আমি স্বপ্ন বেচে ফিরি
গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস, ভাষান্তর : সুরাইয়া ফারজানা হাসান
প্রকাশ: ২১ নভেম্বর ২০১৯, ০৬:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
একদিন সকাল ন’টায়, আমরা যখন উজ্জ্বল সূর্যের নিচে হাভানা রিভিয়েরা হোটেল প্রাঙ্গণে প্রাতঃরাশ সারছিলাম, সে সময় সাগরের এক সুবিশাল ঢেউ কয়েকটি গাড়ি টেনে সাগরে ভাসিয়ে নিয়ে যায়, গাড়িগুলোর কোনোটি হোটেলের পার্শ্ববর্তী সড়ক দিয়ে সৈকতের দেয়াল বরাবর চলছিল, কোনোটি ফুটপাতে পার্ক করা ছিল, এবং একটি হোটেল প্রাঙ্গণের ভেতরে ছিল। ডিনামাইটের মতো বিস্ফোরণে পুরো বিশতলা ভবনে আতঙ্ক সৃষ্টি হয় এবং হোটেলের প্রবেশ মুখের বিশাল জানালাটা ভেঙে ধুলোয় মিশে যায়। হোটেলের লবির পর্যটকদের অসবাবপত্রসহ যেন শূন্যে ছুড়ে দেয়া হয়েছে, এবং শিলাবৃষ্টির মতো মেঝেতে ছড়িয়ে পড়া ভাঙা কাচে কারও কারও শরীর ক্ষতবিক্ষত হয়ে গেছে। বলতেই হয়, ঢেউটা প্রকাণ্ড ছিল, কারণ সৈকতের দেয়াল এবং হোটেলের মধ্যবর্তী দুই লেনের রাস্তাটা প্রবল বেগে ডিঙানোর পর ঢেউয়ের এতখানি শক্তি অবশিষ্ট ছিল যে হোটেলের জানালা চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যায়।
হাসিখুশি কিউবান স্বেচ্ছাসেবক দল, দমকল বাহিনীর সহায়তায়, ছয় ঘণ্টারও কম সময়ে পুরো ধ্বংসাবশেষ তুলে নিয়ে যায়, এবং সাগরের দিকের প্রবেশদ্বার বন্ধ করে আরেকটি লাগিয়ে দেয় তাতে সবকিছুই আগের মতো স্বাভাবিক হয়ে যায়। সকালবেলায় হোটেলের দেয়ালে গভীরভাবে গেঁথে যাওয়া গাড়ির ব্যাপারে কারও কোনো উদ্বেগ দেখা গেল না, কারণ সবাই ধরে নিয়েছে গাড়িটা ফুটপাতে থাকা গাড়িগুলোর একটি। কিন্তু যখন ক্রেন দিয়ে এটাকে টেনে বের করা হল, তখন গাড়ির স্টিয়ারিং হুইলের পেছনে চালক আসনে বেল্ট বাঁধা অবস্থায় এক ভদ্রমহিলার নিথর দেহ দেখা গেল। ঢেউয়ের আঘাত এতটাই নিষ্ঠুর ছিল যে, মহিলার একটি হাড়গোড়ও আস্ত রাখেনি। মহিলার হাতের আঙুলে সাপের নকশায়, পান্না সবুজ পাথরের চোখ বসানো একটি আংটি। পুলিশ তাকে নবনিযুক্ত পর্তুগিজ রাষ্ট্রদূতের হাউসকিপার বলে শনাক্ত করে। তিনি রাষ্ট্রদূত পরিবারের সঙ্গে দুই সপ্তাহ আগে কিউবায় এসেছেন এবং সেদিন সকালে বাজার থেকে কিছু কেনাকাটার উদ্দেশ্যে নতুন গাড়িটা নিয়ে বের হয়েছিলেন। পত্রিকায় খবরটা পড়ার সময়, আমার কাছে ভদ্রমহিলার নাম তেমন গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়নি, তবে তার পান্না পাথরের চোখ বসানো সর্পাকৃতির আংটির খবরে হতভম্ব হয়ে যাই। খবর পড়ে বের করতে পারলাম না কোন আঙুলে তিনি আংটিটা পরেছিলেন।
খুবই গুরুত্বপূর্ণ এক তথ্য। আমার মনে আশঙ্কা জাগল- ইনি বোধহয় সেই অবিস্মরণীয় নারী, যার প্রকৃত নাম আমি জানি না, যিনি তর্জনীতে এক সময়ে এ রকম এক আংটি পরতেন, যে আংটিটা এখনকার তুলনায়, অতীতের সেই সময়ে বেশ অস্বাভাবিক দেখাত। তার সঙ্গে চৌত্রিশ বছর আগে ভিয়েনায় এক পানশালায় দেখা হয়েছে, যেখানে লাতিন আমেরিকার ছাত্ররা ঘনঘন আসত। তিনি তখন সেখানে বসে সিদ্ধ আলুর সঙ্গে সসেজ আর বিয়ার খাচ্ছিলেন। সেদিন সকালে আমি রোম থেকে এসেছি। এখনও স্মরণ করতে পারি- তার সোপ্রানো গায়িকার মতো সরু কণ্ঠস্বর, কোটের কলারে অসাড় হয়ে পড়ে থাকা শেয়ালের লেজ, এবং হাতের সর্পাকৃতির সেই মিসরীয় আংটির প্রতি আমার তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া। তিনি খটোমটো উচ্চারণে অতিসাধারণ মানের স্প্যানিশে অনর্গল কথা বলে যাচ্ছিলেন। শুনে আমার মনে হল, সেই লম্বা কাঠের খাওয়ার টেবিলে তিনিই কেবল একমাত্র অস্ট্রিয়ান। কিন্তু না, তিনি কলম্বিয়ায় জন্মেছেন, এবং একটু বড় হতেই দুটি বিশ্বযুদ্বের মাঝামাঝি সময়ে সঙ্গীত ও সুর সাধনার লক্ষ্যে অস্ট্রিয়ায় পা রাখেন। তখন তিনি তিরিশ ছুঁই ছুঁই করছেন, এবং সময়টা তার খুব একটা ভালো যাচ্ছিল না, কারণ তিনি সুন্দরী তো ননই বরং এ বয়সেই বুড়িয়ে যেতে শুরু করেছেন। তবে মানুষ হিসেবে তিনি চমৎকার এবং মারাত্মক- উদ্দীপনা প্রদানকারীদের একজন।
ভিয়েনা তখন প্রাচীন-সাম্রাজ্যের শহর, যার ভৌগোলিক অবস্থান দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর দুটো শত্রুভাবাপন্ন বিশ্বের মাঝে, এবং শহরটা কালোবাজারি ও গুপ্তচরবৃত্তির স্বর্গরাজ্য। আমি আমার পলাতক স্বদেশবাসীদের থাকার জন্য এর চেয়ে জুতসই কোনো স্থানের কথা কল্পনা করতে পারিনি। ভিয়েনায় বসবাসকারী কলম্বিয়ান ছাত্ররা তখন স্বজাতি হওয়ার খাতিরে সরাইখানায় তার টেবিলের এক কোণে খেতে বসে যেত, কারণ সঙ্গীদের খাবারের বিল মিটানোর মতো পর্যাপ্ত টাকা-পয়সা তার ছিল। তিনি কখনও তার আসল নাম জানাননি। তবে তার জার্মান ভাষায় বুলি আওড়ানো শুনে, আমরা ভিয়েনায় বসবাসকারী লাতিন আমেরিকার ছাত্ররা তার নাম আবিষ্কার করলাম- ফ্রাউ ফ্রিডা। তার সঙ্গে পরিচিত হওয়ার পর পরই জ্যাঠামো করে এক প্রশ্ন জিজ্ঞেস করেছিলাম। সেটা হল- তিনি তার জন্মস্থান, ঝড়ো বাতাস আর খাড়া বাঁধ ঘেরা কিন্দিও থেকে একেবারেই ভিন্ন, এতদূরে বিশ্বের এ প্রান্তে কী করে জীবন চালাচ্ছেন, আর তিনি চমৎকার এক উত্তর দিয়েছিলেন-
‘আমি স্বপ্ন বেচে ফিরি।’
বাস্তবে, ওটাই ছিল তার একমাত্র জীবিকা। তিনি প্রাচীন কালাদাস্ শহরের ধনী দোকানদারের এগারো সন্তানের মধ্যে তৃতীয়তম। মুখে বুলি ফোটার পরপরই, তিনি পরিবারের প্রাতঃরাশের আগে স্বপ্ন বলার এক চমৎকার প্রথা প্রবর্তন করেন। সে সময়ে পরিবারে ফ্রাউ ফ্রিডার ভবিষ্যদ্বাণী অত্যন্ত মনোযোগসহকারে শোনা হতো। মাত্র সাত বছর বয়সে, তিনি স্বপ্ন দেখেন, তার এক ভাই বানের জলে ভেসে গেছে। স্বপ্নের কথা শুনে তার মা কুসংস্কারবশে ছেলেটিকে গিরিখাতে সাঁতার কাটতে নিষেধ করেন। অথচ সেখানে সাঁতার কাটতে ছেলে খুব ভালোবাসে। তবে ফ্রাউ ফ্রিডা যে ভাইটির উদ্দেশে স্বপ্নে পাওয়া এক ভবিষ্যদ্বাণী করে ফেলেছেন।
‘স্বপ্নটার মানে কী বলত,’ তিনি মাকে বলেছিলেন, ‘স্বপ্নটার মানে এই না যে, ও জলে ডুবে মরবে, বরং মানে এই, ওর মিষ্টি খাওয়া বারণ।’
ফ্রাউ ফ্রিডার স্বপ্নের মাজেজা পাঁচ বছর বয়সী সেই বালকের কাছে জঘন্য মনে হল। কারণ রোববারের মিষ্টান্ন ছাড়া সে বেঁচে থাকার কথা ভাবতেই পারে না। ওদের মা, মেয়ের ভবিষ্যদ্বাণী বিশ্বাস করে, কঠোর সতর্ক অবস্থান নেয়। তবে তার প্রথম অসতর্ক মুহূর্তেই ছেলেটি এক টুকরা ক্যারামেল লজেন্স গোপনে খাওয়ার চেষ্টা করে। আর লজেন্সটা গলায় আঁটকে গেলে, তাকে বাঁচানোর আর কোনো উপায় রইল না।
ভিয়েনার নিষ্ঠুর শীত গলা চেপে ধরার আগ পর্যন্ত ফ্রাউ ফ্রিডা কখনও ভাবেননি- তাকে বেঁচে থাকার জন্য স্বপ্নে পাওয়া ভবিষ্যদ্বাণীর ক্ষমতা দিয়ে উপার্জন করতে হবে। তিনি থাকার উপযুক্ত প্রথম বাড়িটা খুঁজে বের করলেন, এবং বাড়ির লোকজন যখন জিজ্ঞেস করে তিনি কী করেন, তিনি উত্তরে কেবল সত্যটাই জানালেন, ‘আমি স্বপ্ন দেখি।’ সংক্ষেপে বাড়িওয়ালিকে স্বপ্নের মাধ্যমে তার ভবিষ্যদ্বাণী করার ক্ষমতার কথা বললেন, এবং ভদ্রমহিলাটি তাকে সামান্য কিছু অর্থের বিনিময়ে এ কাজে নিযুক্ত করেন। যদিও সেই অর্থ দিয়ে কেবল ছোটখাটো প্রয়োজনই মেটানো যায়, তবে তিনি এর বাইরে থাকার জন্য নিখরচায় চমৎকার একটা ঘর আর তিন বেলার খাবার, বিশেষ করে প্রাতঃরাশ পাবেন। প্রতিদিন সকালে প্রাতঃরাশের টেবিলে থাকেন : পরিবারের বাবা, একজন বিশিষ্ট বিনিয়োগকারী; মা, একজন সদাশয় হাসিখুশি মহিলা যিনি রোমান্টিক গানের দারুণ ভক্ত; এবং দু’জন ছেলেমেয়ে, একজনের বয়স এগারো আরেকজনের নয়। পরিবারের সবাই ফ্রাউ ফ্রিডার কাছে নিকট ভবিষ্যৎ জানতে চাইত। ওরা আপাদমস্তক ধার্মিক। ফ্রাউ ফ্রিডাকে ঘিরে ওদের বেশ আগ্রহ। তার একমাত্র কাজ ছিল প্রতিদিন স্বপ্ন দেখে পরিবারের প্রত্যেকের জন্য ভবিষ্যদ্বাণী করা।
দীর্ঘদিন ধরে, তিনি তার কাজ ভালোমতোই চালিয়ে যাচ্ছিলেন, বিশেষ করে যুদ্ধের সময়, যখন বাস্তবতা দুঃস্বপ্নের চেয়েও অলুক্ষণে। প্রাতঃরাশের সময়, তিনিই বলে দিতেন, প্রত্যেকের সেদিন কী কী কাজ করা উচিত, এবং কীভাবে তা করবে। এভাবে তিনি এক সময় পরিবারের সর্বময় কর্তৃত্বের অধিকারী হয়ে ওঠেন। পরিবারটির ওপর ফ্রাউ ফ্রিডার নিয়ন্ত্রণ ছিল অসীম : ছোট্ট একটা শ্বাস ফেলতেও তার অনুমতি নিতে হতো। আমি ভিয়েনায় থাকার সময়ই ওই পরিবারের কর্তা মারা যান, এবং ভদ্রলোক তার এস্টেটের একটা অংশে ফ্রাউ ফ্রিডাকে দিয়ে যান এই শর্তে, স্বপ্ন ফুরিয়ে যাওয়ার আগ পর্যন্ত পরিবারটির জন্য স্বপ্ন দেখে যাবেন এবং ভবিষ্যদ্বাণী করবেন।
ভিয়েনায় আমি এক মাসেরও বেশি সময় ছিলাম। সে সময় অর্থের অপেক্ষায় দিন গুনে অন্যসব ছাত্রদের মতো দুস্থ অবস্থায় দিন কাটিয়েছি। বলা বাহুল্য, অপেক্ষায় থাকা সেই অর্থ কখনও হাতে এসে পৌঁছায়নি। এমন দুর্দিনে ফ্রাউ ফ্রিডা যখন পানশালায় অপ্রত্যাশিতভাবে উপস্থিত হয়ে হাত খুলে আমাদের খাওয়ানোর দ্বায়ভার নিতেন, দরিদ্র ছাত্রদের মাঝে যেন উৎসবের আমেজ চলে আসত। এক রাতে, বিয়ারে বুঁদ হয়ে আছি। এমন সময় তিনি আমার কানে ফিসফিসিয়ে বললেন, ‘এক মুহূর্তও দেরি কোরো না। আমি শুধু তোমায় বলতে এসেছি, গতরাতে তোমাকে নিয়ে একটা স্বপ্ন দেখেছি,’ তোমায় এখনই চলে যেতে হবে, আর পাঁচ বছরের মধ্যে ভিয়েনায় আসবে না।’
তার আদেশ এতটাই শিরোধার্য ছিল, আমি সে রাতেই শেষ ট্রেনে চড়ে রোমের উদ্দেশে রওনা দিই। আমি তার স্বপ্নে এতটাই প্রভাবান্বিত যে, আমি নিজেকে ওই রাজনৈতিক দুর্যোগ থেকে বেঁচে যাওয়া ভাগ্যবান ব্যক্তি বলে মনে করতাম, এবং এখনও বিশ্বাস করি তার কারণেই আমাকে সেই ভয়ানক অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে হয়নি। আমি আর ভিয়েনায় ফিরে যাইনি।
হাভানায় দুর্যোগের আগে, আমি ফ্রাউ ফ্রিডাকে বার্সেলোনায় এতটা অপ্রত্যাশিত এবং দৈবক্রমে অবস্থায় দেখি যে, ব্যাপারটা আমার কাছে রহস্যময় বলে মনে হয়েছে। সেদিনই পাবলো নেরুদা গৃহযুদ্ধের পর স্পেনের মাটিতে প্রথম পা রেখেছেন। ভালপারাইসো যাওয়ার দীর্ঘ সমুদ্র যাত্রায় এখানে বিরতির জন্য থেমেছেন। তিনি প্রথমদিন সকালবেলা আমাদের সঙ্গে, পুরনো বইয়ের দোকানগুলোতে কাটিয়ে দিলেন, এবং পোর্টার নামের এক বইয়ের দোকানে পুরনো, শুকিয়ে যাওয়া, ছেঁড়া, দু’মাসের বাঁধাইকরা বই কিনলেন। বই কেনা বাবদ যে মূল্য তিনি পরিশোধ করেছেন, সে অর্থ তার রেঙ্গুন দূতাবাসের চাকরির দুই মাসের বেতনের সমান। তিনি ভিড়ের ভেতর পঙ্গু হাতির মতো চলছেন, আর যা-ই পাচ্ছেন শিশুর মতো উৎসুক্য নিয়ে দেখেছেন। তার কাছে জগৎটা যেন লণ্ডভণ্ড হয়ে যাওয়া এক বিশাল খেলনার স্তূপ।
আমি রেনেসাঁ আমলের পোপদের কাছাকাছি চরিত্রের এমন কাউকে দেখিনি যিনি একই সঙ্গে পেটুক এবং পরিমার্জিত। তিনি এমনকি ইচ্ছার বিরুদ্ধে, সব সময় খাওয়ার টেবিলে সভাপতিত্ব করতেন। সে সময় নেরুদার স্ত্রী মাতিলদে, তার গলার চারপাশে বাচ্চাদের মতো বিব্ পরিয়ে দিতেন। বিব্টা খাবারঘরের বদলে নাপিতের ঘরে শোভা পেলে বরং ভালো ছিল। তবে এ জিনিসটাই তাকে সসে ভিজে গোসল করা থেকে রক্ষা করত। কারভাইয়াসের সেদিনটা ছিল অন্যান্য দিনের মতোই। তিনি একজন শল্যচিকিৎসকের মতো সুচারু দক্ষতায় তিন তিনটে গলদা চিংড়ি ব্যবচ্ছেদ করে খেলেন। এবং একই সময়ে প্রত্যেকের থালার খাবার নিজের চোখ দিয়ে গিলে, প্রতিটি থালা থেকে একটু করে চেখে নিলেন। সংক্রামক রোগের মতো, তার খাওয়ার ইচ্ছাটা উসকে দিচ্ছে খাবারগুলো: গলিসিয়ার ঝিনুক, কান্তাব্রিয়ার গুগলি, আলিকান্তের বাগদা চিংড়ি, কোস্তা ব্রাভার সাগর-শশা। খেতে খেতে তিনি ফরাসিদের মতো উপদেয় খাবারের রন্ধনশৈলী গল্প করে যাচ্ছেন, বিশেষ করে নিজ দেশ চিলির প্রাচীন আমলের চিংড়িজাতীয় খাবারের স্বাদের উৎকর্ষতা সম্পর্কে বললেন, যে খাবারগুলোর সুখময় স্মৃতি তিনি হৃদয়ে বহন করে চলেছেন। আচমকা তিনি খাওয়া বন্ধ করলেন। গলদা চিংড়ির শুঙ্গগুলো গোছগাছ করে আমাকে খুব শান্তস্বরে বললেন : ‘পেছনে কেউ একজন আছে, যে আমার দিকে না তাকিয়ে পারছে না।’
তার কাঁধের ওপর দিয়ে পেছনে তাকাই এবং দেখি যে ঘটনা সত্য। তিন টেবিল পেছনে, এক নির্ভীক মহিলা বসে আছেন। ভদ্রমহিলার মাথায় পুরনো-কেতায় ভাঁজ করা টুপি এবং গলায় গাঢ় বেগুনি রঙের স্কার্ফ প্যাঁচানো। ধীরে-সুস্থে খাবার চিবোতে চিবোতে তিনি নেরুদার দিকে অপলক তাকিয়ে আছেন। আমি তৎক্ষণাৎ তাকে চিনে ফেলি। বয়স এবং মেদ বাড়লেও, তিনি যে তর্জনীতে সর্পাকৃতির আংটি পরা সে-ই ফ্রাউ ফ্রিডা।
তিনি নেরুদা আর তার স্ত্রীর সঙ্গে একই জাহাজে করে নেপল্স থেকে ফিরছিলেন, তবে জাহাজে থাকা অবস্থায় তাদের দেখা হয়নি। আমরা ফ্রাউ ফ্রিডাকে কফি খেতে আমাদের টেবিলে আমন্ত্রণ জানাই, এবং আমি কবিকে (নেরুদা) চমকে দেয়ার জন্য তাকে স্বপ্নের ভবিষ্যদ্বাণীর ব্যাপারে কথা বলতে উৎসাহ দিই। কবি তাতে মানোযোগ দেননি, কারণ শুরুতেই তিনি ঘোষণা দিয়েছেন, স্বপ্নে পাওয়া ভবিষ্যদ্বাণীতে তার বিশ্বাস নেই।
‘একমাত্র কবিতারই সেই আলোকদৃষ্টি আছে,’ তিনি বললেন।
মধ্যাহ্ণভোজের পর, রাম্বলাসে বাধ্যতামূলক হাঁটাহাঁটি করার সময়, আমি ফ্রাউ ফ্রিডার পেছনে পেছনে চলতে লাগলাম, যাতে সবার অগোচরে, আমরা আমাদের পুরনো স্মৃতিটা ঝালিয়ে নিতে পারি। তিনি জানালেন, ভিয়েনার সব সম্পত্তি বেচে দিয়ে পর্তুগালের ওপোর্তোতে অবসর সময় কাটোচ্ছেন। তার ভাষ্যমতে, সেখানে পাহাড়ের ওপর দুর্গের মতো এক বাড়িতে থাকেন, যেখান থেকে আমেরিকা যাওয়ার মহাসাগরের পুরোটা পথ দেখা যায়। যদিও তিনি মুখে বলেননি, তবে তার কথাবার্তায় স্পষ্ট, স্বপ্নের পর স্বপ্ন দেখে ভবিষ্যদ্বাণী করে, তিনি ভিয়েনায় তার মনিবের দাক্ষিণ্যে প্রচুর ধনসম্পদ বাগিয়ে নিয়েছেন। বিষয়টা আমাকে অবাক করেনি। যাই হোক, আমি সবসময় ভেবেছি তার স্বপ্নগুলো বেঁচে থাকার জন্য কৌশল ছাড়া আর কিছুই নয়। এবং তাকে কথাটা বলেও ফেলেছি।
কথাটা শুনে তিনি অট্টহাসিতে ফেটে পড়লেন। ‘তুমি তো সব সময়ই ঠোঁটকাটা,’ তিনি বললেন, তবে এর বেশি কিছু বলেনি, কারণ দলের অন্যরা থেমে অপেক্ষা করছে, কখন নেরুদা রামব্লাস দে লস্ পাহারোসের তোতাপাখিদের সঙ্গে চিলির অশ্লীল ভাষায় কথা বলা থামাবেন। আমরা যখন আলোচনায় ফিরে এলাম, ততক্ষণে ফ্রাউ ফ্রিডা প্রসঙ্গ পাল্টে ফেলেছেন।
যাই হোক, তিনি বললেন, ‘তুমি এখন ভিয়েনায় ফিরে যেতে পারো।’
তখনই উপলব্ধি করলাম, আমাদের প্রথম সাক্ষাতের পর তেরোটি বছর পার হয়ে গেছে।
‘যদি আপনার স্বপ্নটা মিথ্যেও হয়, আমি কখনই ভিয়েনায় ফিরে যাব না।’ আমি তাকে বলেছি। ‘অন্তত এই কারণে।’
দুপুর তিনটায় আমরা নেরুদার পবিত্র সিয়েস্তায় সঙ্গ দেয়ার জন্য ফ্রাউ ফিডাকে ছেড়ে চলে এলাম। সে সময় আমাদের বাড়িতে নেরুদার থাকার জন্য এমন যত্নসহকারে প্রস্তুতি নেয়া হয় যে, জাপানের চা উৎসবের স্মৃতি মনে পড়ে যায়। ঘরের তাপমাত্রা সঠিক রাখার জন্য কিছু জানালা খোলা; আর কিছু বন্ধ করে দেয়া হয়, এবং বিশেষ দিক থেকে, বিশেষ ধরনের আলো এবং অখণ্ড নীরবতার ব্যবস্থা করা হয়। নেরুদা তৎক্ষণাৎ ঘুমিয়ে পড়েন, এবং ঠিক দশ মিনিট পর বাচ্চাদের মতো জেগে ওঠেন, যেটা আমরা আশা করিনি। তিনি একটু সতেজ হয়ে এবং গালে বালিশের কাভারের মনোগ্রামের ছাপ নিয়ে বসার ঘরে উপস্থিত হন।
‘যে মহিলাটি স্বপ্ন দেখে, আমি তাকে স্বপ্নে দেখলাম,’ তিনি বললেন।
স্ত্রী মাতিলদে চাইছিলেন, তিনি স্বপ্নটা বলুন।
‘স্বপ্নে দেখলাম, সে আমায় স্বপ্ন দেখছে,’ তিনি বললেন।
‘সেটা ঠিক বোর্হেসের গল্পের বাইরে’, আমি বললাম।
তিনি আমার দিকে হতাশ ভঙ্গিতে তাকালেন।
‘সে কি এটা লিখে ফেলেছে?’
‘যদি সে না-ও লিখে, কোনো এক সময় লিখে ফেলবে,’ আমি বললাম। ‘এটা হবে বোর্হেসের অন্যান্য গোলকধাঁধাঁগুলোর মধ্যে একটি।’
যথাশীঘ্রই তিনি সন্ধ্যা ছ’টার জাহাজে ওঠেন। নেরুদা আমাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে একটি বিচ্ছিন্ন টেবিলে বসলেন, এবং সবুজ কালির কলমে তার দ্রবীভূত কবিতাগুলো লিখতে শুরু করেন। কলমটা দিয়ে, তিনি তার বই কাউকে উৎসর্গ করার সময় ফুল, মাছ এবং পাখি আঁকেন। আমরা প্রায় ফ্রাউ ফিডাকে বিদায় না জানিয়েই চলে আসছিলাম। জাহাজ ছাড়ার পর, প্রথমেই তার খোঁজ করি এবং অবশেষে পর্যটক ডেকে তাকে দেখতে পাই। তিনিও সিয়েস্তা নিচ্ছিলেন।
‘আমি কবিকে স্বপ্ন দেখেছি,’ তিনি আমাকে বললেন।
আমি অবাক হয়ে তাকে স্বপ্নটা বলতে বললাম।
‘স্বপ্নে দেখি, তিনি আমায় স্বপ্ন দেখছেন,’ তিনি বললেন, এবং আমার মুখের বিস্ময়ভাব তাকে অপ্রতিভ করল। ‘তোমরা কী আশা করেছিলে, বল? মাঝেমাঝে, আমার কিছু স্বপ্ন ছুটে যায় বটে, তবে সেসব নিয়ে বাস্তবে কিছু করার নেই।’
আমি আর তাকে কখনও দেখিনি। অথবা তার সম্পর্কে আর কোনো বিস্ময়ও জাগেনি, যতক্ষণ না পর্যন্ত পত্রিকায় পড়ি, সাপের নকশা করা আংটি পরা এক মহিলা হাভানা রিভিয়েরা হোটেলের পাশে প্রাকৃতিক দুর্যোগে মারা গেছেন। এবং কয়েক মাস পর এক কূটনৈতিক অভ্যর্থনা অনুষ্ঠানে যখন পর্তুগিজ রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে দেখা হয়, আমি ফ্রাউ ফ্রিডার ব্যাপারে জিজ্ঞেস করার লোভ সামলাতে পারিনি। রাষ্ট্রদূত খুব উৎসাহ নিয়ে তার অনেক তারিফ করছিলেন। ‘আপনি কল্পনাও করতে পারবেন না, ভদ্রমহিলা কতটা অসাধারণ ছিলেন,’ তিনি বললেন। ‘যদি তার সম্পর্কে জানেন, তবে তাকে নিয়ে না লিখে পারবেন না।’ এবং তিনি একই ভঙ্গিতে, ফ্রাউ ফিডা সম্পর্কে অদ্ভুতরকম বিস্তারিত বলে গেলেন, তবে তাতে এমন কোনো সূত্র নেই যা থেকে আমি চূড়ান্ত উপসংহার টানতে পারি।
‘এক কথায়,’ আমি ভদ্রলোককে অবশেষে জিজ্ঞেস করলাম, ‘তিনি কী করতেন বলুন তো?’
‘কিছুই না,’ কিঞ্চিত মোহমুক্ত হয়ে তিনি বললেন, ‘তিনি স্বপ্ন দেখতেন।’
