Logo
Logo
×

সাহিত্য সাময়িকী

অধিকারবোধের সমুজ্জ্বল স্বপ্নভঙ্গের এক অনন্য দলিল

গায়ত্রী সন্ধ্যা

Icon

ড. নাসরীন জেবিন

প্রকাশ: ১৬ জুন ২০২৩, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন বাংলাসাহিত্যের এক প্রথিতযশা ঔপন্যাসিক। তার লেখার বিষয় বহুমাত্রিক। ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ, মধ্যবিত্ত জীবন সংগ্রামের লড়াই, নারীর অসাধ্য সাধনের গল্পকথার ইতিহাস তার সৃষ্টিশীলতায় শুধু অনুপুঙ্খভাবে ফুটে ওঠেনি-পেয়েছে ভিন্ন মাত্রা। ৭৬ বছরের সুদীর্ঘ জীবনে তার অসংখ্য সৃষ্টি বাংলাসাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছে। সেলিনা হোসেন জীবন ও প্রকৃতি থেকে কুড়িয়ে এনেছেন মানুষের আত্মপ্রতিষ্ঠার লড়াইকে। সেলিনা হোসেনের ত্রয়ী উপন্যাস ‘গায়ত্রী সন্ধ্যা’। ১৯৪৭-এর দেশ ভাগের পর থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত সময় নিয়ে রচিত হয়েছে এ উপন্যাস। এ উপন্যাসের সূচনা পর্বে আমরা লক্ষ করি সামাজিক, রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের ওপর ভিত্তি করে এসেছে ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ। সর্বত্র ছিল সামাজিক বিশৃঙ্খলতা, নানা দল মতের পরিপ্রেক্ষিতে সর্বত্রই অরাজকতা বিরাজ করেছে। নানা ঘটনা-দুর্ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৭৫ সালে স্বাধীনতার জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে নিহত হন। এর পরই শুরু হয় জাতির জীবনে বিপরীতমুখী অধ্যায়-যা স্বাধীনতার চেতনাকে ভূলুণ্ঠিত করেছিল। সেলিনা হোসেন ‘গায়ত্রী সন্ধ্যা’ উপন্যাসে বিশাল ক্যানভাসে অনুপুঙ্খ বর্ণনার মাধ্যমে ইতিহাসকে তুলে এনেছেন।

১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পর বহু মানুষ নিজের চিরকালীন বসবাসের শান্তির নীড় ছেড়ে ছিন্নমূল উদ্বাস্তু জীবনযাপনে বাধ্য হয়েছে। নিজ দেশ ছেড়ে অন্য দেশের অধিবাসী হয়েছে তারা। এতকাল অসাম্প্রদায়িক চেতনায় কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যারা বসবাস করেছে একসঙ্গে, সে বন্ধন ছিন্ন করে অন্য দেশের অতিথি হয়েছে তারা। আলী আহামদরা দেশ ভাগের পর নিজ বাসস্থান ছেড়ে বাংলাদেশে এসে রাজশাহীতে নতুন বাসস্থান তৈরি করে। পরিবারের প্রতিটি মানুষের হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হয়েছে। কোথায় তাদের চিরচেনা প্রিয় জন্মভূমি? এ প্রশ্ন জাতির কাছে লেখক করেছেন। রাজশাহীতে নতুন বাসস্থান তৈরি করে তখন তাদের চেতনা জগৎ কতটা দ্বিখণ্ডিত ছিল তাদের ওপর লেখক আলোকপাত করেছেন। ‘গায়ত্রী সন্ধ্যা’য় ইতিহাসের পথ ধরে বিভিন্ন চরিত্রকে উপাত্ত করে লেখক এগিয়ে গেছেন পরিণতির দিকে। ‘গায়ত্রী সন্ধ্যা’ উপন্যাস নিয়ে লেখক বলেছেন-

“গায়ত্রী সন্ধ্যা আমি এ দেশের আর্থ-সামাজিক রাজনৈতিক পটভূমিতে রচনা করেছি। তিন খণ্ডে ৪৭ সাল থেকে এ উপন্যাসের সূচনা। ৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রেক্ষাপট দিয়ে শেষ হয়েছে। ৪৭ সালের পর থেকে নতুন রাষ্ট্র পাকিস্তানে আমাদের যে আইডেনটিটি ক্রাইসিস শুরু হয়েছিল সেটি উপন্যাসের প্রধান উপজীব্য। আমার উপন্যাসের নায়ক ৪৭ সালে দেশভাগের সময় শুধু মুসলমান হওয়ার কারণে নিজ দেশ থেকে তাড়িত হয়ে এ দেশে চলে এসেছে। আবার ৭১ সালে সে বাঙালি হওয়ার কারণে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হাতে নিহত হয়। এ আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক পটভূমি এ উপন্যাসের বড় ক্যানভাস এবং আমি মনে করি এ উপন্যাসের মধ্যে নানা উপাদান আছে। সেগুলো পাঠককে একটু ভিন্নভাবে ভাবতে সাহায্য করবে।”১

(মুক্ত করো ভয়, সাক্ষাৎকার, সেলিনা হোসেন, পৃ-২২৮)

১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের শুরু থেকে ১৯৫৮ সালের সামরিক শাসনের সময়কাল পর্যন্ত ‘গায়ত্রী সন্ধ্যা’ উপন্যাসের প্রথম খণ্ডের বিস্তৃতিকাল প্রবাহিত হয়েছে। এ সময় দেশ ভাগের আগে ও পরে ভয়াবহ দাঙ্গা শুরু হয়েছিল। শুরু হয়েছিল ইলা মিত্র (১৯২৫-২০০২) আর রমেন মিত্রের নেতৃত্বে তেভাগা আন্দোলন। যে আন্দোলন ছিল কৃষকের বাঁচা-মরার প্রশ্ন। কৃষক আন্দোলনকে সফল করতে ইলা মিত্র অনেক আত্মত্যাগ করেছিলেন। পরবর্তীকালে রাজশাহী জেলে তাকে হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে কমিউনিস্ট নেতৃত্ব মুছে দেওয়া হয়েছিল। ব্রিটিশ শাসন, কংগ্রেস আর মুসলিম লীগ এক হয়ে উপমহাদেশের সবচেয়ে হৃদয়বিদারক যে ঘটনা ঘটিয়েছিল-যার ফলে সাতচল্লিশের দেশ ভাগ। ‘গায়ত্রী সন্ধ্যা’ উপন্যাসে লেখক হৃদয়স্পর্শী ভাষায় দেশ ভাগের রক্তাক্ত ইতিহাসকে আপন আলোয় তুলে এনেছেন।

১৯৪৮ সালের ২১ মার্চ রমনা রেসকোর্স ময়দানে এবং ২৪ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক বিশেষ সমাবর্তন অনুষ্ঠানের উৎসবে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসাবে ঘোষণা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাংলার জনগণ প্রতিবাদ মুখর হয়ে ওঠে। পূর্ব বাংলার জনগণ মাতৃভাষা অর্জনের জন্য জীবন বাজি রেখে লড়াই করে। আমরাই একমাত্র জাতি যারা মায়ের ভাষা রক্ষার জন্য রাজপথে রক্তে ভাসিয়ে দিয়েছি। ১৯৪৬ সালে ভয়াবহ দাঙ্গাতেও যারা ভিটেমাটিতে পড়েছিল পঞ্চাশের দাঙ্গায় তাদের দেশ ছাড়তে হয়েছিল। নিজের ভিটেমাটি ছেড়ে উদ্বাস্তু জীবনযাপনের পথে ধাবিত হওয়ার যন্ত্রণাদগ্ধ যে ইতিহাস তা লেখক এ উপন্যাসে সত্যনিষ্ঠভাবে উপস্থাপন করেছেন।

১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারিতে ভাষা আন্দোলনে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে ছাত্র-জনতা মিছিল নিয়ে এগিয়ে যায়। পুলিশ নির্বিচারে গুলি চালায়। আব্দুল জব্বার, রফিক, বরকতসহ অনেকেই ঘটনাস্থলেই মারা যায়। আহত হয় একাধিক। অনেক লাশ গুম হয়। গুম হওয়া লাশ প্রতিনিধিত্ব করতে দেখেছি আমরা মফিজুলকে। অহিকে দেখেছি আহত হয়ে পড়ে থাকতে। সেলিনা হোসেনের ‘গায়ত্রী সন্ধ্যা’ উপন্যাসের মানুষেরা এভাবেই সেদিন কথা বলে উঠেছিল-

“খবরের কাগজটা পড়ে গুম হয়ে থাকে আলী আহমদ। এমনিতে দুদিন ধরে জ্বর। একুশ তারিখের ঘটনায় টিয়ার গ্যাস এবং লাঠি চার্জে আহত হয়েছে। মফিজুল তার কাছাকাছি ছিল, পরে ভিড়ে কোথায় ছিটকে চলে যায় টের করতে পারেনি। এখন পর্যন্ত মফিজুল কোনো কিছু ভাবতে পারে না। কাগজে খবরটা পড়ে চেঁচিয়ে ওঠে প্রদীপ্ত, বাবা এই যে আমাদের অহি, অহিউল্ল্যাহ।”২

(‘গায়ত্রী সন্ধ্যা’, সেলিনা হোসেন)

‘গায়ত্রী সন্ধ্যা’ উপন্যাসের চলমানতা সময়ের প্রবাহমানতা এগিয়ে যায়। ‘গায়ত্রী সন্ধ্যা’ উপন্যাসের দ্বিতীয় খণ্ডে এসে সামরিক শাসন চলাকালে সমাজ জীবনে নানা অরাজকতা সৃষ্টি হয়। শিক্ষা, কর্মসংস্থান, সাহিত্য, শিল্প, সংস্কৃতি সব খাতেই বঞ্চিত হয়েছে পূর্ব বাংলা।

সেলিনা হোসেনের ‘গায়ত্রী সন্ধ্যা’ উপন্যাসের তৃতীয় খণ্ডের ভূমিকায় প্রখ্যাত মনীষী এস ওয়াজেদ আলীর কথা তিনি সম্মানের সঙ্গে স্মরণ করে যে মন্তব্য করেছেন তা প্রণিধানযোগ্য-

‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে আমার ইতিহাসের সেই মহামানব মনে হয়। তিনি বাঙালিকে তার গৌরবময় জীবনের সন্ধান দিয়েছেন। বাঙালি অভিনব জীবনের আস্বাদ পেয়েছে।’

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুরের নেতৃত্ব যেন বাংলার মানুষের মনে নতুন করে বেঁচে ওঠার স্বপ্ন বুনে দিয়েছিল। লেখক সে সময়কে আলী আহমদের চরিত্রের মাঝে চমৎকার ভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন।

ব্রিটিশ শাসন থেকে শুরু করে প্রতিটি আন্দোলনে ছাত্রজনতা এগিয়ে এসেছে জীবন বাজি রেখে। অধিকারবোধে সোচ্চার থেকে কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন এসব আন্দোলনকে এ উপন্যাসে পর্যায়ক্রমে তুলে এনেছেন। সমকালীন রাজনীতিতে ছাত্রসমাজ কীভাবে অংশীদারভুক্ত হয়েছে তারও বর্ণনা তিনি সময়োপযোগী করে তুলে ধরেছেন। যে হিন্দু-মুসলিম কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে বসবাস করেছে প্রজন্মের পর প্রজন্ম। অথচ সেই মানুষগুলোর হাতে তারাই খেলার সাথির শরীরের রক্ত টপ টপ করে পড়েছে দেশ ভাগের বিষাক্ত ছোবলে। রাজশাহীতে আলী আহমদের বাড়ির কাছে মদনের চায়ের দোকান ছিল-যা ছিল তার বেঁচে থাকার পরম আশ্রয়স্থল। যে দোকান নিয়ে নেওয়া হয়। মদন ছেলে-সন্তান আর পরিবার নিয়ে দেশ ছেড়ে উদ্বাস্তের জীবন বেছে নেয়। মদনের বাড়ি সাহেব আলী পানির দামে কিনে নেয়। মদনের মতো বহু মানুষ দেশ ভাগের সময় ভিটেমাটি ছেড়ে চলে যায়। সনাতনের স্ত্রী সন্তানসম্ভবা। সেও পুষ্পিতার মতো সন্তান আগমনের অপেক্ষায় থাকে ট্রেনের কামরায়। পাকিস্তান শাসকগোষ্ঠী চরম অবহেলা করে পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের প্রতি। পূর্ব বাংলায় মানুষের জন্য মাত্র ত্রিশ লাখ টাকা বরাদ্দ করে পাকিস্তান সরকার। প্রদীপ্তকে প্রতিবাদ করতে দেখেছি আমরা। যেখানে কোটি কোটি টাকা প্রয়োজন সেখানে বরাদ্দ কতটাই কম। পূর্ব বাংলার বঞ্চিত জনগোষ্ঠী প্রতিবাদমুখর হয়ে ওঠে। ‘দৈনিক পূর্বদেশ’ পত্রিকার বর্ণনা লেখক তুলে ধরেছেন- “পূর্ব বাংলা কাঁদো, তুমি কাঁদো, কাঁদো বাংলার মানুষ। এখন কান্না ছাড়া তোমার জন্য কি বাকি আছে বলো? খড় কুটোর মতো যারা নোনা পানির টানে সমুদ্রে হারিয়ে গেছে, তাদের জন্য কাঁদো।”৪

(‘গায়ত্রী সন্ধ্যা’, সেলিনা হোসেন)

‘গায়ত্রী সন্ধ্যা’ সেলিনা হোসেনের মহাকাব্যিক উপন্যাস। এ উপন্যাস বাংলাদশ ও বাঙালি জীবনের অখণ্ড ভূখণ্ড। যে ভূখণ্ড নিয়ে বাঙালি জাতির বারোমাসি স্বপ্নবোনা। যে ভূখণ্ডে বাঙালির স্বপ্নসাধে জড়িয়ে আছে আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। যিনি বাঙালিকে স্বপ্ন দেখিয়েছেন-দেখিয়েছে অধিকার নিয়ে বাঁচতে। সে স্বপ্নকে চুরমান করে দেয় তাকে হত্যার মাধ্যমে। মানুষের জন্য যে ভূখণ্ড-সেখানে প্রতিদিনের গায়ত্রী সন্ধ্যায় মানুষের মঙ্গল ধ্বনি বাজে। যে ভূখণ্ড তৈরি করে একটি জাতির স্বপ্ন সাধের ইতিহাস।

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম