁকে গেছে ডানে। শেওলা ধরা দেবে যাওয়া দেওয়ালটার ওপাশে কয়েকটা কলাগাছ, কচুঘেচু, কাঁটাময় ঝোপ, আর্বজনার স্তূপ। ওধারে মস্ত বড় হ্যামার মারার গম্ভীর আওয়াজ। রীতিমতো যুদ্ধ করে যেন বাড়ি ভাঙা হচ্ছে। ভাঙা ইটের ভেতর থেকে আস্ত ইট বেছে বেছে আলাদা করছে দুই লেবার। বিক্রি হবে। এখানেও কদিনের মধ্যে শুরু হবে নতুন গাঁথুনি। পাঁজা ইট-পাটকেলে দৃষ্টি পড়তেই দেখি,-কয়েকটা আধভাঙা ইটের ফাঁকে গাঢ় রঙের লাল-সবুজের কাগজ-নিশ্চয় বাংলাদেশের পতাকা। হয়তো বাড়িটার ভেতরের কোনো রুমের দেওয়ালে পতাকাটা লাগানো ছিল। পতাকাটা এখনো চেনা যায়-অক্ষত। হঠাৎ আশপাশের কোনো ভূভাগ থেকে সেই সুরের সঙ্গে টাটকা ডাক ভেসে এলো-মহিমা, এই মহিমা।

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম