Logo
Logo
×

সাহিত্য সাময়িকী

মাসুদ আহমেদের রৌদ্রবেলা ও ঝরাফুল

Icon

মুহম্মদ নূরুল হুদা

প্রকাশ: ১১ জানুয়ারি ২০১৮, ০৬:০০ পিএম

প্রিন্ট সংস্করণ

আমাদের সময়ের অনুচ্চকণ্ঠ ও প্রায়-নেপথ্য এক কথাশিল্পীর নাম মাসুদ আহমেদ। সুদীর্ঘকাল ধরে লেখালেখি করলেও প্রাপ্ত তালিকা অনুসারে তার প্রথম গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে ২০০৬ সালে। সে বছর বেরিয়েছিল ‘মেঘ আছে জল নেই’ আর ‘শির্পী’ শীর্ষক দুটি গ্রন্থ। এরপর প্রায় প্রতিবছর প্রকাশিত হয়েছে অন্তত একটি করে গ্রন্থ। এখন তার গ্রন্থসংখ্যা তেইশটির মতো, যার অধিকাংশই গল্প। ভেবে-চিন্তে পরিকল্পিত বিন্যাসে তিনি তার কাহিনী বিন্যাস করেন। একটি সুপরিস্ফুট প্লট তার প্রতিটি রচনার মূল আকর্ষণ। পড়তে পড়তে মনে হয়, তিনি না-গল্পে ও অভিনব নিরীক্ষায় খুব উৎসাহী নন। বরং তার অন্বিষ্ট জীবনমুখী আখ্যান-উপাখ্যান, যার পটভূমি সমকাল ও ইতিহাস-ঐতিহ্য। আমরা আজ তার যে গ্রন্থ নিয়ে বিশেষ কথা বলব, এবং তার কথাশিল্পের প্রকৃতি অনুধাবন করার চেষ্টা করব সেটিও তেমনি এক চেতন রূপকল্প। এটি মুক্তিযুদ্ধোত্তর বাঙালি সমাজে সতর্কভাবে পর্যবেক্ষণযোগ্য। গ্রন্থটির নাম ‘রৌদ্রবেলা ও ঝরাফুল’। উৎসর্গ পৃষ্ঠায় লেখক বলেছেন, ‘বিশ্বজোড়া ছড়িয়ে থাকা সেসব মহানুভব দম্পতিকে, যারা ১৯৭১-এর যুদ্ধশিশুদের স্থান দিয়েছিলেন স্নেহভরা কোলে।’ অর্থাৎ একাত্তুরের মুক্তিযুদ্ধে যে দুই লাখ যুদ্ধশিশুর জন্ম হয়েছে বলে তথ্য পাওয়া যায়, তাদের জীবন নিয়ে এই উপন্যাসটির শুরু, বিস্তৃতি ও সমাপ্তি। এটি শুধু বাস্তবতা ও মানবতার অনুবর্তী একটি চমকপ্রদ আখ্যানই নয়, বরং এর ভেতর উচ্চারিত হয়েছে এমন কিছু প্রশ্ন যার সদুত্তর আমাদের অনেকেরই অজানা। যুদ্ধশিশু নিয়ে বাংলাদেশের ভেতরে-বাইরে গবেষণামূলক কাজ হয়েছে বাংলা ও ইংরেজিতে। বেশ কিছু কবিতা বা গল্পও রচিত হয়েছে। কিন্তু কোনো পূর্ণাঙ্গ উপন্যাসের আগে রচিত হয়েছে বলে আমাদের জানা নেই। তাই বিষয়গত বিচারে একটি উৎস-প্রতিম কাজ হিসেবে এটি তাৎপর্যপূর্ণ।

প্রফেসর আনিসুজ্জামান তার ভূমিকায় বলেছেন, ‘এই উপন্যাসের পশ্চাদ্ভূমিতে আছে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের বৃহৎ পট, আর সামনে আছে পরবর্তী কোনো সময়ের কয়েকজন ব্যক্তির মনোলোকের নানা ঘাত-প্রতিঘাত। প্রত্যাশিতভাবেই আত্ম-পরিচয়ের সংকটের একটা বড় দিক, আবার সন্তান অপরের হাতে তুলে দেয়ার পরে মায়ের বেদনাবোধ এবং তাকে আবার খুঁজে পাওয়ার আকাক্সক্ষা, তা-ও উল্লেখযোগ্য রূপ পেয়েছে।’ এ গ্রন্থের জট-উন্মোচন আর অন্তর্গত অবলোকনে উপরোক্ত মন্তব্যগুলো সংক্ষিপ্ত হয়েও সুপ্রাসঙ্গিক। সংক্ষেপে এই উপন্যাসের কাহিনীটা রেখায়িত করা যেতে পারে। মহান একাত্তুর বাঙালি জাতির জীবনবাজির বছর। এই সময়-পরিসরে সংঘটিত হয়েছে বাঙালির আত্মপ্রতিষ্ঠার সর্বাত্মক সংগ্রাম মুক্তিযুদ্ধ। পাকিস্তানের অবৈধ সামরিক সরকার তাদের মানবতাবিরোধী সামরিক বাহিনীকে লেলিয়ে দিয়েছিল বাঙালির জাতিগত পরিচয় মুছে ফেলার মতো হীন বাসনা চরিতার্থ করার জন্য। নির্বিচারে গণহত্যার পাশাপাশি ব্যাপক নারী-নির্যাতন চালায় তারা। ধর্ষণ করে লুটে নেয় অসংখ্য বাঙালি মা-বোনের ইজ্জত। ফলে জন্ম নেয় অসংখ্য যুদ্ধশিশু, যারা বাহ্যত জন্মপরিচয়হীন। এই শিশুদের যারা জৈবিক পিতা তারা তাদের পরিচয়কে কূটচালে আড়াল করে রেখেছে, আর এদের জননীরা সামাজিক সম্মান ও লোকলজ্জার ভয়ে সন্তানকে পরিত্যাগ করে সসঙ্কোচে আত্মগোপন করেছে।

জননীদের ভূমিকা বোধগম্য হলেও ধর্ষক পিতাদের ভূমিকা সদাচার ও ন্যায়নীতির পরিপন্থী। আসলে গর্ভজাত সন্তানকে পরিত্যাগ করতে সামাজিকভাবেই বাধ্য হয়েছে এই শিশুদের জননীরা। ব্যক্তি এখানে সমাজের কাছে অসহায় হয়ে পড়েছে। এই ব্যক্তির নাম অসহায় বাঙালি নারী, যাদের আরেক পরিচয় বীরঙ্গনা। প্রকারান্তরে ধর্ষক পাকসেনা তার অজাচারের জাঁতাকলে পুরো-সমাজটাকেই অসহায় করে রেখেছে। অর্থাৎ একদিকে সমাজ বন্দি ধর্ষকের হাতে; অন্যদিকে ধর্ষিতা বন্দি সমাজের কাছে। আর তারই শিকার এক মানবশিশু, যার জন্মের জন্য সে কিছুতেই দায়ী নয়। এ দায়, বলা যেতে পরে সমগ্র মানবজাতির।

এই ধরনের অসহায় এক যুদ্ধশিশুকে দত্তক হিসেবে গ্রহণ করেন এক নিঃসন্তান সুইডিশ দম্পতি। তারা তখন পশ্চিম পাকিস্তানে কর্মরত। দত্তকপিতা স্ট্রাউস ওডারম্যান ও দত্তকমাতা ইলিনা ওডারম্যান। তারা তাদের দত্তকশিশুর নাম রাখলেন পেনরোজ। পেনরোজ নিজে কিছুই জানতে পারল না। সে বেড়ে উঠল এক মুক্ত সমাজের মুক্ত পরিবেশে। দত্তক বাবা-মার নির্মল স্নেহে ও পৃষ্ঠপোষকতায় লালিত পালিত হল সে। কালে কালে সে যৌবনপ্রাপ্ত হল, প্রেমেও পড়ল। তার প্রেমিকার নাম প্রসারপিনা। তার নিজেদের নীড় রচনারও স্বপ্ন আঁকল। ঠিক এই সময়ে, অর্থাৎ উভয়ের বিয়ের আগে তাদের দত্তক পিতামাতা অনুভব করল একধরনের নৈতিক দায়। এই নৈতিক দায়বদ্ধতা থেকেই তারা পেনরোজের কাছে তার জন্ম-সত্য প্রকাশ করতে বাধ্য হল। এখানেই কাহিনীর ক্লাইম্যাক্স শুরু। এখানেই বাস্তবতা, নৈতিকতা, প্রাকৃতিকতা ও মানবিকতার সাংঘর্ষিক মিথস্ক্রিয়া। পেনরোজ তার প্রেমিকারে কাছেও সত্য খুলে ধরল। প্রসারপিনা হাসল, তারপর যা সত্য তাকে সমুন্নত রেখে পেনরোজকেই গ্রহণ করল। এখানে প্রেমের পাশাপাশি প্রাকৃতিক মানবিকতার মহিমাই বিজয়ী হল। তারপর পেনরোজ তার প্রেমিকা প্রসারপিনাকে সঙ্গে নিয়ে তার আসল অর্থাৎ জৈবিক পিতামাতার সন্ধানে বের হল। তার আগে সে তার দত্তক পিতামাতার কাছে তার নিশর্ত আনুগত্য, কৃতজ্ঞতা ও শ্রদ্ধা প্রকাশ করল।

প্রাপ্ত তথ্য ভিত্তি করে পেনরোজ খুব সঙ্গোপন পাকিস্তানে যায়। তারপর বিশেষ কৌশলে পাঞ্জাবে তার জৈবিক পিতা এককালের সুবেদার মালিক তাসকিন উদ্দিন খানের বাড়ির পাশ দিয়ে হেঁটে গেল। না, পিতার মুখোমুখি হল না সে। কৃতজ্ঞ পিতার প্রতি একধরনের ক্ষোভ কি ছিল তার মনে? ছিল অবশ্যই, কেননা সেটিই তো সঙ্গত। তারপর বাংলাদেশের যশোরে এসে তার জননী দেলজুয়ারা বেগমকে খোঁজার চেষ্ট করল। তাকে সহায়তা করল বাংলাদেশ দূতাবাসের একজন কাউন্সিলর। তার নাম নাজনীন। মা ও পুত্রের মধ্যে মিলনের সব ব্যবস্থা পাকা হল। তাকে বিশেষভাবে সাহায্য করলেন তারেই এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা চন্দ্রিমা মৈত্র। দেলজুয়ারা শক্ত করেন নিজের মন। কিন্তু শেষাবধি সিদ্ধান্ত নিতে পারলেন না তিনি ছেলের সঙ্গে দেখা করবেন কিনা। ফলে তাদের প্রত্যাশিত মিলনটি হল না। তবে তিনি জানালার ফাঁক দিয়ে রাস্তা দিয়ে হেঁটে-যাওয়া পেনরোজ ও তার প্রেমিকা প্রসারপিনাকে প্রাণ ভরে দেখলেন। তাদের আশীর্বাদ করলেন। তবে মিলন না হলেও তারা দুজনই বিশ্বাস করতে শুরু করে যে তাদের অবস্থানগত কোনো পরিবর্তন ঘটেনি। তাদের মূল পরিচয় মা ও পুত্র। এই পরিচয় শাশ্বত। এই পরিচয় অমোচনীয়। কাহিনী বিন্যাসে এখানেই আহমেদ দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। দেলজুয়ার প্রাচ্যের প্রতিনিধি, আর পেনরোজ প্রাচ্য-প্রতীচ্যের মানবসৃষ্ট মিলনের বার্তাবাহক। মিলন তো হতেই পারে। কিন্তু মিলনের মধ্যে ও যে একটি সূক্ষ্ম ‘কিন্তু’র বিভাজন, তাকে অস্বীকার করবে কে? কাজেই মিলনের মধ্যেও এই দূরত্বটাই আসল সত্য। সেই রূঢ বাস্তবতাকে চিহ্নিত করেই লেখক মানবিক সম্পর্কের ট্র্যাজিক স্বরূপ সুপ্রতিষ্ঠিত করেছেন।

আমাদের মুক্তিযুদ্ধের যুদ্ধশিশুদের কথা বলতে গিয়ে লেখক ইউরোপেও অনুরূপ যুদ্ধশিশুর বিষয়টি নিয়ে এসেছেন। দখলকৃত জার্মানিতেও বর্বর রুশ সৈনিকরা জন্ম দিয়েছিল অনুরূপ যুদ্ধশিশুর। কাজেই বিষয়টি দেশকালপাত্র ভেদে একটি বৈশ্বিক মাত্রা পায়। এখানে লেখকের কৃতিত্ব এই যে, তিনি এমন একটি নৈতিক ও মানবিক তর্ক উত্থাপন করেছেন, যা যুগ যুগ ধরে অমীমাংসিত। অথচ এর মীমাংসা অত্যাবশ্যক। ন্যায়ের প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি অন্যায়ের শাস্তিবিধানই কাম্য।

বত্রিশ পরিচ্ছেদে বিবৃত এই ছোট উপন্যাসটি বয়ানের ক্ষেত্রে সবচেয়ে আকর্ষণীয় অংশ ছেলের কাছে মায়ের পত্র। ‘বাবা পেনরোজ, জানি, যদি এ চিঠি কোনোদিন তোমার হাতে পৌঁছে তাহলে তুমি খুবই আশ্চর্য হয়ে যাবে। আর এমন চিঠি বিশ্বে ক’টা লেখা হয়েছে জানি না। হয়তো খুব কম বা একটিও নয়।’

পত্রটি অবশ্যই উপসংহারমূলক। আর বিরহিনী জননীর চিত্তোৎসারিত এই পত্রে দুটি বিষয় কাব্যালঙ্কারের মতো প্রাসঙ্গিক হয়ে দেখা দিয়েছে। ছেলের লেখা চিরকুট আর মায়ের হাতে বোনা সোয়েটার। এ দুটির প্রসঙ্গ টেনে শেষ হয়েছে কাহিনী। দুটিই বস্তুবিশেষ। প্রথমটি কাগজ, দ্বিতীয়টি মায়ের হাতে বোনা একখণ্ড কাপড় মাত্র। বাহ্যত দুটিই নিষ্প্রাণ। কিন্তু এই দুই নিষ্প্রাণ বস্তুপ্রতীকের মধ্যে মা ও ছেলে আবিষ্কার করেছে এক সপ্রাণ বন্ধন। এ তো উপমা নয়, এক জীবন্ত উৎপ্রেক্ষা। এতে আছে কবিতার রহস্যময়তা, আর আছে সাহজিকতার অনাবিলতা। এখানেই আছে এই কাহিনীর ট্র্যাজি-কমেডির দ্বৈততা।

বর্ণনার সারল্য, মাধুর্য ও ভানহীনতার কারণে উপন্যাসটি আগাগোড়া সুখপাঠ্য। সবচেয়ে বড় কথা, এটি মানুষের নিষ্ঠুরতা ও নির্মমতার বিরুদ্ধে মানবিক নির্ভরতা, মমতা ও জয়যাত্রার এক অবিসংবাদী দলিল। বাংলা ভাষায় মুক্তিযুদ্ধের ওপর রচিত তাবৎ কাহিনী-বয়ানের মধ্যেও এটি একটি ব্যতিক্রমী সৃষ্টি। বলা যেতে পারে, মাসুদ আহমেদের কথাসাহিত্য আমাদের সৃষ্টিশীলতার জগতে একটি তাৎপর্যপূর্ণ সংযোজন।

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম