Logo
Logo
×

সাহিত্য সাময়িকী

‘কল্লোল’-এর শতবর্ষ ও বাংলাসাহিত্যে আধুনিকতাবাদ

Icon

আতিয়া সুলতানা

প্রকাশ: ১৪ এপ্রিল ২০২৩, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

সময়টা তখন বিংশ শতাব্দীর প্রথমভাগ, বাংলাসাহিত্যে তখন রবীন্দ্রনাথের জয়জয়কার চলছে। একের পর এক অসাধারণ সব কবিতা, উপন্যাস, নাটক আর গল্প দিয়ে রবীন্দ্রনাথ যেন নিজেই নিজেকে ছাড়িয়ে যাচ্ছেন প্রতিনিয়ত। এদিকে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতা কাটিয়ে উঠে তরুণ যুবারাও একটু ক্লান্ত পরিশ্রান্ত, এবার নতুন কিছু চাই। যুদ্ধের আমেজে রক্ত যেমন টগবগ করে ফুটছিল, সাহিত্যেও তেমন টগবগে কিছু চাই। একটু বিদ্রোহ, একটু বিরুদ্ধতা! কিন্তু কোথায় পাওয়া যাবে তা? যারা লিখছেন তারা সবাই তো রবীন্দ্রনাথের চক্ষুষ্মান অনুসারী, রবির দেদীপ্যমান শিখার নিচে সবাই যে বড্ড ম্রিয় আর মলিন! জীবনে একটু ভিন্নতা না থাকলে সব যেমন আলুনি লাগে, তেমনি সাহিত্যেও একটু বিরুদ্ধতা থাকা চাই, নাহলে সব কেমন যেন থমকে যায়, একঘেয়ে লাগতে থাকে। ৮৮ বি, হাজরা রোড, কলকাতার ফোর আর্টস ক্লাবের ছোট্ট কক্ষটিতে বসে এমনি হয়তো ভাবছিলেন চার বন্ধু দীনেশরঞ্জন দাশ, গোকুলচন্দ্র নাগ, সুনীতা দেবী আর সতীপ্রসাদ সেন। ক্লাব থেকে একটি সাহিত্য পত্রিকা প্রকাশ করার স্বপ্ন তাদের বহুদিনের, এমন একটি পত্রিকা যা সাহিত্যে নির্বাধ জীবনচর্চা, যৌবনবন্দনা, জীবনবোধে নব্যরুচির চর্চা, নারী পুরুষের আবেগীয় অনুভূতির উষ্ণ প্রকাশ ও সাহসী দৃষ্টির দিশাসন্ধানে সাহায্য করবে। কিন্তু সে স্বপ্ন বাস্তবে রূপ নেওয়ার আগেই বন্ধ হয়ে যায় ‘ফোর আর্টস ক্লাব’। মাত্র দুবছর আয়ুষ্কালের এই ক্লাব থেকে পত্রিকা প্রকাশ না পেলেও, প্রকাশের বীজ বপিত হয়েছিল এখান থেকেই। ক্লাব ভেঙে যাওয়ার কিছু সময় পর দুই বন্ধু দীনেশরঞ্জন আর গোকুলচন্দ্র, এক আড্ডায় খানিকটা হেয়ালের বশেই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন একটি মাসিক পত্রিকা প্রকাশের, নামও ঠিক হয়ে গেল-‘কল্লোল’। গোকুলের ব্যাগে ছিল তখন এক টাকা আটআনা আর দীনেশের পকেটে টাকা দুই, এই সম্বল নিয়েই রাতারাতি ছাপা হয়ে গেল কল্লোলের প্রথম হ্যান্ডবিল। কিন্তু শুধু হ্যান্ডবিল ছাপালেই তো চলবে না, সাহিত্য পত্রিকায় তো লেখাও চাই; অগত্যা আবার সম্বল সেই ‘ফোর আর্টস ক্লাব’ এর সাহিত্য শাখার একটি পুরোনো খাতা আর তৎকালীন ক্লাব সদস্যদের লেখা পাঠানোর আশ্বাস। কিন্তু তখনো কি কেউ জানত অনেকটা হেয়ালের বশে আচমকা ছাপানো এই পত্রিকা বাংলাসাহিত্যে এক নতুন যুগের সূচনা করবে?

১৯২৩ সালে প্রথম প্রকাশের পর থেকে ১৯২৯ পর্যন্ত মোট সাত বছরের যাত্রায় ‘কল্লোল’ বাংলা সাহিত্য ভান্ডারকে দিয়েছে অনেক, সমৃদ্ধ করেছে নানাভাবে। সাহিত্যের অনেক রথী-মহারথীরা তাই ‘কল্লোল’-এর সাত বছর তথা ‘কল্লোল যুগ’ কে বাংলাসাহিত্যে আধুনিক যুগের সূত্রপাত বলেই মনে করেন। তারা বিশ্বাস করেন ‘কল্লোল’ পর্বের লেখকদের হাত ধরেই বাংলাসাহিত্য ‘ভিক্টোরিয়ান’ ও ‘এডওয়ার্ডিয়ান’ খোলস ছেড়ে আধুনিকতার পোশাক গায়ে জড়িয়েছিল। অবশ্য দ্বিমতও আছে এর। রবীন্দ্রনাথের উত্তরসূরি অনেক সাহিত্যিক আবার ‘কল্লোল যুগ’কে নিছক ফিকশন বলেও আখ্যায়িত করেছেন। তবে নানা মত দ্বিমত সত্ত্বেও, ‘কল্লোল’ থেকে প্রায় ১০০ বছরের নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়ে বাংলাসাহিত্যে ‘আধুনিকতাবাদ’ বিকাশে ‘কল্লোল’-এর অবদানকে অস্বীকার করার উপায় নেই।

‘কল্লোল’-এর সমসাময়িক বিশ্ব সাহিত্যেও আধুনিকতার চর্চা শুরু হয়ে গিয়েছিল। ইংরেজি সাহিত্যের অন্যতম আধুনিক একজন লেখক এজরা পাউন্ড সাহিত্যে ‘ভিক্টোরিয়ান’ পর্ব থেকে ‘আধুনিক’ পর্বের তফাত বোঝাতে বলেছিলেন, ‘আধুনিকতাবাদী লেখকদের লেখার অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো তারা উপন্যাস, গল্প, কবিতা ও নাটকের মাধ্যমে পাঠককে এক অপরিচিত জগতে নিয়ে নিমজ্জিত করে। আধুনিকতাবাদী লেখা প্রায়শই পাঠককে একটি বিভ্রান্তিকর এবং কঠিন মানসিক ল্যান্ডস্কেপের মধ্য দিয়ে নিয়ে যায় যা চট করে বুঝতে হলে পাঠককে অবশ্যই এর শেষ পর্যন্ত যেতে হবে এবং পাঠযাত্রার প্রতি ক্ষণে ক্ষণে পাঠক নিজের মনে নিজেই কাহিনির একটি মানসিক ম্যাপ তৈরি করতে করতে যাবেন’। কথাগুলো খুব কঠিন মনে হলেও আদতে আধুনিক সাহিত্য এত কঠিন নয়। আধুনিক লেখা আমাদের গতানুগতিক চিন্তার চেয়ে একটু ব্যতিক্রম, সমাজের সাধারণ নিয়ম কানুনের সঙ্গে খানিকটা সাংঘর্ষিক, এর মধ্যে নতুনকে জানার এবং নতুনকে নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষার এক অদম্য ইচ্ছা আছে; আমাদের মনস্তাত্ত্বিক জগৎকে বেশ নাড়া দিয়ে যায় আধুনিকতাবাদী লেখা, কিছু সময়ের জন্য হলেও চিন্তার খোরাক জোগায়। বিদ্রোহ, বিরুদ্ধতা, পরাবাস্তবতা, আত্মকেন্দ্রিকতা আর নতুনের প্রতি আগ্রহ আধুনিক সাহিত্যের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। উদাহরণস্বরূপ, ফ্রানৎস কাফকার ‘মেটামরফোসিস’, ডি এইচ লরেন্সের ‘লেডি চ্যাটারলিস লাভার’ বা টি এস এলিয়ট-এর ‘দ্য ওয়েস্ট ল্যান্ড’ পড়লে পাঠকরা খুব সহজেই তা অনুধাবন করতে পারবেন। অবশ্য এ কথাগুলোকেই আরও সহজ করে বলেছেন আবু সয়ীদ আইয়ুব তার ‘আধুনিকতা ও রবীন্দ্রনাথ’ গ্রন্থে। তিনি আধুনিক সাহিত্যের দুটি বৈশিষ্ট্যকে গুরুত্বপূর্ণ বলে উল্লেখ করেছেন, এক. ‘কাব্য দেহের প্রতি একাগ্র মনোনিবেশ, যার পরিণাম কাব্য রচনায় ও সমালোচনায় দেহাত্মবাদ, ভাষাকে আধার বা প্রতীক জ্ঞান করে আপনারই দুর্ভেদ্য মহিমায় সুপ্রতিষ্ঠিত স্বয়ংসম্পূর্ণ সত্তা জ্ঞান করা’ এবং দুই-‘জাগতিক অমঙ্গল বিষয়ে চেতনার অত্যাধিক্য।’

‘কল্লোল’ কি সত্যিকার অর্থেই বাংলাসাহিত্যে আধুনিকতাবাদের অগ্রদূত? এ প্রশ্নের উত্তর পেতে হলে ‘কল্লোল’ এ যারা লিখতেন তাদের লেখার ময়নাতদন্ত বিশেষ জরুরি।

কল্লোল প্রজন্মের সবচেয়ে বিশিষ্ট সদস্য ছিলেন কবি জীবনানন্দ দাশ। নিজের জীবদ্দশায় খুব বেশি স্বীকৃত না হলেও, জীবনানন্দ দাশ সম্ভবত রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের পর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বাঙালি কবি হিসাবে বিবেচিত হন। রবীন্দ্র-পরবর্তী বাংলাসাহিত্যের সেই পুরোনো ভিক্টোরিয়ান রোমান্টিকতা ছেড়ে তিনিই প্রথম ইম্প্র্রেশনিস্টিক যুগে প্রবেশ করেন। জীবনানন্দের কবিতায় ইংরেজ ও ইউরোপীয় আধুনিক ভাবধারাপুষ্ট কবি টি এস এলিয়ট, ওয়ার্ডসওয়ার্থ, কীটস, শেলী প্রমুখদের প্রভাব দেখতে পাওয়া যায়। জীবনানন্দের কবিতায় যে শূন্যতাবোধ ও এক ধরনের মানসিক ক্লান্তির পরিচয় পাওয়া যায় তার অনেকটাই ফরাসি সাহিত্যের প্রথম আধুনিক কবি শার্ল বোদলেয়ার দ্বারা প্রভাবিত। আধুনিক ইউরোপীয় কবিতা থেকে সচেতনভাবে পুষ্টি গ্রহণ করে জীবনানন্দের কবিতা বাংলা কাব্যচর্চায় দারুণ বিবর্তন ও বিস্তৃতি নিয়ে এসেছিল। আধুনিক ইম্প্রেশনিস্ট কাব্যের চিত্রকল্পবাদ, প্রতীকীবাদ ও পরাবাস্তববাদ; এ তিনটি ধারার সঙ্গে বাংলা কাব্যের পরিচয় তথা যোগাযোগ ঘটান জীবনানন্দ একাই। আধুনিক ইম্প্রেশনিস্ট ধারায় কবিতা লিখে তার সময়ে বাংলা কবিতায় যে দুর্বোধ্যতা নিয়ে এসেছিলেন জীবনানন্দ, অনেকেই তখন তা মেনে নিতে পারেননি। আজ এত বছর পরে এসে আমরা বুঝতে পারি তিনি তার সময়ের চেয়ে কতটা এগিয়ে ছিলেন, চিন্তা, চেতনা ও পদ্ধতিতে তিনি কতটা আধুনিক ছিলেন এবং বাংলা কাব্যসাহিত্যে আধুনিকতার সূত্রপাতে কী ভীষণ অবদান তিনি রেখে গিয়েছিলেন!

আধুনিক সাহিত্যের অন্যতম আরও একটি বৈশিষ্ট্য হলো সাহিত্যে সমাজচেতনার উন্মেষ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর বাংলাসাহিত্যে শ্রমজীবী ও সাধারণ মানুষভিত্তিক সমাজচেতনার উন্মেষ দেখা যায়। মার্কসীয় ও ফ্রয়েডীয় ধারায় প্রভাবিত তিরিশের দশকের অনেক কবি সাহিত্যিকরাই রবীন্দ্রবলয় থেকে বেরিয়ে এসে সাম্যবাদী, নৈরাশ্যবাদী ও সুররিয়ালিস্ট ধারার সাহিত্য রচনায় ব্যাপৃত হন। কল্লোলের অন্যতম সদস্য বিষ্ণু দের রচনায় এ ধারার সবচেয়ে শৈল্পিক রূপ প্রত্যক্ষ করা যায়; তার কবিতায় ধরা পড়ে মার্কসীয় মতাদর্শের বিমুগ্ধ রূপ। দুটি বিশ্বযুদ্ধের মধ্যবর্তী সময়ে সামাজিক অস্থিরতা, দাঙ্গা, দুর্ভিক্ষ, শ্রেণিগত বৈষম্য ও আন্দোলন তার রচনায় সরাসরি ছায়া ফেলেছে। তবে মার্কসীয় চেতনার পাশাপাশি বিষ্ণু দে’র বেশ কিছু কবিতায় ফরাসি প্রতীকীবাদের বৈশিষ্ট্যও দেখা যায়; তার ‘সন্দ্বীপের চর’ এবং ‘উর্বশী ও আর্টেমিস’-এর উল্লেখযোগ্য উদাহরণ।

কল্লোলের আরেক কাণ্ডারি বুদ্ধদেব বসু; বাংলাসাহিত্যের প্রায় সব শাখাতেই আধুনিকতার অগ্রদূত হিসাবে তার নাম বললে অত্যুক্তি হবে না কিছু। তাছাড়া কল্লোল গোষ্ঠীর আধুনিকতাবাদী সাহিত্য আন্দোলনের অন্যতম পুরোধাও ছিলেন তিনি। বিখ্যাত ইংরেজ আধুনিক কবি টি এস এলিয়ট এবং ফরাসি কবি বোদলেয়ারের কাব্যচেতনা দ্বারা দারুণভাবে প্রভাবিত ছিলেন বুদ্ধদেব। তাকে অনেকেই আত্মনিমগ্ন সাহিত্যিক হিসাবে আখ্যায়িত করেছেন; তিনি তার রচনায় প্রচলিত রোমান্টিকতার সংজ্ঞাকে ভেঙে নতুন এক ক্রিয়াশীল রোমান্টিক আত্মচেতনার উন্মেষ ঘটান। আধুনিক কবিতার অন্যতম উপাদান হলো সৃজনশীল শক্তি সম্পর্কে সচেতনতা। বুদ্ধদেব বসু এ ইন্দ্রিয় গ্রাহ্য অনুভূতিকে শুধু আয়ত্তেই আনেননি বরং তার রচনায় তিনি অত্যন্ত সাহসের সঙ্গে সামাজিক অবক্ষয়, শরীরসর্ব স্বমাধুর্যহীন প্রেমের করুণ অথচ হাস্যকর রূপের তিক্ত ছবিও খুব সাবলীলভাবে এঁকেছেন।

কল্লোলকালের সেই সামাজিক রাজনৈতিক বাস্তবতা ও সাহিত্যে রবীন্দ্রপ্রভাবের দারুণ তেজ থাকা সত্ত্বেও কয়েকজন অসামান্য প্রতিভাবান কবির কাব্যসাফল্য, আধুনিক রচনাশৈলী ও চেতনা বাংলা সাহিত্যকে ‘আধুনিকতাবাদ’ নামক নিরঙ্কুশ আধিপত্যবাদী এক সাহিত্যধর্ম উপহার দিয়েছিল। জীবনানন্দ দাশ, বুদ্ধদেব, বিষ্ণু দে থেকে শুরু করে প্রেমেন্দ্র মিত্র, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, অমিয় চক্রবর্তী, মোহিতলাল মজুমদার ও আরও অনেকেই ‘কল্লোল’ পত্রিকাকে কেন্দ্র করে তাদের সাহিত্যিক প্রতিভাকে বিকশিত করার পাশাপাশি নিজ প্রতিভাগুণে সময়কে প্রভাবিত করেছেন, বাংলাসাহিত্যকে দেখিয়েছেন এক নতুন পথ। ‘কল্লোল’-এর কোলাহল এক সময় থেমে গেলেও এর হাত ধরে বাংলাসাহিত্যের যে নতুন যাত্রা শুরু হয়েছিল, তা শতবর্ষ পেরিয়ে একালেও চলমান।

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম