Logo
Logo
×

সাহিত্য সাময়িকী

তিন দৈত্যের গল্প

Icon

খন্দকার রেজাউল করিম

প্রকাশ: ২০ অক্টোবর ২০২২, ০৬:০০ পিএম

প্রিন্ট সংস্করণ

কত-না পুরানো কথা, কত-না হারানো গান,

শরমের আধো হাসি, সোহাগের আধো বাণী,

সন্ধ্যা, তোর ওই অন্ধকারে, হারায়ে গিয়েছে একেবারে। -রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

‘তোমার কাছে চিমেরা দৈত্যের গল্প শুনেছি যে তাপগতিবিদ্যার প্রথম সূত্রকে বরবাদ করে দিতে উঠেপড়ে লেগেছিল। গ্রিক রূপকথায় চিমেরা একজন অঘটনঘটনপটীয়সী মহিলা দৈত্য। শিল্পী লিওনার্ডো ডা ভিনসি এমন দৈত্যের ছবি এঁকে সময় নষ্ট না করার পরামর্শ দিয়েছিলেন। পদার্থবিদ্যায় আরও দুইজন দৈত্যের সন্ধান পাওয়া যায়: ল্যাপলাসের দৈত্য এবং ম্যাক্সওয়েলের দৈত্য। ল্যাপলাসের দৈত্য ভবিষ্যতের সব খবর বলে দিতে পারে; ম্যাক্সওয়েলের দৈত্য তাপগতিবিদ্যার দ্বিতীয় সূত্রকে টেক্কা দিয়ে বিনা পরিশ্রমে শীতকালে একটি ঠান্ডা ঘরকে গরম করে দিতে পারে! কিন্তু পদার্থবিদ্যার আইন অমান্য করা সহজ নয়। একজন নারী দৈত্য যা পারেনি, পুরুষ দৈত্যরা কি তা পারবে?’ আমি আইনস্টাইনকে জিজ্ঞাসা করলাম।

‘তোমার নারীভক্তির প্রশংসা করতে হয়। পুরুষদের গায়ের জোর বেশি, নারীরা ষোল কলায় পারদর্শিনী। কখন কোন কলা দেখিয়ে পদার্থবিদ্যার আইনকে কুপোকাৎ করবে কে জানে! মাস্তানি করে, গায়ের জোর দেখিয়ে পদার্থবিদ্যার আইনকে পরাস্ত করা সম্ভব নয়। তাই চিমেরা যখন হার মেনেছে, পুরুষ দৈত্যের ভাগ্যে কী ঘটবে তা নিশ্চয় অনুমান করতে পারছো।’

‘হ্যা, তবুও জানতে ইচ্ছা করে। পরাজয় নিশ্চিত জেনেও মহাবীর কর্ন যেমন যুদ্ধ করে গিয়েছিলেন। হার-জিৎ যাই হোক না কেন, বীরের গল্প শুনতে আমরা সবাই ভালোবাসি।’

‘ল্যাপলাস এবং ম্যাক্সওয়েল ছিলেন দুই নামজাদা পদার্থবিজ্ঞানী এবং অঙ্কবিদ। এসব কাল্পনিক দৈত্যের গল্প এদের কাছেই প্রথম শোনা। তুমি কী প্রতিদিন হরোস্কোপের পাতায় চোখ রাখো? ল্যাপলাসের দৈত্য শুধু তোমার নয়, আর সব প্রাণীর, এমনকি সমগ্র মহাবিশ্বের ভূত-ভবিষ্যৎ জেনে বসে আছে!

ল্যাপলাস ১৭৪৯ সালে জন্মগ্রহণ করেছিলেন, ১৮২৭ সালে মারা যান। সে আমলে পরমাণুকে মৌলিক কণা ধরা হতো, তবে পরমাণু কি দিয়ে তৈরি তা কারও জানা ছিল না। ল্যাপলাস মনে করতেন যে, মহাবিশ্বের সব পরমাণুর অবস্থান এবং গতিবেগ যদি এ মুহূর্তে জানা থাকে, তবে পদার্থবিদ্যার নিয়মকে অনুসরণ করে মহাবিশ্বের অতীত এবং ভবিষ্যৎ নির্ভুলভাবে বলে দেওয়া সম্ভব। তুমি মহাবিশ্বের একটি অংশ, তাই তোমার জন্ম, মৃত্যু সবই অঙ্ক কষে বলে দেওয়া যাবে। মহাবিশ্ব এবং সেই সঙ্গে আমাদের ভবিষ্যৎ পূর্বনির্ধারিত। এমন অঙ্ক দ্রুত করার জন্য চাই একটি অতিমানবীয় বুদ্ধিমান (Super Mind) সত্তা। ওকে ল্যাপলাসের দৈত্য (Laplace’s Demon) বলে ডাকা হয়। ল্যাপলাসের দৈত্যকে ইদানীং একটি সুপার কম্পিউটার হিসাবে ভাবা যেতে পারে! এমন একটি কম্পিউটার যার ইনপুট হবে এ মুহূর্তে মহাবিশ্বের প্রতিটি পরমাণুর অবস্থান, গতি, কোয়ান্টাম দশা এবং পদার্থবিদ্যার আইনগুলো। এ ইনপুট থেকে অঙ্ক কষে কম্পিউটারটি মুহূর্তে জানিয়ে দেবে এ মহাবিশ্বের এবং আমাদের জন্ম, মৃত্যু, অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ। ল্যাপলাসের এ পরিপূর্ণ নিখাঁত জ্ঞানের তত্ত্ব বেশিদিন টেকেনি। তাপগতিবিদ্যার দ্বিতীয় সূত্র, হাইসেনবার্গের কোয়ান্টাম অনিশ্চয়তা তত্ত্ব এবং এত সব খবর মনে রাখার মতো এবং দ্রুত গণনার মতো কম্পিউটারের অবাস্তবতা, ল্যাপলাসের দৈত্যের মৃত্যু ঘটিয়েছে।’

‘এবারে ম্যাক্সওয়েলের দৈত্যের গল্প বলো।’

‘ম্যাক্সওয়েলের দৈত্যের গল্প অলস লোকদের খুব পছন্দ হবে। এ দৈত্য শীতকালে বিনে পয়সায় বা কোনো খাটুনি না করেই তোমার ঠান্ডা ঘর গরম করে দেবে, পেট্রল ছাড়াই গাড়ি চালাবে!

ম্যাক্সওয়েলের দৈত্য তাপগতিবিদ্যার দ্বিতীয় সূত্র নিয়ে। তাপ এক ধরনে শক্তি, গতি আরেক ধরনের শক্তি, এ দুই মিলিয়ে হলো তাপগতিবিদ্যা। বিজ্ঞানীরা তাপ বদলিয়ে বানাতে চায় গতি, আলো, কাজ, আরওকত কী! তাপগতিবিদ্যার সূত্রগুলো এ রূপান্তরের খেলার আইন কানুন। তাপগতিবিদ্যার প্রথম সূত্র এবং চিমেরা দৈত্যের কথা আমরা আগেই বলেছি। আমরা প্রতিদিন হাটেবাজারে কেনাকাটা করি, টাকা বদলিয়ে কিনি চাল, ডাল, মাছ, শাড়ি, লুঙ্গি। বাজার না করেও কয়েকদিন বেঁচে থাকা যায়, কিন্তু শক্তি লেনদেন না করে কয়েক সেকেন্ডের বেশি বেঁচে থাকা সম্ভব নয়। আমাদের প্রতিটি নিশ্বাস, হৃৎপিণ্ডের স্পন্দন, ফুসফুসের ওঠানামা, পাকস্থলীর সংকোচন, এ শক্তি বদলের খেলা। পদার্থবিদ্যায় এ শক্তি রূপান্তরের খেলাকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়: ফিরে যাওয়া যাবে (reversible), এবং ফিরে যাওয়া যাবে না (irreversible) প্রক্রিয়া। প্রথমটি একটি আদর্শ প্রক্রিয়া যা শুধুই পাঠ্যপুস্তকে খুঁজে পাওয়া যায়, প্রকৃতিতে নয়। তাপগতিবিদ্যার দ্বিতীয় সূত্র অনুসারে সময়ের তীর ছোটে শৃঙ্খলতা থেকে বিশৃঙ্খলতার দিকে। একটি কাচের পাত্র ভেঙে গেলে নিজ থেকে আর জোড়া লাগে না, এক গ্লাস পানিতে এক ফোটা কালো রং মেশালে ও আর কোনোদিন কালো ফোটা হয়ে ফিরে আসবে না। পনেরো বছর আগে আমার কোনো এক বিকালের সুখ-দুঃখ, ভালোবাসা, হৃৎপিণ্ডের গতি, রক্তের চাপ দৈত্য বলে দিতে পারবে কি? পারবে না, কারণ আমাদের জীবন একটি অপরিবর্তনীয় না ফেরা প্রক্রিয়া।

ধরা যাক মাঘ মাসের এক বিকালে ম্যাক্সওয়েলের দৈত্য ঘরের জানালার পাশে বসে আছে। ঘর গরম করার কোনো আয়োজন নেই, জানালার এপারে-ওপারে একই তাপমাত্রা। ঘরের ভেতরে এবং বাইরে বায়ুর অণুগুলো ছোটাছুটি করছে। তবে সবাই সমান বেগে নয়। কেউ ছুটছে মোটরগাড়ির বেগে, কেউ চলেছে গরুর গাড়ির বেগে, কেউ বা ছুটছে জেট প্লেনের চেয়েও জোরে। এ অণুগুলোর গড় গতিশক্তির রূপককেই তাপমাত্রা বলা হয়, অণুগুলো যত বেশি বেগে ছুটবে, তাপমাত্রা ততই বাড়বে। ‘ঠান্ডা ঘরটিকে বিনে পয়সায় গরম করে দেওয়া যাক, ম্যাক্সওয়েলের দৈত্য ভাবলো, আমি যদি বাইরের জেট প্লেনের বেগে ছুটে চলা অণুগুলোকে জানালা খুলে ভেতরে আসতে দিই, আর ঘরের ভেতরের গরুগাড়ির বেগে চলা অণুগুলোকে বাইরে যেতে দিই, তাহলেই তো ঘরটি গরম হয়ে যাবে! এখানে দৈত্য তাপগতিবিদ্যার দ্বিতীয় সূত্রকে অমান্য করে সময়ের তীরকে উলটো দিকে ছুড়তে চাচ্ছে, বিশৃঙ্খলতা থেকে শৃঙ্খলতার দিকে! ও পারবে কি? দৈত্যের বদলে একটি ছাকুনি (filter) বা কম্পিউটার ব্যবহার করলে কেমন হয়? অনেক গুণী এসব নিয়ে অনেক ভেবেছেন। সবাই একমত যে দৈত্য, ছাকুনি, কম্পিউটার যাকেই অণু বাছাই করার কাজে লাগানো হবে, তার পেছনে শক্তি খরচ করতে হবে, ফোকটে কিছুই মিলবে না। এত সব অণুর খবর রাখতে গিয়ে কম্পিউটার বা দৈত্যের শরীরে বিশৃঙ্খলতার সৃষ্টি হবে, তাকেও হিসাবের মধ্যে ধরতে হবে। তাপগতিবিদ্যার দ্বিতীয় সূত্রকে অমান্য করার মতো কোনো দৈত্যের খোঁজ এখনো মেলেনি।’

‘আমার আরও কিছু প্রশ্ন আছে। একটি কাচের পেয়ালা টেবিল থেকে মেঝেতে পড়ে ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যায়। এ টুকরোগুলো নিজ থেকে আর জোড়া লাগে না। পেয়ালাটি নিজে থেকে লাফ দিয়ে আবার টেবিলের ওপরে ওঠে না। কেন? বাধাটা কিসের? বাতাসের অণুগুলো সব সময় ছুটছে, ওদের মাঝে অনেক শক্তি লুকিয়ে আছে। সেই শক্তি দিয়ে ওরা কেন ভাঙা পেয়ালা জোড়া দেয় না, কেনই বা পেয়ালাটিকে ধাক্কা দিয়ে টেবিলের ওপরে উঠিয়ে দেয় না?’

‘তুমি যে পক্রিয়ার কথা বলছো তা সবই তাপগতিবিদ্যার দ্বিতীয় সূত্রকে অমান্য করে। আমি আগেই বলেছিলাম যে, সাগরের পানিতে অনেক শক্তি আছে, কিন্তু এক সাগর পানি দিয়ে একটি গাড়িকে চালানো সম্ভব নয়। শুধু এনার্জি থাকলেই কাজ করা যায় না। সাগরের একদিকের পানি যদি গরম হয় এবং অন্যদিকের পানি ঠান্ডা, তাহলে তাপ এনার্জি গরম থেকে ঠান্ডা দিকে প্রবাহিত হবে এবং এই এনার্জির স্রোত থেকে কাজ আদায় করে নেওয়া যাবে। গাড়ির ইঞ্জিনের সিলিন্ডারের উত্তপ্ত বাতাস এবং বাইরের বাতাসের তাপমাত্রার পার্থক্যের কারণেই গাড়িকে চালানো সম্ভব হয়। কিন্তু সবটুকু এনার্জি গাড়ির গতি এনার্জিতে পরিণত করা সম্ভব নয়। তাপগতিবিদ্যার দ্বিতীয় সূত্র মতে, কিছু এনার্জি নষ্ট হবেই। গাড়ির পেছনের নল দিয়ে নষ্ট এনার্জি ধোঁয়া হয়ে বের হয়ে যায়।’

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম