|
ফলো করুন |
|
|---|---|
লাস্যময়ী নায়িকা মেরিলিন মনোরো ঘুমের বড়ি খেয়ে চিরনিদ্রায় ঘুমিয়ে পড়েন। মিসরের রূপসী রানী ক্লিওপেট্রা সাপের ঝাঁপিতে হাত দিয়ে আত্মহত্যা করেন। সুচিত্রা সেন স্বামীকে ছেড়ে একাকী বাস করেছিলেন, কানন দেবীর বাড়িতে উঠেছিলেন একবার। রূপসী হয়েও জীবনে সুখী হতে পারেননি এ তিন রূপসী রমণী। অতিরিক্ত রূপ কী সুখের শত্রু? ফ্রান্সের সম্রাট নেপোলিয়ান বোনাপার্ট আক্ষেপ করে বলেছিলেন, যে জীবনে একটি দিনেও তিনি সুখের মুখ দেখেননি। বীর হিসাবে তার ছিল বিশ্বজোড়া খ্যাতি, ঘরে ছিল রূপসী স্ত্রী, ধনসম্পদের অভাব ছিল না। তবুও নেপোলিয়ান সুখের নাগাল পেলেন না!
সুখী হওয়ার একটি মোক্ষম উপায় নাকি পরের উপকার করে বেড়ানো। কৃতজ্ঞতা, মমতা, ক্ষমা, ইত্যাদি মানবিক গুণাবলীর পরিচর্যা করা। মৃত্যুর পরে মাদার তেরেসার ডায়রির পাতা থেকে জানা যায় যে, তিনিও পুরোপুরি সুখী হতে পারেননি। তিনি প্রশ্ন করেছেন, ‘আমি তো প্রভুকে আমার জীবনের সব দিয়েছি, তবুও হৃদয়ে কেন এই অপূর্ণতা?’ ইংরেজিতে ‘hole in the soul’ বলে একটা কথা আছে। কী দিয়ে ভরানো যায় হৃদয়ের গর্ত?
‘চারিদিকে দেখো চাহি হৃদয় প্রসারি, ক্ষুদ্র দুঃখ সব তুচ্ছ মানি’, রবীন্দ্রনাথ পরামর্শ দিয়েছেন। তিনি আরও লিখেছেন,
অল্প লইয়া থাকি, তাই মোর যাহা যায় তাহা যায়।
কণাটুকু যদি হারায় তা লয়ে প্রাণ করে “হায় হায়”।
গৌতম বুদ্ধ একই পরামর্শ দিয়েছেন: হৃদয়পাত্র বড় কর, এক চামুচ লবণ এক গ্লাস পানিকে পানের অযোগ্য করে তোলে, কিন্তু একটি নদীর পানিকে নয়। যাকে তুমি নিজের বলে আঁকড়ে ধরে বসে আছ, তাকে হারাবার ভয় থাকে, সব বন্ধন থেকে মুক্ত হলে সে ভয় ঘুচে যাবে, জীবনে শান্তি নেমে আসবে। বুদ্ধের পরামর্শ নিয়ে আমার একটু সমস্যা আছে, টাকা-পয়সা, বাড়িঘর, সম্পত্তির বন্ধন থেকে মুক্ত হলে খাব কী, আর পরিবারকে কী খাওয়াব? বুদ্ধকে খাওয়ানোর মতো ভক্তের অভাব নেই, কিন্তু আমাকে খাওয়াবে কে? তাছাড়া স্ত্রী-সন্তানের মায়া বন্ধন থেকে মুক্ত হয়ে সুখী হওয়ার ইচ্ছা আমার নেই। ভাগ্যিস কৃষক ভাইরা বুদ্ধের অমৃতবাণী শুনে লাঙ্গল-গরুর মায়া থেকে মুক্ত হননি। দার্শনিকদের হৃদয়পাত্র বিশাল, নিজেকে ভুলে সর্ব মানুষের সুখ-দুঃখের চিন্তা নিয়ে তারা সদাই ব্যস্ত, তবুও সক্রেটিস থেকে শোপেনহায়ার, কেউ খুব সুখী ছিলেন বলে মনে হয় না। দুঃখবাদী শোপেনহায়ার জন্মদিনে কালো কাপড় পরে থাকতেন। ব্যাপারটা কী?
এসব তো গেল কবি এবং দার্শনিকদের কথা। সুখের বিষয় এই যে, আজকাল সুখ নিয়ে চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা মাঠে নেমেছেন। এদের সুখের ডাক্তার বলে ডাকা যেতে পারে। সুখের উৎপত্তিস্থল তো মগজের নিউরোন, গলদটা সেখানে নয় তো? আমাদের মাথায় প্রায় ১০০ বিলিয়ন নিউরোন আছে। ১ বিলিয়ন মানে ১০০ কোটি। নিউরনরা নিজেদের মধ্যে বৈদ্যুতিক সংকেত আদান-প্রদান করছে। এ সংকেতের মাঝে আমাদের সুখ-দুঃখের নিবাস। বিজ্ঞানীরা মগজ স্ক্যান করে এ বৈদ্যুতিক সংকেতের ছবি তুলতে পারেন। এ ছবিটি অনেকটা মাছের বাজারের মতো। তবে আরও অনেক জটিল। একটি বড় মাছের বাজারে ৫০০ জন মাছবিক্রেতা এবং দুই হাজার ক্রেতা দরাদরি করতে পারে। এর মধ্যে কে জিতল, কে হারল, কে পচা মাছ বিক্রি করল, কে সুখী হলো, কার পকেট মারা গেল, বোঝা সহজ নয়। মগজে আছে ১০০ বিলিয়ন ক্রেতা বিক্রেতা! সুখের হিসাব বেজায় কঠিন।
এসব সুখের ডাক্তার বা নিউরোলোজিস্টের মতে ঝামেলাটা আমাদের জীবকোষের ডিএনএ নামের বেজায় লম্বা সব অণু। ডিএনএ চার ফুট লম্বা, কুণ্ডলী পাকিয়ে জীবকোষের কেন্দ্রে ক্রোমসম হিসাবে বসে থাকে। মানুষের ইতিহাস গত দুই লাখ বছরের ইতিহাস। এ দীর্ঘ সময়ে ডিএনএতে তেমন কিছু পরিবর্তন আসেনি। অথচ দুই লাখ বছর আগের জীবনরীতির সঙ্গে মানুষের বর্তমান জীবনের আকাশ-পাতাল প্রভেদ। আদ্যিকালের ডিএনএ এবং আধুনিক জীবনের মধ্যে সংখ্যাত আমাদের অশান্তির প্রধান কারণ।
একজন গ্রামের পাঠশালার পণ্ডিত নামতা, পাটীগণিতে অনেক দক্ষ, কিন্তু তিনি একটি আধুনিক ব্যাংকের দায়িত্ব নিলে অনেক ঝামেলা বাধবে। ধরা যাক আমি লাখ বছর আগের এক গুহামানব, বনে ফলমূল সংগ্রহ করছি। হটাৎ দেখা হলো ভিনজাতির এক মানুষের সঙ্গে। এ অপরিচিত মানুষ বন্ধু না শত্রু? ওর গায়ের জোর কী বেশি, হাতের অস্ত্র কী ধারাল? পালাব না যুদ্ধ করব? খুব দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়ার সঙ্গে আমার জীবনমরণ জড়িয়ে আছে। মানুষ এক সেকেন্ডের তিন ভাগের এক ভাগ সময়ে এ সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলতে পারে। কৃতিত্বটা দাবি করতে পারে আমাদের পুরোনো ডিএনএ। এ যুগে এত দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রয়োজন হয় না, যদি না বনেজঙ্গলে হটাৎ কোনো উদ্যত-ফণা সাপের দেখা পাই। প্রথম দর্শনেই প্রেম বলে একটা কথা আছে, প্রেমে পড়ার জন্যে সেই এক সেকেন্ডের তিন ভাগের একভাগ সময়ই যথেষ্ট। এখানে আমাকে প্রেমে পড়তে সাহায্য করছে আমার সেই পুরোনো ডিএনএ। এত দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রয়োজন নেই, ভুল হওয়ার যথেষ্ট সম্ভাবনা আছে। আমি যার প্রেমে পড়েছি সে সাধুবেশি শয়তান হতে পারে। এ দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য আমাদের শরীরকে অনেক মূল্য দিতে হয়। নিউরোনের নির্দেশে শরীরের বিভিন্ন গ্রন্থি রক্তে ঢেলে দেয় হরেক রকম স্ট্রেস (stress) হরমোন, মগজ থেকে বের হয় নিউরোট্রান্সমিটার যা অতি দ্রুত কাজ করে। এ হরমোন এবং নিউরোট্রান্সমিটার আমাকে দ্রুত পালাতে বা যুদ্ধ করতে সাহায্য করবে। প্রেমের ক্ষেত্রে স্ট্রেস হরমোনের সঙ্গে সুখের হরমোনও রক্তে প্রবেশ করে, এ হরমোন আমার ক্ষুধা, তৃষ্ণা, নিদ্রা হরণ করবে, আমার স্বাভাবিক বুদ্ধি-বিবেচনা লোপ করে দেবে।
আমাদের পুরোনো দিনের হরমোন পুরোনো জীবনের জন্য উপযুক্ত ছিল। প্রতিদিন বনেজঙ্গলে বিষাক্ত পোকামাকড়, বৃশ্চিক, মাকড়সা, সাপের সঙ্গে দেখা হতো; কখনো বা বাঘ, ভাল্লুক, সিংহের সঙ্গে। আরও আছে অন্য গোত্রের মানুষের ছোড়া পাথর বা তীর। দ্রুত সিদ্ধান্ত, যুদ্ধ অথবা পলায়ন, রক্তে স্ট্রেস হরমোন! এভাবে মানুষ বেশিদিন বাঁচতে পারে না, গুহামানবদের গড় আয়ু ছিল ছিল ৩৫ বছর। লবণ, মিষ্টি, মাংস, চর্বি গুহামানবদের আকৃষ্ট করত, তখন এসব স্বাস্থ্যকর খাবার ছিল। এ যুগে মানুষের গড় আয়ু ৭৫ বছর; যদি ৩৫ বছর বয়েসেই পটোল তুলতে চাই, তাহলে এ খাবারগুলো খেতে বাধা নেই। পুরোনো ডিএনএ আমাকে তাৎক্ষণিকভাবে বাঁচিয়ে রাখার কৌশল জানে, ৭৫ বছর বাঁচিয়ে রাখার কৌশল তার হিসাবের খাতায় লেখা নেই। আমরা মাকড়সা দেখলে পালাই; রসগোল্লার হাঁড়ি, মোগলাই পরোটা, বিরিয়ানি, রূপসী রমণী বা সুবেশি পুরুষ দেখলে এগিয়ে যাই, অথচ মাকড়সার চেয়ে এসব আমাদের জীবনের জন্য বেশি ক্ষতিকর হতে পারে।
অন্য প্রাণীর সঙ্গে মানুষের পার্থক্য আছে, সন্তানকে ১৫ বছর পর্যন্ত পালন করতে হয়। শিশুদের শিখতে হয় জটিল ভাষা, আয়ত্ত করতে হয় বিমূর্ত চিন্তাশক্তি। নিজের সন্তানের কষ্টে আমরা বিচলিত হয়, অপরিচিত মানুষের দুঃখ-কষ্টও আমরা অনুভব করতে পারি। আমাদের মগজ থেকে অক্সিটোসিন এবং ডোপামিন নামে দুই নিউরোট্রান্সমিটার স্বাভাবিকভাবে নিঃসৃত হয়, এরাই আমাদের মানবিক, সংবেদনশীল এবং সুখী করে তোলে।
কিছু মা সন্তানকে এত আগলে রাখেন যে, তার জীবনটা বরবাদ হয়ে যায়। আমাদের পুরোনো ডিএনএ অনেকটা সে রকম। ওরা তিলকে তাল করতে ওস্তাদ। ওদের প্ররোচনায় আমরা বিশ্বাস করে বসি যে, সবাই আমার শত্রু, সবাই আমাকে ঠকাতে চায়, পৃথিবীতে ভালোমানুষ নেই, কাউকে বিশ্বাস করতে নেই। ভবিষ্যতের কাল্পনিক বিপদ এবং অসুখ থেকে কীভাবে বাঁচা যাবে তা নিয়ে দুশ্চিন্তা শুরু করি, অতীতের ভুল নিয়ে আফসোস করি। আমরা ভুল ধরা যন্ত্রে পরিণত হই, সবসময় অন্যের ভুল খুঁজে পাই। নালিশ করে বেড়াই, অভিযোগের বোঝা আমাদের পিষ্ঠ করে। অন্যকে সুখী করতে পারি না, নিজেও সুখী হই না। অকারণ উদ্বেগ আমাদের রক্তে স্ট্রেস হরমোনের বন্যা বইয়ে দেয়। মাত্রারিক্ত স্ট্রেস হরমোন রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা কমিয়ে দেয়, আমরা ক্লান্ত হই, উচ্চ রক্তচাপ এবং ডায়াবেটিস রোগ আমাদের আক্রমণ করে, আমরা মারা যাই।
যে পুরোনো ডিএনএ সিন্দুবাদের দৈত্যের মতো আমাদের ঘাড়ে চেপে বসে আমাদের অসুখী করে রেখেছে তা থেকে বাঁচার উপায় কী? সুখ নিয়ে যে চিকৎসাবিজ্ঞনীরা গবেষণা করেন তাদের পরামর্শ দিয়ে একটি বড়ি বানানো যাক। জীবনে যেসব বড়ি খেয়েছেন তা তৈরি করা হয়েছে অসুখকে কেন্দ্র করে। এ বড়িটি বানানো হয়েছে সুখকে কেন্দ্র করে। কৃতজ্ঞতা, ভালোবাসা, ক্ষমা, সংবেদনশীলতা মিশিয়ে বানানো এক বড়ি। সুখ দিয়ে অসুখকে তাড়ানোর চেষ্টা:
১. প্রতিদিন ৫ মিনিট নীরবে চোখ বন্ধ করে বসে থাকুন। দুজন জীবিত এবং একজন মৃতজনের কথা ভাবুন যাদের কাছে আপনি ঋণী। মনে মনে তাদের কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করুন। কল্পনায় তাদের জড়িয়ে ধরুন।
২. যে আপনার সঙ্গে শত্রুতা করেছে, তাকে ক্ষমা করুন, তার মঙ্গল কামনা করুন, তার জন্য প্রার্থনা করুন। বাইবেলে এ কথা লেখা আছে, হয়তোবা বাইবেলের সবচেয়ে মূল্যবান কথা। যিশু এ ধরনের কথা অনেক বলেছেন।
৩. প্রতিটি মানুষকে বন্ধু হিসাবে ভাবুন। রাস্তায় কারও সঙ্গে দেখা হলে মনে মনে তার শান্তি কামনা করুন। সম্ভব হলে সালাম দিন বা নমস্কার করুন। নবিজি সবাইকে সবার আগে সালাম করতেন, এমনকি নিজের মেয়েকেও।
৪. দান করুন। এ কথা সব ধর্মগ্রন্থে লেখা আছে। নবি বলেছেন যে, যদি তোমার দান করার মতো সংগতি না থাকে তবে সাহায্যপ্রার্থী লোকটির সঙ্গে হেসে কথা বল। তোমার হাসিটি দান হিসাবে গ্রহণ করা হবে।
এসব করে কি সুখী হওয়া যায়? নিউরোলজিস্ট এবং চিকৎসাবিজ্ঞানীরা তো তাই বলেন। তবে এ পরামর্শগুলো আমাদের জীবকোষের পুরোনো ডিএনএ বন্ধুদের পছন্দ হবে না।
সুখের বড়ি আপনার জীবনে সুখ এনে দেবে, অসুখ থেকেও বাঁচাবে। এখন যেসব বড়ি খাচ্ছেন, সেসব হয়তো আর খেতে হবে না। আমি সুখের বড়ির খোঁজ পেয়েছি কয়েকজন নিউরোলজিস্টের গবেষণা প্রবন্ধ এবং বক্তৃতা শুনে।
