|
ফলো করুন |
|
|---|---|
গভীর রাতে দরজায় কার যেন কড়া নাড়ার শব্দ শুনছিলাম। কিন্তু ডোরবেলের মিষ্টি শব্দের বদলে কে এমন কড়া নাড়ছিল, আর কেন তা বুঝতে দরজা খুলে দেখি একজন বৃদ্ধা। দুই হাত ভর্তি তার শিউলি ফুলে। জ্যোৎস্নায় তার মুখ যেন ঝলমল করছিল। চোখগুলো ছিল মুগ্ধতার আবেশে পূর্ণ। উজাড় করে সে শিউলি ফুল ঢেলে দিল আমার আঁজলায়। হাত উপচে কিছু ফুল গড়িয়ে পড়ল মেঝেতে। আমি তখনো বিস্ময়ভরা চোখে তাকিয়েছিলাম বৃদ্ধার দিকে। আর আমার পুরো ঘরজুড়ে তখন মিষ্টি একটা গন্ধ ছড়িয়ে গেল। আমি বিভোর হয়ে রইলাম সেই ব্যাকুল করা সুগন্ধে। কিন্তু শিউলি ভালোবাসি সে কথা বৃদ্ধা জানল কী করে? সেই কবেকার কথা! ছোটবেলার শিউলি কুড়ানো দিন! ঠিক এ সময়টাতেই শিউলি কুড়িয়ে ঘরে ফিরতাম! শিউলির গন্ধে বিভোর হওয়ার আশায় ঘর থেকে বেরোনোর জন্য কত কত ছল করতাম!
আনমনে পুরোনো দিনের কথা ভাবতে ভাবতে হঠাৎ দেখি সেই বৃদ্ধা কোথায় যেন হারিয়ে গেল! দরজার এপাশ-ওপাশে খুঁজি, খুঁজতেই থাকি! নেই, কোথাও নেই! তাকে কোথাও খুঁজে পাই না! ঘুম ভেঙে যায়। বুঝতে পারি-স্বপ্ন দেখেছিলাম। ধীরে ধীরে অস্থিরতা কমে আসে।
বিছানা ছেড়ে এসে জানালার কাছে দাঁড়াই। আকাশে শেষ রাতের মায়াবী চাঁদ। শীতল বাতাস শরীরে ভালোলাগার পরশ বুলিয়ে যায়। স্ট্রিটলাইটগুলোর হলদে আলো যেন এই গভীর রাতে, উড়ে যাওয়া কোনো পাখির ছায়ার মতো তার কথা মনে করিয়ে দেয়। যে শুধু অধরাই রয়ে গেল।
রাত ফুরোতে এখনো অনেক দেরি। বিছানার পাশে টেবিলে রাখা সিগারেটের প্যাকেট থেকে একটা সিগারেট নিয়ে শেষ করলাম। একা একা ঘরের ভেতর পায়চারী করে করে আর বিছানায় আধশোয়া থেকে রাতটা খুব অস্বস্তির সঙ্গে কেটে গেল। সকালে উঠে প্রতিদিনের মতো অফিসে যাই।
অফিস শেষে বাসায় ফিরব, তাই বাসের জন্য দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিলাম। তখন চারদিকে গাঢ় হয়ে সন্ধ্যা নামছে। শিরীষ গাছের নিচে যাত্রীদের ভিড়। শহর চষে বেড়ানো বাসগুলো ব্যস্ততা নিয়ে ছুটে চলেছে। কখনো থামছে ফের ছুটে চলেছে। পথের ধুলোয় মাখামাখি ফুটপাত, ফুটপাত ঘেঁষে বসা বইয়ের দোকান। পথ মুখরিত পথচারীর চলাচলে।
হঠাৎ মনে হলো কে যেন জোরে শব্দ করে নাম ধরে ডাকছে। ‘নিলুদা, নিলুদা...।’ চেনা স্বর। খুব চেনা মনে হচ্ছে। পেছন ফিরে তাকাতেই দেখি, মাধবী। আমি থমকে দাঁড়াই। চোখ দুটি স্থির হয়ে যায়।
মাধু ভিড়ের মধ্যে দ্রুত পায়ে আমার দিকে ছুটে এলো। পরনে চওড়া গোলাপি পাড়ের সবুজ শাড়ি। লম্বা চুলগুলো পিঠের ওপর ছড়িয়ে রয়েছে। চোখে মোটা করে কাজল দেওয়া। কানে গোলাপি পাথরের ছোট্ট টব। গলায় ম্যাচিং লকেট। আর হাতে রয়েছে শিউলি ফুলের মালা। কী করে সম্ভব? আমি মাধুর হাতের সেই শিউলি ফুল থেকে চোখ সরাতে পারি না। এটা কি স্বপ্ন, নাকি বাস্তব? তবে কি মাধু আসবে বলেই গত রাতে কেউ এসে তার খবর জানিয়ে গেছে চুপিসারে, স্বপনে? সে যাই হোক, মাধুকে দেখে মনে হলো, ভালোই আছে। নতুন জীবন, নতুন সংসার। হয়তো জীবনসঙ্গীও পেয়েছে ওর মনের মতোই।
‘তোমার সময় হবে কিছুক্ষণ! কত দিন পর আবার দেখা হলো...!’ আমার দিকে তাকিয়ে খানিকটা অনুরোধের স্বরেই যেন বলল মাধু । হয়তো সে কথায় কিছুটা ভাবাবেগও মেশানো ছিল। কী জানি...!
হঠাৎ ওর এমন অনুরোধে একটু অবাক হলাম। বললাম,
‘সময় আমার থেমেই রয়, ‘আজীবন তাই ছিল। তোমার সময়ই ছুটে চলে, বয়ে যায়।’
‘কী বলছ, আবোল তাবোল? চল, সামনে এগোই।’
আমরা দুজন ফুটপাত ধরে হাঁটি। কত কথা জমে আছে মনের কোণে। কত কিছু জানতে ইচ্ছা করে। কোথা থেকে শুরু করি বুঝতে পারি না। হাঁটতে হাঁটতে মূল রাস্তা থেকে একটু ভেতরের দিকে যেতেই একটা পার্ক চোখে পড়ে।
পার্কে লেকের ধারের বেঞ্চিতে বসি দুজন।
‘তারপর... কেমন চলছে তোমার অফিস? ক্যারিয়ার? তুমি তো খুব অ্যামভিসিয়াস ছিলে।’ মনে হলো, মুখে কিছুটা তাচ্ছিল্যের হাসি নিয়ে চোখ দুটো কপালে তুলে জানতে চাইল মাধু।
‘চলে যাচ্ছে।’ খুব অল্প কথায় উত্তর দিলাম।
‘কলেজ পেরোনোর পরের সময়গুলোতে ঘুমকে না বলে সারা রাত মোবাইল ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থাকতাম। তোমার ফোনের অপেক্ষায়। ভীষণ নিয়ম মেনে চলা মানুষ তুমি। যদি তোমার পড়াশোনার ক্ষতি হয়! যদি আমার কারণে তোমার ঘুম নষ্ট হয়! তাই অপেক্ষা করে যেতাম। সাহস হতো না ফোন করার। কথা বলতে গেলেই তোতলাতাম।’ বলেই হাসল মাধু। হাসি শেষে একটু থেমে পার্কের বেঞ্চিতে পড়ে থাকা কিছু ঝরা পাতা হাত দিয়ে সরাতে সরাতে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘তোমার মনে আছে নীলুদা,’ এটুকু বলেই আমার চোখ থেকে তার চোখ দুটো সরিয়ে নিল। ‘কিছুটা লজ্জা আর সাহস নিয়ে একবার তোমাকে বলেই ফেলেছিলাম, আচ্ছা নীলুদা, তোমার জন্য কেন এমন লাগে আমার? তোমাকে না দেখতে পেলেই কী রকম যেন অনুভূতি হয়! ভালো লাগে না। কথাগুলো শুনেই সেদিন তুমি বলেছিলে, আমি অনেক ইমোশনাল। মনে পড়ে?’
আচমকা ওর এসব কথায় পুরোনো দিনগুলো চোখের সামনে ভেসে উঠল। অতীত দিনের স্মৃতিতে মনটা কেমন বিষণ্ন হয়ে পড়ল। দেখলাম, মাধু তার কপালের সামনে চলে আসা অবাধ্য চুলগুলোকে হাতের আঙুলগুলো দিয়ে ঠিক করে নিচ্ছে। ওর দিকে তাকিয়ে নিজেকে আজ দোষারোপ করা ছাড়া আর কিইবা করার আছে। মধ্যবিত্তের সংসার। বড় ভাই ছিল পাগল। উসকু খুসকু চুল, পুরোনো জামায় অনেক তালি দেওয়া, বড় বড় নখ আর শরীরভর্তি ধুলো-ময়লা নিয়ে সারা দিন এখানে সেখানে ঘুরে বেড়াত। অকারণে মানুষকে নানাভাবে বিরক্ত করত। কখনো মসজিদের হুজুরকে সাইকেল দিয়ে যাতায়াতের সময় রাস্তার পাশের পুকুরে সাইকেলসহ ফেলে দিত। কখনো বা কারও দোকানের খাবার না বলে নিয়ে দৌড় দিত। সময়মতো ঘরে ফিরত না। তখন বাবা-মা আর আমার দুশ্চিন্তার শেষ ছিল না। এ নিয়ে কেউ কিছু বললে তখন হাতের কাছে দা-বঁটি যা পেত তাই নিয়ে তেড়ে আসত। সংসারের এ অবস্থায় মাধুকে আগলে নিজের করে রাখার যোগ্যতা বা সাহস আমার ছিল না। সে সময়গুলোতে শুধু ভাবনা ছিল একটাই। পড়াশোনা শেষ করে ভালো কিছু করতে হবে। বাবার কিছু হয়ে গেলে সংসারের হালটা তো আমাকেই ধরতে হবে। তবুও এত কিছুর মধ্যেও মাধু ছিল আমার স্বর্বস্বজুড়ে। বোঝেনি সে। বোঝাতে পারিনি তাকে।
‘কী ভাবছ নীলুদা? এ্যাই নীলু দা!’ হাতে তুড়ি মেরে জানতে চাইল মাধু। তুড়ির সেই শব্দে আমার ভাবনায় ভাঙন ধরে। ওকে কিছু বুঝতে না দিয়ে একটু মৃদু হেসে মাথাটা নেড়ে বললাম, ‘নাথিং ।’
হঠাৎ প্রসঙ্গ পালটে মাধু ফস করে বলে উঠল,
‘আচ্ছা তুমি তো আগে কবিতা লিখতে, এখনো লেখ?’
‘কিছু নিজের করে রাখতে হলে যত্ন করতে হয়, ভালোবেসে আগলে রাখতে জানতে হয়। আমি কি কখনো তাই পেরেছি, বল?’
একটু চুপ থেকে একটা ছোট্ট দীর্ঘশ্বাস ফেলে আমার দিকে তাকিয়ে বলল মাধু,
‘বিয়ে করেছ নিশ্চয়ই! সে বুঝি খুব সুন্দর? তোমার জন্য রোজ দুচোখে কাজল পরে, তাই না! তুমি তো কাজল চোখের মায়ায় হারিয়ে যেতে। আজও হারাও?’
মাধুর কথাগুলো নিজেকে কেমন এলোমেলো করে দেয়। কিন্তু ঠোঁটে কোনো কথা নেই। কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলাম লেকের স্বচ্ছ জলের দিকে। সেই জলে আলতো করে ছুঁয়ে যাওয়া কদমগুচ্ছের দিকে। বিকালের ছায়াময় আলোয় বসে ভাবি-কত সহজ প্রশ্ন অথচ তার কোনো উত্তরই দিতে পারছি না। এত ভিড়ের মধ্যেও নিজেকে বড্ড একা লাগে। আবার মনে হয়, অনাবশ্যক এসব প্রশ্নের কী প্রয়োজন? তা ছাড়া আর কী হবে বিবর্ণ অতীতের দিকে ফিরে তাকিয়ে? ছেড়ে যখন চলেই গেছ এখন আর ভালো লাগা, মন্দ লাগা জেনে কী হবে? যদি জীবনান›দের মতো করে বলি- তবে বলা যায়, কে হায় হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালোবাসে?’ হঠাৎই মেঘের গুড় গুড় আওয়াজ শোনা যায়। তাকিয়ে দেখি আকাশজুড়ে ঘন মেঘ। স্ট্্িরট লাইটগুলো জ্বলে উঠেছে। পার্কের বেঞ্চি থেকে উঠে রাস্তা ধরে হাঁটছি দুজনই। খুব কাছাকাছি। কিছুদূর এগোতেই একটি গাড়ি এসে থামল আমাদের পাশে।
গাড়িটি দেখেই থমকে দাঁড়াল মাধু। বলল,
‘আমাকে যেতে হবে এখনি। আকাশে মেঘ জমেছে। তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে যাও নীলু দা। আর পারলে তোমার কবিতাদের ফিরিয়ে নিয়ে এসো।’
কী বলব তখন বুঝতে পারছিলাম না। মাধুর দিকে নির্বাক তাকিয়ে ভাবি, থাকুক না মাধু আরও কিছুক্ষণ, আমার কাছে। যেমন করে রাতের বুকে লুকিয়ে থাকে শিশিরে ভেজা সকালটুকু।
মাধু গাড়ির গ্লাসটা নামিয়ে ফ্যালফ্যাল করে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল,
‘ভালো লাগাগুলোকে ভালোবেস নীলু দা।’
ওর কথায় বুকের ভেতরটায় জলোচ্ছ্বাসের মতো শব্দ হলো। আবার বিদায় বেলায় সেই চেনা নাম, চেনা ডাক, চিরকালের চিরচেনা আহবান। ‘তোমার ভালো লাগাগুলোকে ভালোবেস নীলু দা...।’
গভীর রাতে সেই যে এসেছিল এক বৃদ্ধা। আজকের দিনের সব আগাম বার্তা দিয়ে চলে গেছে কাল রাতে। নিজেকে মনে হলো-যেন কোনো এক তরী, যা তীরের কাছাকাছি পৌঁছে গেছে, যার সামনে আর কোনো পথ নেই। কেবলই ধু-ধু প্রান্তর।
মাধবীর গাড়ি চলতে শুরু করেছে। চারদিক থেকে ঘিরে ঘিরে আসে মেঘ। আলো ধীরে ধীরে কমে আসছে। এ সময় ঝুম ধরে বৃষ্টি নামে। অঝোর ধারায় বৃষ্টি। দূরে দাঁড়িয়ে মাধুর চলে যাওয়া দেখি। যতদূর দুচোখ যায়। বৃষ্টির শব্দ যেন আর শুনতে পাচ্ছি না। পৃথিবীর সব শব্দরা যেন থেমে গেছে। শুধু একটি কথাই বারবার প্রতিধ্বনিত হতে লাগল। ‘তোমার ভালোলাগাগুলোকে ভালোবেস নীলু দা।’
মুহূর্তেই মুখরিত এ নগরকে মনে হলো, যেন এটি কোলাহলমুখর কোনো নগর নয়। নিতান্তই নিস্তব্ধ এক রাতের শহর। যেন এক স্বপ্নদ্বীপ। আমার যেন সহসা পা নড়ে না। এক সময় মনে হলো- আমিও রাতের অমাবস্যায় ক্রমশ ডুবে যাচ্ছি...।
