Logo
Logo
×

সাহিত্য সাময়িকী

ভালোবাসার যোগ্য হয়ে ওঠাটা সবার জন্যই উন্মুক্ত: আইন র‌্যান্ড

Icon

প্রকাশ: ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ০৬:০০ পিএম

প্রিন্ট সংস্করণ

প্রেম ও ভালোবাসার সংজ্ঞা নিয়ে এখনও নানা জল্পনা চলছে। কারও মতে এ কেবল জৈব-রাসায়নিক প্রক্রিয়া, কারও মতে আমাদের জৈবিক চাহিদাকে মানবিকীকরণের এ এক আত্মপ্রবঞ্চক ফন্দি। কেউবা একে দেখেছেন শরীর-বিচ্যুত প্লেটনিক দৃষ্টিকোণ থেকে। কেউ এর নৈতিক দিকটির ওপর গুরুত্ব দিতে গিয়ে পারস্পরিক সমঝোতা, বিশ্বস্ততা, আত্মত্যাগ, এসব সামাজিক উপযোগের কথা করেছেন আলোচনা। এই যে প্রেম-ভালোবাসার সংজ্ঞায়নের অসামঞ্জস্যতা, তারও রয়েছে একটি ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট। প্রাচীনকাল থেকে শারীরিক সম্পর্ক তথা বিবাহকে ব্যবহার করা হয়েছে রাজনৈতিক মৈত্রী বন্ধনের হাতিয়ার হিসেবে, মধ্যযুগে অর্থবিত্ত আহরণের সুযোগ হিসেবে, আর হাল আমলে পাশ্চাত্যে বিবাহবহির্ভূত যৌনাচারের সুবাদে ব্যবহারিক কিছু সুযোগ করায়ত্ত করার মাধ্যম হিসেবে। তবে প্রেম-ভালোবাসা সম্ভবত শরীর ও মনের জটিল এক মিথষ্ক্রিয়া, যা সময়, সমাজ ও সংস্কৃতি দ্বারা নির্ণীত ও চর্চিত হয়। প্রেমকে বোঝার ব্যাপারে এ অস্পষ্টতা এবং প্রচ্ছন্নতা একে আরও মহিমান্বিত করেছে, করেছে রহস্যাবৃত অথচ আরাধ্য।

তবে এতসব প্রচ্ছন্নতার মাঝে একজন আধুনিক দার্শনিক ভালোবাসার ব্যাখ্যায় চিরাচরিত সাবজেক্টিভিজমের বিপরীতে অবজেক্টিভিজমের দ্বারস্থ হয়েছেন। তার নাম আইন র‌্যান্ড (Ayn Rand)। রাশিয়ান আমেরিকান এ নারী ঔপন্যাসিক ও দার্শনিক জন্মগ্রহণ করেন ১৯০৫ সালের ২ ফেব্রুয়ারি এবং মারা যান ১৯৮২ সালের ৬ মার্চ। তার বিখ্যাত বই ‘অ্যাটলাস শ্রাগড ও দা ফাউন্টেনহেড’ প্রকাশিত হয় রঙিন টেলিভিশন বাজারে আসারও আগে- ১৯৬০-এর দশকে। কিন্তু তার অবজেক্টিভিজমের তত্ত্ব, তথা নিজের স্বার্থপরতার ওপর বিশ্বাস, তথা সবাইকে প্রথমে ও সবচেয়ে ভালো করে নিজের যত্ন নিতে হবে, এ ধারণা এখনও চিন্তার জগতে দারুণ আলোচনা ও সমালোচনার ঝড় তোলে। তার মতে, মানুষের নিজের সুখই তার নৈতিকতার মূল ভিত্তি। এটিই, তার মতে, সবকিছুর মৌলিক ও পরম কারণ। কারও কারও মতে আইন র‌্যান্ডের দর্শন খুবই সাদাসিধে, শীতল ও অতি-সরল। কিন্তু অন্য অনেকের মতে এটিই চিন্তার সঠিক পথ। মাইক ওয়ালেস নামের একজন বিখ্যাত সাংবাদিক ১৯৫৯ সালে এ বিতর্কিত নারী দার্শনিকের একটি সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেন ‘দা মাইক ওয়ালেস ইন্টারভিউ’ নামের টেলিভিশন টকশোর জন্য। সেই সাক্ষাৎকারে প্রেম-ভালোবাসার সংজ্ঞা নিয়ে আইন র‌্যান্ডের মতামত জানতে পারা যায়। সাক্ষাৎকারটি অনুবাদ করেছেন কবি তৌফিক জোয়ার্দার

তুমি কে, আইন র‌্যান্ড? তোমার কথায় একটা টান আছে, যা...

রাশিয়ান। রাশিয়ান? তোমার জন্ম কি রাশিয়ায়?

-হ্যাঁ।

এ দেশে এসেছ কবে?

-সে প্রায় ৩০ বছর হবে

আর তোমার এ দর্শন, তা কোত্থেকে পেলে?

-আমার নিজের মন থেকেই; তবে এর জন্য অ্যারিস্টোটলের ঋণ স্বীকার করতেই হয়, তিনিই একমাত্র দার্শনিক যিনি আমাকে প্রভাবিত করতে পেরেছেন। তবে দর্শনের বাদবাকি অংশ আমি নিজেই দাঁড় করিয়েছি।

তুমি বিবাহিতা?

-হ্যাঁ।

তোমার স্বামী, সে কি কোনো শিল্পপতি?

-না। সে একজন শিল্পী। তার নাম ফ্র্যাঙ্ক ও’কনোর।

সে কি তার শিল্পের মাধ্যমেই জীবিকা নির্বাহ করে?

-সে মাত্রই পেইন্টিং নিয়ে পড়াশোনা শুরু করেছে। সে আগে ডিজাইনার ছিল।

তার কাজের জন্য সে কি সরকারের কাছ থেকে কোন সহায়তা বা ভাতা পায়?

-অবশ্যই না।

তাহলে কি সাময়ীকভাবে সে তোমার সাহায্যের ওপর চলছে?

-না, তার নিজের কাজ থেকেই তার ব্যয় নির্বাহ হয়। অতীতে কখনও আমার কাছ থেকে সাহায্য নিয়ে থাকতে পারে, তবে সেটার খুব একটা প্রয়োজন হয়নি।

এই যে তুমি তাকে বিভিন্ন সময় সাহায্য সহযোগিতা করেছ, এর মাধ্যমে তুমি কি তোমার দর্শনের সঙ্গে স্ববিরোধিতা করনি?

-না; কারণ আমি স্বার্থপরভাবে তাকে ভালোবাসি। তার কোনো প্রয়োজন হলে তাকে সাহায্য করাটা আমার নিজের স্বার্থেই। আমি একে কোনো আত্মত্যাগ বলব না, কারণ এর মাঝে আমি এক ধরনের স্বার্থপর আনন্দ খুঁজে পাই। আমি বলি নিজের সুখের ওপর প্রত্যেক মানুষের নিজস্ব অধিকার আছে। এবং এই সুখ তার নিজেকেই অর্জন করে নিতে হবে। তার এটা দাবি করা উচিত হবে না যে, অন্য কেউ নিজের সুখ বিসর্জন দিয়ে তাকে সুখী করবে। এবং সেই সঙ্গে তারও উচিত হবে না নিজের সুখকে বিসর্জন দিয়ে অন্যকে সুখী করতে যাওয়া। আমি বিশ্বাস করি মানুষের আত্মসম্মান থাকা উচিত।

এবং তার আশপাশের অন্য মানুষকে ভালোবাসলে তার আত্মসম্মান থাকবে না! হায় যিশু, মানুষের ইতিহাসের প্রত্যেক গুরুত্বপূর্ণ নীতিবান নেতা আমাদের শিখিয়েছেন যে, আমাদের একে অপরকে ভালোবাসা উচিত। তাহলে, এ ধরনের ভালোবাসা তোমার কাছে কেন নীতিহীন মনে হচ্ছে?

-এটা নীতিহীন যদি এ ভালোবাসাকে নিজের ওপরে স্থান দেয়া হয়। এটা শুধু নীতিহীনই না, এটা অসম্ভবও। কারণ তখন নির্বিচারে সবাইকে ভালোবাসতে হয়, তার মানে কোনো মানদণ্ড ছাড়াই। কোনো মূল্যবোধ বা গুণাবলি নেই এমন কাউকে ভালোবাসতে বলার মাধ্যমে তুমি মূলত কাউকেই সত্যিকার অর্থে ভালোবাসতে দিচ্ছ না।

কিন্তু তোমার বইতে তুমি ভালোবাসা সম্পর্কে এমনভাবে বলেছ যেন, এটা এক ধরনের ব্যবসায়িক লেনদেন। ভালোবাসার সারমর্ম কি এই নয় যে তুমি একজনকে আত্মস্বার্থের ওপর উঠে ভালোবাসবে?

-তাহলে, আত্মস্বার্থের ওপর উঠে ভালোবাসা বলতে কী বোঝায়? এটা দিয়ে বোঝায়- যেন, প্রচলিত নৈতিকতার মানদণ্ডে নীতিবান একজন স্বামী তার স্ত্রীকে বলছে, আমি তোমাকে বিয়ে করছি শুধু তোমারই জন্য; আমার এতে নিজের কোনো স্বার্থ নেই। দ্যাখো আমি কতটা অ-স্বার্থপর, তাই শুধু তোমার ভালোর জন্যই তোমাকে বিয়ে করছি।

স্ত্রীর ক্ষেত্রেও কি?

-জানতে চাচ্ছ একজন স্ত্রী এটা পছন্দ করবে কিনা? আমি তোমার কথা স্বীকার করে নিচ্ছি যে বিয়েকে আমি একটা ব্যবসায়িক লেনদেনের মতো দেখিয়েছি। কিন্তু প্রত্যেক ব্যবসায়িক লেনদেনেরই নিজস্ব শর্ত থাকে এবং নিজের মতো মুদ্রা থাকে। এবং ভালোবাসার ক্ষেত্রে সেই মুদ্রা হল গুণ। তুমি একজনকে ভালোবাস এটা ভেবে নয় যে তুমি তার জন্য কী করবে, বা সে তোমার জন্য কী করবে। তুমি তাদের ভালোবাস তাদের মূল্যবোধ ও গুণাবলির জন্য। তুমি কার্যকারণকে ভালোবাস না। এবং তুমি নির্বিচারেও সবাইকে ভালোবাস না। তুমি কেবল তাদেরকেই ভালোবাস যারা তার যোগ্যতা ধারণ করে। মানুষ মুক্ত ইচ্ছার অধিকারী। যদি একজন মানুষ ভালোবাসা প্রত্যাশা করে, তার উচিত নিজের ত্র“টিগুলোকে সংশোধন করা। এরপর সে ভালোবাসা ডিজার্ভ করতে পারে। কিন্তু সে কখনই তা দাবি করতে পারে না যা সে অর্জন করে নেয়নি।

তাহলে তো, তোমার মানদণ্ড অনুযায়ী খুব অল্প মানুষই আছে যারা ভালোবাসা পাওয়ার যোগ্য।

-দুঃখজনক হলেও তা-ই; খুব অল্প। কিন্তু ভালোবাসার যোগ্য হয়ে ওঠাটা সবার জন্যই উন্মুক্ত। আর আমার নৈতিকতা এ উপহারটাই সবাইকে নিশ্চিত করে ভালোবাসার জন্য যোগ্য হয়ে ওঠা; যদিও সেটাই প্রাথমিক উদ্দেশ্য নয়।

এটা কি হতে পারে না যে আসলে আমরা সবাই খুব নিঃসঙ্গ মানুষ, তাই আমরা প্রত্যেকেই পরস্পরের জন্য দায়বদ্ধ?

-কেউ কখনই এমন যুক্তি দাঁড় করাতে পারবে না যে আমরা অপরের জন্য দায়বদ্ধ। এবং তুমি তোমার চারপাশে এমন উদাহরণ অনেক দেখতে পাবে যে, মানুষ অন্যের জন্য দায়বদ্ধ হতে গিয়ে নিজে ধ্বংস হয়ে গেছে।

তোমার কিছুতেই বিশ্বাস নেই, তাই না?

-বিশ্বাস না। শুধু তোমার মনের ওপর। সেটা বিশ্বাস না। সেটা দৃঢ়বিশ্বাস (conviction)। হ্যাঁ, আমার বিশ্বাস বলতে কিছু নেই। আমার কেবল আছে দৃঢ়বিশ্বাস (conviction)।

আইন র‌্যান্ডের সঙ্গে ফ্র্যাঙ্ক ও’কনোরের বিয়ে হয়েছিল ১৯২৯ সালে, যা ১৯৭৯ সালে তার মৃত্যু পর্যন্ত টিকে ছিল।

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম