Logo
Logo
×

সাহিত্য সাময়িকী

কেবল চমক বা সস্তা পরাবাস্তবতার ওপর নির্ভর করা উচিত নয়: মরিস রিয়ার্ডান

Icon

মেজবাহ উদ্দিন

প্রকাশ: ১৯ ডিসেম্বর ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

বাজারচলতি নোটবই আর স্কুল-কলেজ-ইউনিভার্সিটির জেলহাজতে আটকে পড়া দুর্ভাগা কবিতার যে আর্তনাদ, তা হয়তো শিক্ষার্থীদের মাস্টার করে তোলে, কিন্তু কবিতার আসল স্বাদ থেকে বঞ্চিত করে। অথচ ফরাসি কবি রেনে শার যেমনটা বলেছিলেন, কোনো কবিতার অস্তিত্ব আকাশপটে আঁকা বিমানরেখার মতো। সে উপস্থিতির ছায়াতলে দাঁড়িয়ে সবারই তার অস্তিত্ব টের পাওয়া উচিত, তাকে অনুভব করা উচিত। সমকালীন আইরিশ কবিতার অন্যতম প্রধান কণ্ঠস্বর মরিস রিয়ার্ডান গত চার দশক ধরে শব্দের সে আকাশরেখাই এঁকে চলেছেন। রিয়ার্ডানের জন্ম ১৯৫৩ সালে, আয়ারল্যান্ডের কর্ক কাউন্টির লিসগুল্ডে। তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘আ ওয়ার্ড ফ্রম দ্য লোকি’ (১৯৯৫) এবং পরবর্তী সময়ে ‘দ্য ওয়াটার স্টিলার’ (২০১৩)-দুটিই টি.এস. এলিয়ট পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয়েছিল। তার ‘দ্য হোলি ল্যান্ড’ (২০০৭) জিতেছিল মাইকেল হার্টনেট পুরস্কার। ২০২৫ সালে প্রকাশিতব্য তার ‘সিলেক্টেড পোয়েমস’ বা নির্বাচিত কবিতাসমগ্রে গত চার দশকের কাজের প্রতিফলন ঘটেছে। ২০১৩ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত তিনি ‘দ্য পোয়েট্রি রিভিউ’ পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন এবং বর্তমানে শেফিল্ড হ্যালাম ইউনিভার্সিটির ইমেরিটাস অধ্যাপক হিসাবে কবিতার সঙ্গে যুক্ত আছেন। সম্প্রতি লিটেরারি হাব’র জন্য পিটার মিশলারের নেওয়া তার সাক্ষাৎকারের গুরুত্বপূর্ণ অংশ অনুবাদ করেছেন মেজবাহ উদ্দিন

আপনার ‘নির্বাচিত কবিতা’র সম্পাদনা করেছেন জ্যাক আন্ডারউড। তিনি যেভাবে কবিতাগুলো সাজিয়েছেন, সেই ক্রমটি দেখে আপনার কী মনে হচ্ছে?

: জ্যাক যে প্রথাগত কালানুক্রমিক বিন্যাস এড়িয়ে কবিতাগুলো নতুনভাবে সাজানোর মতো কঠিন কাজটি হাতে নিয়েছেন, তা দেখে আমি বেশ অবাক হয়েছিলাম। সংকলনটি শুরু হয়েছে ২০১৯ সালে লেখা ‘দ্য সেভেন সংগস অফ মাইসেলফ’ দিয়ে আর শেষ হয়েছে বিশ বছর আগের লেখা ‘ফ্লাডস’ কবিতাটি দিয়ে। ভেবেছিলাম, এ ওলট-পালট বিন্যাসের ফলে হয়তো পড়ার সময় একটা খাপছাড়া ভাব বা ছন্দপতন তৈরি হবে। কিন্তু আমার মনে হয় না তেমন কিছু হয়েছে। বরং বছরের পর বছর আমার কবিতার স্বর এবং বিষয়বস্তুর মধ্যে যে একাত্মতা বজায় ছিল, তা দেখতে আমি নিজেই প্রস্তুত ছিলাম না। তার চেয়েও বড় কথা, রচনার মান বা শৈলীতে একটা ধারাবাহিকতা বজায় ছিল। ভয় ছিল, হয়তো বহু বছর আগের লেখা কবিতাগুলো পড়ে এখন অতৃপ্তি লাগবে। কিন্তু তা হয়নি। এ ব্যাপারে আমি নিজেকে একটু বাহবা দিতেই পারি। তবে মুদ্রার উলটো পিঠটাও আছে-গত ৪০ বছরে আমার কাজের খুব একটা বিবর্তন বা পরিবর্তন হয়নি, এ সত্যটাও মেনে নেওয়া ছাড়া উপায় নেই।

তারুণ্যে নিজেকে কেমন কবি ভাবতেন আর এখন কেমন কবি হয়ে উঠেছেন-এ দুইয়ের মধ্যে কতটা মিল খুঁজে পান?

: কুড়ি বছর বয়সে বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকের কবি হার্ট ক্রেন ছিলেন আমার প্রধান আদর্শ। তার সেই একরোখা, বুনো রোমান্টিকতা আমার মধ্যে আরও গেঁথে গিয়েছিল রোথকে এবং শুরুর দিকের টেড হিউজের প্রভাবে। তখন বিশ্বাস করতাম, কবিতা নিজেকে রূপান্তরিত করতে পারে-এমনকি ক্রেনের ‘দ্য ব্রিজ’র মতো সংস্কৃতিকেও বদলে দিতে পারে। পরে এলিজাবেথ বিশপ এবং রবার্ট ফ্রস্টকে পড়ার পর আমার মধ্যে ধৈর্য বাড়ল, আমি আরও পর্যবেক্ষণপটু এবং তীক্ষ্ণ হয়ে উঠলাম।

সে শুরুর রোমান্টিকতা কি হারিয়েছি? পুরোপুরি নয়। আমি এখনো আমার কবিতাকে এক ধরনের অনুসন্ধান বা নিজেকে আবিষ্কারের প্রক্রিয়া হিসাবেই দেখি। কিটসের সেই পুরোনো ‘আত্মগঠন’ বা ‘সোউল মেকিং’র ধারণা হয়তো এখনো পুরোপুরি ছাড়তে পারিনি। তবে তরুণ বয়সে কি আজকের এ কবিতাগুলোর কথা কল্পনা করতে পারতাম? একদমই না। কবি হিসাবে আমার এ যাত্রাপথ সব সময়ই একটা বিস্ময়ের মধ্য দিয়ে গেছে-মনে হয়েছে, ‘এ কী হচ্ছে? এর গন্তব্য কোথায়?’ কিংবা ‘আমি কেনই বা লিখছি?’

নিজেকে ‘নতুন করে আবিষ্কার’ বা রিইনভেন্ট করার কথা কি কখনো সচেতনভাবে ভেবেছেন?

: প্রতিটা বই শেষ করার পর আমি কিছুদিন লেখা থামিয়ে দিই। ইচ্ছা করে নয়, এমনিতেই হয়ে যায়। এ বিরতিটা আমার মস্তিষ্ককে ‘নতুন করে গুছিয়ে উঠতে’ সাহায্য করে, আর জীবনও এই ফাঁকে অভিজ্ঞতার ঝুলি পূর্ণ করে দেয়। যখন আবার নতুন বইয়ের কাজ শুরু করি, মনে হয় যেন আমার স্বপ্নরাজ্যের কোনো নতুন দরজা খুলছি। বাইরের কারও কাছে হয়তো মনে হতে পারে সেই একই পুরোনো কাসুন্দি! কিন্তু আমার কাছে এই ‘নতুন কিছু করছি’-এ অনুভূতিটাই সবসময় শক্তির উৎস হয়ে এসেছে।

আপনার কি মনে হয়েছিল কিছু একটা ঘাটতি আছে বা বিশেষ কিছু অর্জন করা দরকার, যা আপনাকে ক্রেনের পথ থেকে সরিয়ে এনেছিল?

: দেখুন, সেই হার্ট ক্রেনের ভক্ত থাকার সময়ের পর থেকে আমার শরীরের সব কোষ তো কয়েকবার করেই বদলে গেছে! আমার মনে হয়, আমার কবিতা তার নিজস্ব ভাষা আর গতি খুঁজে পেয়েছিল আমার ত্রিশের কোঠার মাঝামাঝি সময়ে-যে বয়সে ক্রেন পৌঁছাতেই পারেননি। তখন জীবনের নানামুখী আঘাত, বিশেষ করে পিতৃত্বের অভিজ্ঞতা আমার লেখায় প্রভাব ফেলছিল।

শুরুতে সবারই একটা উচ্চাকাঙ্ক্ষী ঝোঁক থাকে, নিজেকে বিশ্বের কাছে তুলে ধরার একটা সাহসী প্রয়াস থাকে। কিন্তু সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে লেখালেখিটা হয়ে দাঁড়ায় ব্যক্তিগত, প্রায়-অসহনীয় অভিজ্ঞগুলোর সঙ্গে বোঝাপড়া। এরপর জীবনের ধাপগুলো পার হতে হতে অভিজ্ঞতাগুলো স্তরে স্তরে জমতে থাকে-একেবারে ভূতাত্ত্বিক শিলাস্তরের মতো-ভাঁজপড়া, ভাঙাচোরা সে স্তরগুলোর জটাজালের মধ্যেই কল্পনাশক্তি একটা অর্থ খোঁজার চেষ্টা করে।

‘কেন লিখছি’-এ প্রশ্নের কি কোনো স্থায়ী বা সুরাহা হওয়া উত্তর পেয়েছেন?

: মোটেই সুরাহা হয়নি! এর পেছনে পুরোপুরি স্বার্থপর একটা কারণ আছে। আগে যখন লিখতাম, তখন একটা উত্তেজনা কাজ করত, একটা লেখা ঠিকঠাক দাঁড়িয়ে গেলে যে স্বস্তি বা আনন্দ পেতাম, সেটাই ছিল আসল। ইদানীং এটা অনেকটা বিস্ময়ের মতো-লেখাটা আমার নিজের সম্পর্কে কী ‘উন্মোচন’ করছে, তা দেখার বিস্ময় (আমি ‘উন্মোচন’ বলছি বটে, তবে আমি জানি এটি একটি টলমলে, অবিশ্বস্ত আয়নার মতো)।

আমার সন্দেহ হয়, যারা কবিতা লেখে-আমিসহ-তারা হয়তো পৃথিবীর জন্য আরও কাজের কিছু করার সুযোগ নষ্ট করেছে। তবে সামগ্রিকভাবে সৃজনশীল কল্পনাশক্তির ওপর আমার আস্থা আছে-সেটা গুহাচিত্র থেকে র‌্যাপ গান, কিংবা গণিত ও বিজ্ঞান, এমনকি ধর্মীয় ও নৈতিক কল্পনাশক্তি পর্যন্ত বিস্তৃত। এটা ছাড়া মানব ইতিহাস নারকীয় হতো। আর এটার উপস্থিতিতে? হয়তো এখনো যথেষ্ট ভালো হয়নি-কে জানে! আমার কবিতা কি সেই মহাসাগরে কিছু যোগ করতে পারল? আমি ভাবতে চাই-অন্তত একফোঁটা। আশা করি সেটা অন্তত টক আঙুরের রস হবে না!

কবিতার কোন মুদ্রাদোষ বা ম্যানারিজম নিয়ে আপনি সবচেয়ে বেশি সতর্ক থাকেন?

: আমি কৃত্রিমতা বা মেকি ভাব নিয়ে খুব সতর্ক থাকি। অবশ্যই, লেখায় নতুনত্ব আর সজীবতা থাকা জরুরি। কিন্তু তা যেন খুব কষ্ট করে জোরপূর্বক করা হয়েছে-এমন না দেখায়। কেবল চমক বা সস্তা পরাবাস্তবতার ওপর নির্ভর করা উচিত নয়। এ পৃথিবীটা এমনিতেই যথেষ্ট অদ্ভুত।

কবিতার পর কোন শিল্পমাধ্যমের প্রতি আপনার সবচেয়ে বেশি অনুরাগ?

: নিঃসন্দেহে সংগীত হলো শ্রেষ্ঠ শিল্পমাধ্যম-স্বর্গ বলে যদি কিছু থাকে, তবে ওটাই তার ভাষা। কিন্তু ৫-৬ বছর বয়সে আমার এক শিক্ষক যখন আমাকে বলেছিলেন গান থামাতে, কারণ আমি নাকি ‘কাকের’ মতো গাইছি-তখন থেকেই সাংগীতিকভাবে নিজেকে পঙ্গু মনে হয়। সেই হতাশার সান্ত্বনা পুরস্কার হিসাবেই যেন কবিতা এসেছিল। এখন যদি আমাকে কবিতার বিনিময়ে ধ্রুপদী গানের টেনর বা রক ব্যান্ডের গায়ক হওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়? আমি সম্ভবত টেনর হওয়াটাই বেছে নিতাম। কণ্ঠের জৌলুসের পাশাপাশি দলগত পরিবেশনার আনন্দটা আমার দারুণ লাগত। তবুও কবিতার এ ধুলো-মাটির কাছাকাছি থাকার আনন্দ-কবিতা পড়া, মনে রাখা, অর্থ উদ্ধার করা এবং মাঝেমধ্যে দু-একটা লেখা আমাকে দশকের পর দশক ধরে তৃপ্তি দিয়ে আসছে।

যখন আপনি খুব সক্রিয়ভাবে লেখেন, তখন ওই কয়েক সপ্তাহের ‘ঘোর লাগা’ সময়টা কেমন হয়?

: তখন আমি খুব একটা নির্ভরযোগ্য থাকি না। মাঝে মাঝে বোকামি করে ফেলি-যেমন, একবার ব্যাংকের ড্রপবক্সে চেক জমা না দিয়ে পাশের পোস্ট অফিসের বাক্সে ফেলে দিয়েছিলাম (সত্যি ঘটনা)। মূলত তখন এক ধরনের প্রশান্ত নির্ঘুমভাব আর একটা ‘ঘোর’ কাজ করে, আবার একইসঙ্গে ভয় হয়-আমি নিজেকে বোকা বানাচ্ছি না তো! দু-একবার তো বেশ ভয়ই পেয়ে গিয়েছিলাম।

এমন কিছু কি আছে যা ভেবেছিলেন আপনার কবিতায় আসবে, কিন্তু আসেনি?

: পরের বইটা কী নিয়ে হবে, তা কেউ আগে থেকে জানে না। মাঝে মাঝে মনে হয়, ইশ, আমার কবিতার কণ্ঠস্বর যদি আরেকটু সর্বজনীন হতো! যদি সমসাময়িক ঘটনা বা পারিবারিক বিষয়গুলোর সঙ্গে চট করে সংযোগ ঘটাতে পারতাম! কিন্তু আমার ক্ষেত্রে মনে হয়, অভিজ্ঞতাকে প্রথমে স্মৃতির গভীরে তলিয়ে যেতে হয়, যেন পচে গলে সার হওয়ার পরই তা লেখার রসদ হিসাবে ব্যবহারযোগ্য হয়। আমার জীবনের দিনলিপি-তার উল্লেখযোগ্য ঘটনা আর আবেগের স্রোত-এবং আমার কবিতার আখ্যানের মধ্যে এক অদ্ভুত বিচ্ছেদ বা অমিল দেখতে পাই। এটা বেশ বিভ্রান্তিকর, বা হতে পারত যদি আমি এটা নিয়ে বেশি ভাবতাম। এটাকে আমি সীমাবদ্ধতা হিসাবেই মেনে নিয়েছি।

সূত্র : লিটেরারি হাব

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম