Logo
Logo
×

সাহিত্য সাময়িকী

প্রতীকবাদ অদৃশ্য রূপসাগরের প্রবেশদ্বার

Icon

মাহমুদ নাসির জাহাঙ্গীরি

প্রকাশ: ১৯ ডিসেম্বর ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধজুড়ে ছিল রোমান্টিসিজমের একাধিপত্য। দ্বিতীয়ার্ধে অধিপতির স্থান দখল করে ফ্রান্সের দুটি আন্দোলন। শক্তিশালী প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার জন্য ফ্রান্স তাক করে দোনলা বন্দুক। রোমান্টিসিজমের বিরোধী শক্তি হিসাবে ফ্রান্সে আবির্ভূত হয় উপন্যাসে বাস্তববাদী ধারা আর কবিতায় প্রতীকবাদী ধারা। বাস্তববাদী উপন্যাসে নেতৃত্ব দেন গুস্তাভ ফ্লোবেয়ার আর প্রতীকবাদী আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন শার্ল বোদলেয়ার। ফ্লোবেয়ারের প্রথম বাস্তববাদী উপন্যাস মাদাম বোভারি এবং বোদলেয়ারের প্রথম প্রতীকী কাব্যগ্রন্থ ফ্ল্যর দ্যু মাল প্রকাশিত হয় একই বছর ১৮৫৭ সালে। উভয়ে জন্মগ্রহণ করেছিলেন একই বছরে, ১৮২১ সালে। সমসাময়িক দুই লেখক উভয়ে উভয়কে ভালোভাবে জানতেন। দুজনের মধ্যে ব্যক্তিগত সম্পর্ক ছিল। উভয়ে উভয়ের সাহিত্যের সমালোচনা করেছেন। ফ্লোবেয়ার বলেছেন-পরম রোমান্টিক আপনি, অথচ আপনি ক্ল্যাসিকও হতে পেরেছেন। ফ্লোবেয়ার তার পুরুষসত্তা বিসর্জন দিয়ে নিজেকে রমণীতে পরিণত করেছেন মাদাম বোভারি চরিত্র অঙ্কন করার জন্য-এমন কৌতূহলোদ্দীপক মন্তব্য করেছেন বোদলেয়ার।

মাদাম বোভারি এবং ফ্ল্যর দ্যু মাল দুই গ্রন্থে একই সমাজের চিত্র পাওয়া যায়। সবচেয়ে বড় মিল প্রতীক ব্যবহারে। মাদাম বোভারির নায়িকার নাম এমা, নায়কের নাম শার্লস। প্রথম খণ্ডের শেষে দেখা যায় এমা তার স্বামীকে নিয়ে নিরানন্দ শহর ছেড়ে অপেক্ষাকৃত বড় শহরে যাচ্ছে নতুন জীবন শুরু করতে। যাওয়ার দিন জিনিসপত্র গুছানোর সময় আঙুলে বিদ্ধ হয় ড্রয়ারে রাখা এক তোড়া কাগজের ফুল-যেগুলো ছিল তার বিয়ের রাতের স্মৃতি। কালক্ষেপণ না করে তোড়াটি ঘরের আগুনের চুল্লিতে ফেলে দেয় এমা। জ্বলন্ত আগুনে শুকনো খড়ের মতো নিমেষে পুড়ে ছাই হয়ে যায় তার বিয়ের স্মৃতি। এটি এমন একটি প্রতীক, যার মাধ্যমে এমা পুড়িয়ে ছাই করে দেয় তার পুরোনো অতীত। এ ধরনের ‘প্রতীকের অরণ্যের ভেতর’ দিয়ে এগিয়ে গন্তব্যে পৌঁছে বাস্তববাদী উপন্যাস ও প্রতীকবাদী কাব্য।

বস্তুর ভেতরের সারাৎসার, দৃশ্য ও ধ্বনির শুদ্ধ স্বরূপকে জানার নামই প্রতীক। সাধারণ দৃষ্টি দিয়ে বস্তুর স্বরূপ বোঝা যায় না, দরকার হয় অন্তর্দৃষ্টির। আক্ষরিক অর্থকে অতিক্রম করে যখন কোনো শব্দ তার ভেতরের সম্পদ ও অর্থ নিয়ে ভাস্বর হয়ে ওঠে, তখনই জন্ম হয় প্রতীকের। ভারতে গোলাপ হচ্ছে প্রেমের প্রতীক, দূরপ্রাচ্যে সদগুণ, মিশরে নৈঃশব্দ্য আর রোমে উচ্ছ্বলতার প্রতীক। এমিল জোলার জার্মিনাল উপন্যাসে কয়লা খনি থেকে মাটি ফুঁড়ে বের হয়ে আসে কালো মানুষের মাথা। অন্ধকারের ভেতর থেকে উদ্ধার করে তেমনি কবিরা বের করে আনেন প্রতীকের সৌন্দর্য। প্রবাদ প্রবচন হলো একটি জাতির শত বছরের অভিজ্ঞতার সারাংশ আর প্রতীক হলো কবির শত সাধনার পর হঠাৎ আলোর ঝলকানি, আবিষ্কার ও প্রমূর্ত অর্জন।

অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ দশকে ইংল্যান্ডের কবিরা দৃষ্টি ফিরিয়েছিলেন জার্মানির দিকে। ওয়ার্ডসওয়ার্থ ও কোলরিজ বন্ধুদ্বয় আদর্শ হিসাবে গ্রহণ করেছিলেন শ্লেগেল ভ্রাতৃদ্বয়কে। ঊনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে এসে নতুনত্বপ্রয়াসী ফরাসি কবিরা দৃষ্টি ফেরালেন আমেরিকার দিকে। ১৮৩৭ সালে স্যামুয়েল মর্স আবিষ্কার করেন টেলিগ্রাফ, বিন্দু আর দাগের সংমিশ্রণে তৈরি মর্স কোড হয়ে উঠল বৈদ্যুতিক ভাষা। ১৮৪৩ সালে দ্য গোল্ডেন বাগ লিখে এডগার এলান পো আখ্যায়িত হলেন দুনিয়ার সবচেয়ে বিজ্ঞ ও দক্ষ ক্রিপ্টোগ্রাফার হিসাবে। বোদলেয়ার ১৮৪৭ সাল থেকে অন্তরঙ্গ হয়ে উঠলেন এডগার অ্যালান পোর গুপ্ত লিখনের সেরা নিদর্শনের সঙ্গে। প্রতীকের ব্যবহার শুরু হয় বোদলেয়ারের হাতে দ্বিতীয় রিপাবলিকের যুগে (১৮৪৮-১৮৫২)। তবে প্রতীকময় প্রধান কবিতাবলি প্রকাশিত হয় সেকেন্ড এম্পায়ারের কঠিন বাস্তবতার যুগে (১৮৫২-১৮৭০)। ১৮৫৭ সালে রচিত ‘correspondence’ কবিতায় ‘perfumes, sounds and colors correspond’ লিখিত হওয়ার পর সূচনা হয় মহান বিপ্লবের। তার ফলে দৃশ্যমান বাস্তব পৃথিবী থেকে দ্বিতীয় পৃথিবীতে গিয়ে উত্তীর্ণ হলো কবিতা। রোমান্টিক কবিরা দেখেছিলেন নদীর প্রবাহমাণ রূপ, প্রতীকী কবিরা শুনলেন স্তরে স্তরে সজ্জিত ভূমির গভীরতলের ঝরনার গান এবং দেখলেন এক স্তর থেকে আরেক স্তরে তার অবতরণের অপরূপ নৃত্যরূপ। নতুন আন্দোলনে শব্দ সংগীতময় হয়ে ওঠে হার্বার্ট স্পেন্সারের দ্য অরিজিন অ্যান্ড ফাংশন অব মিউজিক এর অনুপ্রেরণায়। ১৮৬১ সালে বোদলেয়ার রোগশয্যায় সাড়া দেন রিচার্ড হ্বাগনারের সংগীতের আহ্বানে। তাকে অনুসরণ করে মালার্মে ও ভালেরি বলেন, শব্দের আদিতে সংগীত, তার পুনর্বাসন করতে হবে। ধ্বনিব্যঞ্জনা দেবে সুরের সংকেত, উপলব্ধির অনির্বচনীয়তা সৃষ্টি করবে স্বর্গীয় সুষমা। শব্দের মূল তাৎপর্যের প্রতি লক্ষ রেখে শব্দের প্রতীকী ব্যঞ্জনাকে ভাব উপলব্ধির প্রধান উপকরণ রূপে ব্যবহার করতে হবে। মালার্মে শব্দের অর্থের চেয়ে ধ্বনির সুরকে বেশি গুরুত্ব দিলেন। বললেন, কবির কাজ হলো যুক্তিবাদী অলংকার শাস্ত্র থেকে বিমুক্ত করে রহস্যময় পৃথিবীর পাঠোদ্ধার করা। ১৮২২ সালে জঁ ফ্রাসোয়া শপলিওঁ রোজেটা পাথরফলক থেকে হায়ারোগ্লিফিকস লিপির পাঠোদ্ধার করেন, প্রতীকী কবিরা অদৃশ্য মানবভাগ্য পাঠ করার চাবিকাঠি।

কবিরা সেকেন্ড এম্পায়ারের মানুষের স্খলন ও পাপাচারের কাহিনি প্রতীকের মাধ্যমে উন্মোচন করলেন। সেখানে আছে ভারসাম্যহীন মানুষ, বদমাশ, তস্কর, মাস্তান, নিরেট স্বপ্নচারী মানুষ; নেই মহৎ মানুষ, যথার্থ সাধু, হৃদয়বান ব্যক্তিত্বসম্পন্ন প্রবল পুরুষ। কোনো আনন্দ নেই, উজ্জ্বল প্রয়াস নেই, সুস্থ বিকাশ নেই। সুস্থ পৃথিবী নেই, আছে হাসপাতাল। বোদলেয়ার ঘোষণা করেন : ‘ইন্দ্রিয়সমূহের বিপর্যয় দ্বারা পৌঁছতে হবে অজানায় জানতে হবে প্রেম, দুঃখের, উন্মাদনার সব প্রকরণ। খুঁজতে হবে নিজকে, গরল আত্মসাৎ করতে হবে, পেতে হবে অকথ্য যন্ত্রণা, হতে হবে মহারোগী, মহাদুর্জন, পরম নারকীয়।’ ‘বৈপরীত্য’, ‘পিশাচীয় রূপান্তর’, ‘ধ্বংস’, ‘গোধূলি’, ‘নিঃসঙ্গতা’ এসব কবিতারাজির মধ্যেই প্রকাশিত হলো বোদলেয়ারের প্রধান পরিচয়। রোমান্টিক কবিদের প্রকৃতি নয়, প্রতীকী কবিদের আরাধ্য হয়ে উঠল নগরজীবনের চঞ্চলতা। প্রকৃতিতে নয়, প্রিয়াকে নিয়ে যেতে চাইলেন দর্পণশোভিত অন্তঃপুরে। যে ধরনের দর্পণশোভিত অন্তঃপুর ছিল না রোমান্টিক কবিদের যুগে। রোমান্টিক কবিরা অনেকটা ছিলেন নার্সিসাসের যুগে, জলে দেখতে হতো মুখচ্ছবি। জন কিটস, শেলি, বায়রন প্রভৃতি কবির যুগে ছিল না নগরায়ণ বা রেল যোগাযোগ। রেলওয়ের উন্মাদনার যুগে নতুন কবিদের মধ্যে দেখা গেল নতুন যৌবনের উন্মাদনা। বোদলেয়ার জানালা দিয়ে দেখতে চাইলেন তরুপল্লব নয়, অর্ণবপোত। বোদলেয়ারের নায়িকা উপস্থাপিত হলেন ‘সুন্দর জাহাজের’ প্রতীকে। কামনা করলেন উদ্ভিদের উচ্ছেদ, দেখতে চাইলেন প্রস্তরময় প্যারিস। প্রকৃতির মধ্যে নয়, পাপ ও অশুভের মধ্যে খুঁজে পেলেন সৌন্দর্য ।

১৮৭১ সালে ফ্রাঙ্কো-জার্মান যুদ্ধে পরাজয়ের পর ফ্রান্সের রাজনীতি ও সামাজিক জীবন আরও বেশি পরিচালিত হলো আটলান্টিক পাড়ের আমেরিকার দিকে। ১৮৭৬ সালে আলেক্সান্ডার গ্রাহাম বেল টেলিফোন আবিষ্কার করার পর চিঠির নির্বাক যুগ হয়ে উঠল সবাক। চিঠি ছিল পুরোনো যুগের রোমান্টিকতার প্রতীক, নতুন ব্যবস্থায় প্রাধান্য পেল সরাসরি যোগাযোগ। যোগাযোগব্যবস্থায় ইংল্যান্ডের প্রযুক্তির যুগ ততদিনে বাসি হয়ে যায়, একই সঙ্গে আবেদন হারিয়েছে ইঙ্গ-জার্মান রোমান্টিক জুটি। তার জায়গা দখল করেছে আমেরিকার প্রযুক্তি, স্থাপিত হয়েছে যোগাযোগের নতুন ভাষা। মালার্মে ‘ব্রেভ নিউ ওয়াল্ডের’ প্রতি এতটাই আকৃষ্ট হলেন যে, এলান পোর স্মৃতির উদ্দেশ্যে রচনা করেন সনেট ‘টুম অব এলান পো।’ এটি রচনা করে আমেরিকায় প্রেরণ করেন নতুন প্রযুক্তির সাহায্যে ১৮৭৬ সালে, যে বছর পালিত হয় আমেরিকার স্বাধীনতার শতবর্ষ। ফ্রান্সের জনগণ শুভেচ্ছার স্মারক হিসাবে আমেরিকার জনগণকে উপহার দেয় স্ট্যাচু অব লিবার্টি। নিও-ক্ল্যাসিক স্থাপত্যরীতিতে নির্মিত ভাস্কর্যটি উদ্বোধন করা হয় ১৮৮৬ সালে, আর নিওক্ল্যাসিক রীতিতে রচিত মালার্মের এলিজি অন্তর্ভুক্ত হয় নতুন গ্রন্থ ‘পোসি’তে, তার পরের বছর ১৮৮৭ সালে। প্রতিষ্ঠিত হয় ফ্রান্সের সঙ্গে আমেরিকার সেতুবন্ধ, একইসঙ্গে স্থাপিত হয় ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বাস্তব জগতের সঙ্গে নতুনতর এক অতীন্দ্রিয় লোকের আন্তঃসম্পর্ক।

১৮৭১ সালে র‌্যাবোঁ ঘোষণা করেন, আমি জোর দিয়ে বলি দ্রষ্টা হতে হবে-মানে নিজকে যথোপযুক্ত হিসাবে গড়ে তুলতে হবে। ১৮৭২ সালে জর্জ স্মিথ গিলগামেসের পাঠোদ্ধার করেন। র‌্যাবোঁ পাঠোদ্ধার করলেন মানব ভাষার অজ্ঞাত লিপিরূপের। তিনি ধ্বনিকে দৃশ্যমান করলেন। ‘সনেট অব দ্য ভায়েলস’ কবিতায় র‌্যাবোঁ ঘোষণা করেন, ইংরেজি ‘এ’ ধ্বনির রং কালো, ‘ই’ ধ্বনি সাদা, ‘আই’ লাল, ‘ইউ’ সবুজ, এবং ‘ও’ নীল। ধ্বনির মধ্যে থাকতে পারে স্পর্শেন্দ্রিয়গ্রাহ্য রূপ। ধ্বনি হতে পারে কোমল, কঠিন বা শীতল। ধ্বনির থাকতে পারে কর্ণেন্দ্রিয়গ্রাহ্য রূপ। ‘ট’ বর্গীয় সংযুক্ত ধ্বনিগুলো শোনার পর কাঠিন্যের ধারণা জন্মে। ডান্ডা, ঠান্ডা, পান্ডা, গুন্ডা, প্রচণ্ড, দণ্ড এসব শব্দ উচ্চারিত হওয়ার পর বোমা বা বজ্রপাতের অনুভূতি জাগে মনে। প বর্গীয় ধ্বনিগুলো ঠিক তার বিপরীত, এগুলো উচ্চারিত হওয়ার পর কোমল অনুভূতি জাগে মনে। সবচেয়ে কোমল ধ্বনি ‘ম’- যেখান থেকে ইংরেজি মাদার, ইতালিয়ান মাদ্রে, রুশ মাত, সংস্কৃত মাতৃ ও বাংলা মা শব্দ উদ্ভূত। একই রকমভাবে ধ্বনির থাকতে পারে ইন্দ্রিয়জাত রূপ। যেমন বাংলা ভাষা মিষ্টি ভাষা, ফরাসি ভাষা লোনা ভাষা, জার্মান ইস্পাতকঠিন ভাষা ইত্যাদি। ডাহুকের ডাক শ্রবণেন্দ্রিয়গ্রাহ্য কিন্তু তার দৃশ্যমান রূপ হতে পারে আয়তাকার, ত্রিভুজ বা বর্তুলাকার। একটি উদাহরণ :

সোনার পাত্রে ফেলে কে যেনো ঘষে পায়ের শাপলা খাড়ু

এমনি কু কু কোয়াক শব্দে ডাকে ডাহুক, স্বপ্নের সোনারু।

(‘শাপলা খাড়ু’, নদী মাতা যার)

একজন কবি নিজকে দ্রষ্টা বানিয়ে তোলে ধারাবাহিকভাবে ইন্দ্রিয়ের বিপর্যয় সাধনের মাধ্যমে। ইন্দ্রিয়ের বিপর্যয় মানে একই ইন্দ্রিয়ের বহুমুখী ব্যবহার। তাতে চেতনার জগৎ হলো বহুধাবিস্তৃত। প্রতীকী কবিতায় পাওয়া যায় যৌক্তিক পারম্পর্য ভেঙে বিমূর্ত অনুভবের স্বাদ। উন্মোচিত হয় অভিধা অতিরিক্ত এক অনুভূতির জগৎ। যে ধ্বনি ছিল শুধুই শ্রবণের যোগ্য, ইন্দ্রিয় বিপর্যয়ের পর হয়ে উঠল দৃশ্য ও আস্বাদনের বস্তু। শব্দের বহুবৈচিত্র্য ও অন্তরবাহিত রূপ হলো আবিষ্কৃত। প্রতীক হলো শিল্পসমৃদ্ধি; বৈজ্ঞানিক ও দার্শনিক ভিত্তির ওপর যার অমর অধিষ্ঠান। সমুন্নত যার চূড়া, রূপ ঘনসংবদ্ধ; অক্ষয় তার ঐশ্বর্য, স্থাপত্যে সে গথিক। তার সাক্ষ্য রয়েছে র‌্যাবোঁর দিপালী, নরকে এক ঋতু কাব্যগ্রন্থে।

প্রতীকী আন্দোলন বৈশিষ্ট্যপূর্ণ হলো তার দীর্ঘজীবিতার জন্য। ঊনবিংশ শতাব্দী শেষ হতেই প্রকৃতিবাদী উপন্যাসের মৃত্যু হয় কিন্তু ১৮৯০-এর দশকের পর প্রতীকী আন্দোলনের বিস্তৃতি ঘটে জার্মান, ইংল্যান্ড ও আমেরিকায়। বেলজিয়ান নাট্যকার বরিস ম্যাটারলিঙ্কের ব্লু বার্ড আনন্দের প্রতীক। হেনরিক ইবসেনের বুনো হাঁস হলো এক বন্ধুর ষড়যন্ত্রে পঙ্গু আরেক বন্ধু একডালের আশার প্রতীক। ইয়েটস প্রতীক গ্রহণ করেন জাদুবিদ্যা, পুরাণ, থিওলজি, ও কিংবদন্তি থেকে। বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের স্বপ্নে তিনি ছিলেন বিভোর, তার রাজহাঁস রাজকীয়তার প্রতীক। রবীন্দ্রনাথ ১৮৮০ সালে লন্ডন প্রবাসকালে পড়েছিলেন দ্য অরিজিন অ্যান্ড ফাংশন অব মিউজিক, তাই তার গীতিনাট্য ও নৃত্যনাট্যে দেখা যায় সংগীত আর সাংকেতিকতার সংমিশ্রণ। রাজা, ডাকঘর, রক্তকরবী নাটকে তার ছাপ সুস্পষ্ট। প্রতীকের ব্যবহারে সুধীন্দ্রনাথ দত্ত ও বুদ্ধদেব বসু অগ্রগণ্য। বোদলেয়ার যেমন অনুরক্ত ছিলেন এডগার এলান পোর প্রতি, বাংলাদেশে তেমনি অনুরক্ত ছিলেন বুদ্ধদেব বসু বোদলেয়ারের প্রতি। সুধীন্দ্রনাথ ঘোষণা করেন ‘মালার্মের কাব্যাদর্শই আমার অন্বিষ্ট’। বাংলাদেশে তার শেষ প্রতিধ্বনি শোনা যায় আজিজ ইকবালের কবিতায়, তার প্রথম কাব্যগ্রন্থের নামই ‘প্রতীকের হাত ধরে।’

টমাস কার্লাইল বলেছেন, যে যুগ প্রতীককে যথার্থ মর্যাদা দিয়ে তার মান উঁচুতে ধরে রাখতে সচেষ্ট সে যুগ শ্রেষ্ঠ। হার্বার্ট রিড বলেছেন, প্রতীকবাদ একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ বিজ্ঞান। তার জয়যাত্রা অপ্রতিরোধ্য। সে ছুটে চলেছে এক শতাব্দী থেকে আরেক শতাব্দীতে, এক মহাদেশ থেকে আরেক মহাদেশে।

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম