Logo
Logo
×

সাহিত্য সাময়িকী

গল্প

জনৈক ভিক্ষুক

Icon

ইকবাল খন্দকার

প্রকাশ: ৩১ মার্চ ২০২৩, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

ব্যাপারটা অদ্ভুত। এমনিতে ভিক্ষুকের জ্বালাতনে অতিষ্ঠ হয়ে যেতে হয়। অথচ প্রয়োজনের সময় একজনও পাওয়া যায় না। অদ্ভুত এ ব্যাপারটা বেশ ক’বছর ধরেই খেয়াল করে আসছে শান্তা। আর বিরক্ত হচ্ছে। কিছুদিন আগে বিরক্তি যখন চরমে পৌঁছে গেল, তখন তো সিদ্ধান্তই নিয়ে ফেলেছিল, দান করার জন্য আর কোনোদিন ভিক্ষুক খুঁজবে না; কিন্তু সিদ্ধান্ত নেওয়ার দিন-তিনেকের মধ্যেই যখন ভয়াবহ একটা দুঃস্বপ্ন দেখল, তখন আর সিদ্ধান্তে অটল থাকতে পারেনি।

শান্তার দৃঢ় বিশ্বাস-দুঃস্বপ্ন মানে বিপদের আলামত। হতে পারে তা নিজের জন্য কিংবা পরিবারের যে কোনো সদস্যের জন্য। আর এ বিপদ দূর হয় দান-খয়রাতের বদৌলতে। আজ আবার সেই অদ্ভুত ব্যাপারটার মুখোমুখি হয়েছে শান্তা। সকাল থেকে ভিক্ষুক খুঁজছে, কিন্তু পাচ্ছে না। অথচ দান করাটা জরুরি। গতরাতে দুঃস্বপ্ন দেখেছে-এমন কিছু না। সে দান করতে চাচ্ছে মূলত ছেলের জন্য। যেন তার পরীক্ষা ভালো হয়। আজ থেকে বার্ষিক পরীক্ষা শুরু হয়েছে কিনা!

ছেলেকে নিয়ে গাড়িতে ওঠার আগে প্রায় পাঁচ মিনিট বাড়ির গেটে দাঁড়িয়ে ছিল শান্তা। দারোয়ান তখন বারবার জিজ্ঞেস করেছিল কোনো সমস্যা কিনা, কিছু লাগবে কিনা। শান্তা শান্ত গলায় জানিয়েছিল, সে ভিক্ষুক খুঁজছে। খোঁজাখুঁজি এখনো চলছে। অথচ ইতোমধ্যে তানিম ঢুকে গেছে পরীক্ষার হলে। আর শান্তা রওয়ানা হয়েছে বাসার উদ্দেশে। ড্রাইভারকে অবশ্য বলে রেখেছে, ভিক্ষুক দেখলেই যেন থেমে যায়।

ড্রাইভার থামে। তবে ভিক্ষুক দেখে থামে না। থামে জ্যামের কারণে। তারপর হাতের বামের রাস্তায় প্রবেশের অনুমতি চায় শান্তার কাছে। কারণ হিসাবে বলে দুই সুবিধার কথা। প্রথম সুবিধা-জ্যাম এড়ানো যাবে। দ্বিতীয় সুবিধা-একজন ভিক্ষুক পাওয়া যাবে নিশ্চিত। শান্তা প্রথম সুবিধার কথায় প্রভাবিত না হলেও দ্বিতীয় সুবিধার কথায় প্রভাবিত হয় ভীষণভাবে। তাই অনুমতি দিয়ে দেয় বামে যাওয়ার।

ড্রাইভার ধীরগতিতে গাড়ি চালাতে চালাতে বলে-আসলে হইছে কী ম্যাডাম, ওইদিন আমি একজনের সঙ্গে দেখা করার জন্য এ রাস্তার মাথায় যে ইশকুলটা আছে, ওই ইশকুলের পেছনের মোড়ে গেছিলাম। তখন দেখলাম ওই মোড়ের কাছে যে দেবদারু গাছটা, ওইটার তলায় একটা ফকির বইসা ভিক্ষা করতাছে। মানুষটার পা একটাও নাই। দুইটাই হাঁটুর ওপর থেকে কাটা। একজনে তখন কথায় কথায় বলল, এইটা নাকি এ লোকের পার্মানেন্ট জায়গা।

দেবদারুতলায় এসে গাড়ি থামায় ড্রাইভার। আর ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায় শান্তার দিকে। তার মুখে সাফল্যের হাসি। প্রয়োজনের সময় ভিক্ষুক খুঁজে পেয়েছে-চাট্টিখানি কথা? তবে তার এ হাসি দেখতে পায় না শান্তা। কারণ, সে গাড়ির খোলা গ্লাস দিয়ে তাকিয়ে আছে বাইরে। কোনদিকে তাকিয়ে আছে? ভিক্ষুকের দিকে কি? হ্যাঁ, ভিক্ষুকের দিকেই তো। কিন্তু এভাবে তাকিয়ে আছে কেন? কী দেখছে? এত খোঁজাখুঁজির পর ভিক্ষুক পাওয়া গেছে, তার চোখে-মুখে তো আনন্দ থাকার কথা। বিস্ময় কেন?

ড্রাইভার ডাক দেয়। শান্তা কিছুটা হকচকিয়ে ওঠে। তবে স্বাভাবিকও হয়ে যায় মুহূর্তেই। ড্রাইভারের দিকে তাকিয়ে হাসে। হাসিটা দুর্বোধ্য। ড্রাইভার তাই হাসতে গিয়েও হাসে না। শুধু অপেক্ষায় থাকে এমন আদেশের- এই নাও, টাকাটা দিয়ে এসো। কিন্তু শান্তা কোনো আদেশ করে না। বরং দরজা খুলে নেমে যায় নিজেই। এ সময় ড্রাইভার নামতে চাইলে সে হাত উঁচু করে। বোঝায়-নামতে হবে না। শান্তা ধীরগতিতে সামনে এগোয়। তারপর দাঁড়ায় ভিক্ষুকটার ঠিক সামনে। তবে ভ্যানিটি ব্যাগে হাতও দেয় না, টাকাও বের করে না।

বেশ কিছুক্ষণ পর ফিরে আসে শান্তা। তার মুখ হাসি হাসি। তবে ড্রাইভার বুঝে ফেলে, হাসিটা কৃত্রিম। গাড়িতে উঠে বসে সে। ড্রাইভার গতি বাড়িয়ে দেয়। তিনদিন পর। অফিস থেকে রিকশায় করে বাসায় ফিরছিল শান্তার স্বামী মাসুদ। হঠাৎ দেখে ড্রাইভার ফুটপাত ধরে হাঁটছে। তার হাতে টিফিন ক্যারিয়ার। মাসুদ রিকশা থামানোর আদেশ দেয়। কথা বলে ড্রাইভারের সঙ্গে। তারপর একপর্যায়ে কথা আর ‘কথা’ থাকে না, হয়ে যায় ‘জেরা’।

ড্রাইভার বলে দিতে বাধ্য হয়, সে খাবার নিয়ে গিয়েছিল দেবদারুতলার ভিক্ষুকের জন্য। পাশাপাশি এ অনুরোধও করে, মাসুদ যেন শান্তাকে কিছু না বলে। যেহেতু তার কাছে সে ওয়াদাবদ্ধ এবং তা লোভনীয় বকশিশের বিনিময়ে। মাসুদ ড্রাইভারের অনুরোধ রাখে। আর পরদিনই ছুটে যায় দেবদারুতলায়। ভিক্ষুককে কাছ থেকে দেখে, দান করে, কথাও বলে। তবে সাধারণ কথা। অর্থাৎ দানকারী আর দানগ্রহীতার মধ্যে সচরাচর যেসব কথা হয়। ভিক্ষুক তাই মাসুদের উদ্দেশ্য বুঝতে পারে না।

রাতে খাবার টেবিলে বসে ছেলের স্কুলের গল্পজুড়ে দেয় শান্তা। মাসুদ বুঝতে পারে, তার আসল উদ্দেশ্য গল্প বলা না। বরং অন্যকিছু বলা। মাসুদ ধৈর্য সহকারে অপেক্ষা করে সেই ‘অন্যকিছ’ু শোনার জন্য। স্কুলের গল্প বলা শেষ হয় শান্তার। এবার সে শুরু করে বাবার বাড়ির গল্প বলা। মাসুদ তবু ধৈর্য হারায় না। বাবার বাড়ির গল্প শেষে শান্তা বলে-আমি খেয়াল করেছি, আমাদের গেটের দুইটা দারোয়ানই ফাঁকিবাজ। গেট খোলা রেখে এদিক-সেদিক চলে যায়। এ সুযোগে যে বিল্ডিংয়ে চোর-ডাকাত ঢুকে পড়তে পারে, এ বিষয়ে তাদের কোনো মাথাব্যথাই নেই। এর একটা বিহিত হওয়া দরকার।

মাসুদ মাথা নাড়ে। বোঝায়, এতক্ষণ যা বলা হয়েছে, সব যৌক্তিক। শান্তা তাই উৎসাহ পায়। আর বলে-আমি অনেক চিন্তা-ভাবনা করে দেখলাম, যারা স্বাভাবিক হাঁটাচলা করতে পারে, তারা দারোয়ানের চাকরির জন্য পুরোপুরি ফিট না। কারণ, সারাদিন এক জায়গায় বসে থাকা বা দাঁড়িয়ে থাকাটা তাদের জন্য কঠিন। তারা সুযোগ পেলে এদিক-সেদিক যাবেই। এজন্য আমি মনে করি, এমন কাউকে দারোয়ান হিসাবে নিয়োগ দেওয়া উচিত, যে ইচ্ছা করলেও যখন-তখন এদিক-সেদিক চলে যেতে পারবে না।

মাসুদ জানতে চায়, পঙ্গু বা এ জাতীয় লোকজনের কথা বলা হচ্ছে কিনা। শান্তা ‘জি’ বললে সে বলে-আইডিয়াটা খারাপ না। তবে প্রবলেমও আছে। প্রবলেমটা হচ্ছে, হঠাৎ করে এ ধরনের লোকজন পাওয়া টাফ। অবশ্য নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেওয়া যেতে পারে। যদি বিল্ডিংয়ের সভাপতির আপত্তি না থাকে। আমি তার সঙ্গে কথা বলে দেখি।

এরপর চালাকি করে মাসুদ। সভাপতির সঙ্গে কথা না বলেই জানায়-বলেছি। আরও জানায়, সভাপতির কোনো আপত্তি নেই। মাসুদ চালাকিটা করে শান্তাকে হাতেনাতে ধরার জন্য। আর এ চালাকির অংশ হিসাবেই সে তাকে বলে-সভাপতি হয়তো কাল-পরশু নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দিয়ে দেবে। তবে আমার মনে হচ্ছে, পছন্দসই লোক পাওয়া যাবে না। কারণ, পঙ্গু বা এ জাতীয় লোকজন ভিক্ষা করতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। পরিশ্রম ছাড়া যদি টাকা আসে, তাহলে দারোয়ানের চাকরির মতো কঠিন একটা কাজ কেন করবে?

শান্তা মাসুদকে চিন্তা করতে মানা করে। মানা করে হতাশ হতে। তারপর কফির কাপ হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলে-যেহেতু প্রস্তাবটা আমি দিয়েছি, অতএব আমার একটা দায়িত্ব অবশ্যই আছে। যদি শেষ পর্যন্ত লোক না-ই পাওয়া যায়, তাহলে আমি আমার দায়িত্বটা পালন করব। কারণ, আমার খোঁজে একজন পঙ্গু লোক আছে। খুবই বিশ্বস্ত। সবার পছন্দ হবে আশা করি। যদি পছন্দ না হয়, তাহলে বাদ। তবে আমি কিন্তু লোকটাকে এখনই আনতে চাচ্ছি না। ওই যে বললাম যদি শেষ পর্যন্ত কাউকে না পাওয়া যায়, তখন দেখা যাবে।

চারদিন পর। আবার চালাকি করে মাসুদ। শান্তাকে জানায় লোক পাওয়া যায়নি। পাওয়া যাওয়ার কোনো সম্ভাবনাও দেখা যাচ্ছে না। শান্তা ‘নো টেনশন’ বলে তাকে দুশ্চিন্তামুক্ত করার চেষ্টা করে। কিন্তু চেষ্টায় তেমন কাজ হচ্ছে না দেখে সে তার হাতে হাত রাখে। আর বলে-আজকের দিনটা কোনোমতে যেতে দাও। দেখবে কালকেই লোক চলে আসবে। তবে এ ফাঁকে বেতনের বিষয়টি নিয়ে তুমি সভাপতির সঙ্গে একটু কথা বলে রাখবে। যাতে পরে আর কোনো ঝামেলা না হয়।

পরদিন ড্রাইভার গিয়ে নিয়ে আসে দেবদারুতলার ভিক্ষুককে। দারোয়ানের রুমেই বসানো হয় তাকে। শান্তা তার জন্য বাটিভর্তি পায়েস পাঠায়। ভিক্ষুক বাটিটা হাতে নিয়ে বসে থাকে। মাসুদ তাগাদা দেওয়া সত্ত্বেও খায় না। কী যেন চিন্তা করে শুধু। অথচ তার মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে, পেটে প্রচণ্ড ক্ষুধা। মাসুদ আবার তাগাদা দেয়। তারপর চলে যায় উপরে, শান্তার কাছে। জিজ্ঞেস করে-একটা সত্য কথা বলবে?

শান্তা যেন সজোরে ধাক্কা খায়। কেঁপে ওঠে সে। বার কয়েক ঢোক গিলে জানতে চায়, কী কথা। মাসুদ হাসে। তাকে নার্ভাস হতে নিষেধ করে। কিন্তু নিষেধাজ্ঞায় কোনো কাজ হয় না। শান্তার ঢোক গেলা তো বাড়েই, বাড়ে ঘামও। মাসুদ কাশি দিয়ে গলা পরিষ্কার করে নিয়ে বলে-আমি জানি ভিক্ষুকটার সঙ্গে তোমার একটা সম্পর্ক আছে। কী সম্পর্ক, জানি না। তাই জানতে চাচ্ছি। আশা করি সত্যটা তো বলবেই, আর সেটা সরাসরি। ঘুরিয়ে-প্যাঁচিয়ে না।

শান্তা ফ্লোরের দিকে তাকিয়ে থাকে। মাসুদ তার পিঠে হাত রেখে অনুরোধ জানায়, সে যেন নীরব না থেকে কথা বলে, সত্যটা প্রকাশ করে। শান্তা মুখ তোলে। তারপর মাসুদের চোখে চোখ স্থির করে বলে-তুমি তো জানোই, বিয়ের ঠিক ছয় মাস আগে আমাকে কিডন্যাপ করা হয়েছিল। আর এটাও জানো, কিডন্যাপটা করিয়েছিল বাবার বিজনেস পার্টনার। তার উদ্দেশ্য ছিল আমাকে খুন করা। এর জন্য সে কিডন্যাপারদের বিরাট একটা অ্যামাউন্টও দিয়েছিল; কিন্তু আমার ভাগ্য ভালো, আমি জীবিত ফিরে আসতে পেরেছিলাম।

মাসুদ শান্তাকে অতীত বাদ দিয়ে বর্তমানে আসতে বলে। আরও বলে, কিডন্যাপের ঘটনা পুরোটাই তার জানা। অতএব জানা ঘটনা নতুন করে শুনে সে সময় নষ্ট করতে চায় না। শান্তা বলে-পুরোটা তোমার জানা, এটা বোধহয় ঠিক বললে না। কারণ, আমি নিজেই পুরোটা জানতাম না। অথচ ঘটনাটা আমার জীবনের। নিজের জীবনের ঘটনা নিজে যদি পুরোটা না জানে, তাহলে অন্যে জানবে কীভাবে? এটা কি সম্ভব? মোটেই না।

: কেন শুধু শুধু কথা প্যাঁচাচ্ছো? দয়া করে আসল ঘটনাটা বল।

: আমি সেদিন শুধু ভাগ্যের জোরে জীবিত ফিরে আসতে পেরেছিলাম, তা কিন্তু না। এই যে ভিক্ষুকটা, সে যদি দয়া না করত, তাহলে হয়তো ভাগ্যও সহায় হতো না।

: মানে?

: কিডন্যাপাররা জঙ্গলের মতো একটা জায়গায় আমাকে রেখে খাবার খেতে গিয়েছিল।

: জানি।

: তখন আমার পাহারার দায়িত্বে ছিল শুধু এ ভিক্ষুকটা।

: জি?

: হ্যাঁ, এ ভিক্ষুকটা। আমি তাকে ‘ভাই’ বলে ডাকি। হাতে-পায়ে ধরি। তার দয়া হয়। সে আমাকে ছেড়ে দেয়।

বিস্ময়ে বাকরুদ্ধ হয়ে যায় মাসুদ। তবে কথা বলে চলে শান্তা-তুমি হয়তো ভাবছো যার পা-ই নেই, তার হাতে-পায়ে ধরলাম কীভাবে? আসলে তখন পা ছিল মানুষটার। আর সে ছিল কিডন্যাপার দলের গুরুত্বপূর্ণ একজন সদস্য। সে কেন পা হারিয়েছে জানো? কীভাবে জানবে! ওই যে বললাম, আমি নিজেই জানতাম না। তানিমের প্রথম পরীক্ষার দিন দান করতে গিয়ে যখন তাকে দেখলাম, চিনে ফেললাম এবং সে-ও আমাকে চিনে ফেলল, তখন প্রথম জানলাম।

বলতে বলতে গলা ধরে আসে শান্তার। সে পানি খায়। তারপর শাড়ির আঁচল দিয়ে ভেজা ঠোঁট মুছে নিয়ে বলে-কিডন্যাপাররা খাবার খেয়ে ফিরে এসে যখন জানতে পারে মানুষটা তাদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে, মানে আমাকে ছেড়ে দিয়েছে, তখন তারা কসাই হয়ে যায়। পার্থক্য এতটুকুই, পেশাদার কসাইরা কাটে গরু-ছাগলের পা, আর ওই কসাইরা কেটেছে মানুষের পা।

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম