Logo
Logo
×

সাহিত্য সাময়িকী

ত্রিভুজ প্রেমের জটিলতা

Icon

খন্দকার রেজাউল করিম

প্রকাশ: ০৭ জুলাই ২০২৩, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

প্রস্তর যুগে ত্রিভুজ প্রেম ছিল, এ যুগেও আছে। ত্রিভুজ প্রেমের জটিলতা নিয়ে অনেক বই লেখা হয়েছে, সিনেমা করা হয়েছে। রবীন্দ্রনাথের ‘ঘরে বাইরে,’ ‘চোখের বালি,’ এবং আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের ‘আমি, সে ও সখা’ ত্রিভুজ প্রেমের গল্প। এ গল্পগুলো কখনো সুখের হয় না। রবীন্দ্রনাথের উপন্যাস দুটির পরিণতি মর্মান্তিক, তবে আশুতোষ মুখোপাধ্যায় তিনজনের একজনকে ‘হান’ বানিয়ে এক অবাস্তব কাহিনির জন্ম দিয়েছেন। মহানায়ক উত্তম কুমার সিনেমায় এ মহাপুরুষের অভিনয় করেছেন, যা দেখে মানুষের চোখে জল আসে, বাজারে বইটির কাটতি বেড়ে যায়। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে জনপ্রিয় গল্প লেখকের পার্থক্য এখানেই! দুজনের বেশি লোক একসঙ্গে জুটলে ঝামেলা বাধবে। সতীন সমস্যা, ঘরের বাইরের গার্ল ফ্রেন্ড বা বয় ফ্রেন্ড সমস্যা, শাশুড়ি সমস্যা। এক কন্যা রাঁধেন বাড়েন, এক কন্যা খান, এক কন্যা রাগ করে বাপের বাড়ি যান। তিন কন্যা সমস্যা। এক কন্যা বাপের বাড়ি যাবেই যাবে!

পদার্থবিদ্যায় এ জটিলতাকে বলা হয় three body problem বা তিনজনের সমস্যা। এ সমস্যার কথা ভেবে ভেবে নিউটন অনেক রাত না ঘুমিয়ে কাটিয়েছেন। আজ পর্যন্ত কেউ এ সমস্যার সমাধান বের করতে পারেনি। মাধ্যাকর্ষণ তত্ত্ব দিয়ে নিউটন ‘চাঁদ-পৃথিবী’ সংসারের চমৎকার সমাধান দিয়েছিলেন। কিন্তু চাঁদের ওপরে সূর্যের টানও কম নয়। ‘চাঁদ-পৃথিবী-সূর্য’ এ ত্রিভুজ প্রেমের রহস্য ভেদ করতে নিউটন ব্যর্থ হন। সৌরজগতে আছে আরও অনেক গ্রহ, সবার সঙ্গে সবার টানাটানি। একে বলে many body problem বা অনেক জনের সমস্যা। সবাই মিলে কি সুখের ঘর গড়া যাবে? দুজনের অতিরিক্ত সদস্য থাকলে বিশৃঙ্খলতার সৃষ্টি হয়। হঠাৎ একদিন পৃথিবী সৌরজগৎ থেকে ছিটকে বেরিয়ে যেতে পারে। এ কথা ভেবেই নিউটন কিছুদিন অনিদ্রায় ভুগেছিলেন। পরে আর ভাবতেন না। যার কোনো সমাধান নেই, তা নিয়ে ভেবে কী লাভ? ঈশ্বরের ওপর নিউটনের ছিল অগাধ বিশ্বাস। দয়ালু ঈশ্বর কি এমন কাণ্ড ঘটাতে পারেন?

মহাবিশ্বে দলাদলি একটি স্বাভাবিক ঘটনা। ১৭টি মৌলিক কণিকার দলাদলি থেকে মানুষ, প্রজাপতি, নক্ষত্র, গ্যালাক্সি তৈরি হয়েছে। একটি দলের সদস্য স্বামী-স্ত্রী-সন্তান হতে পারে, প্রেমিক-প্রেমিকা হতে পারে, দেশ, জাতি, ধর্ম, নক্ষত্র, ঘূর্ণিঝড় বা ব্ল্যাক হোল হতে পারে। মানুষ ভালোবাসা নিয়ে, ফুটবল খেলা নিয়ে, ধর্ম নিয়ে, দেশ নিয়ে, জাতি নিয়ে দলাদলি করে। নারী-পুরুষের ক্ষেত্রে ‘আমি এবং সে’ দলটি সবচেয়ে টেকসই। ‘আমি, সে ও সখা’ দলাদলি জটিলতা বাড়ায়, দলটি ভেঙে যায়। আকাশের নক্ষত্রের ক্ষেত্রেও তাই। শুরুতে একসঙ্গে অনেক নক্ষত্র জন্ম নেয়, একসঙ্গে দল (স্টার ক্লাস্টার) হয়ে বাস করে, সময়ের সঙ্গে ধীরে ধীরে অনেক নক্ষত্র দল থেকে বেরিয়ে যায়, শেষ পর্যন্ত দুটি নক্ষত্র (বাইনারি স্টার) হিসাবে টিকে থাকে। আমাদের সূর্যকে ব্যাচেলর বলা যায়, কোনো সঙ্গী নেই। বেচারা ৫ বিলিয়ন বছর ধরে ৩ আলোক বছর দূরের প্রক্সিমা সেনটাউরি নক্ষত্রপুঞ্জের দিকে হতাশ নয়নে তাকিয়ে আছে। এ রকম একাকী নক্ষত্র মহাবিশ্বে খুব বেশি দেখা যায় না। ব্ল্যাক হোলের ক্ষেত্রে দুই সদস্যের দলও নিরাপদ নয়। পৃথিবী থেকে এক দশমিক তিন বিলিয়ন আলোক বছর দূরে একবার দুটি ব্ল্যাক হোল মরণ খেলায় মেতে উঠেছিল, দুজন দুজনের দিকে চক্রাকারে ঘুরতে ঘুরতে প্রায় আলোর বেগে একে অপরের বুকে ঝাঁপ দিয়েছিল। এ প্রলয়কাণ্ঢে মহাবিশ্বের স্পেস-টাইমের চাদর দুলে উঠেছিল। সেই দোলন ২০১৫ সালে আমেরিকার লাইগো ফাঁদে ধরা পড়ে।

মানুষের দলাদলির বিজ্ঞান কেমন? ধরা যাক আমেরিকার এক শহরে মাত্র দুটি বাঙালি পরিবার বাস করে। নতুন আরেকটি পরিবার আসলে সম্পর্কের জটিলতা বেড়ে যাবে। প্রথম দুটি পরিবারের মধ্যে এতদিন যে সম্পর্ক বিরাজ করছিল তা আর থাকবে না। একটু অঙ্কের ভাষা ব্যবহার করা যাক: এ তিনটি পরিবারকে যদি ইংরেজি বর্ণমালার প্রথম তিনটি অক্ষর দিয়ে চিত্রিত করি তাহলে তিন পরিবার যেভাবে দলাদলি করতে পারে তা হলো (AB), (AC), (BC), (AB, C), (AC, B), (BC, A), (ABC)। আগে যখন শুধু দুটি পরিবার ছিল তখন শুধু একটি দল অই ছিল, এখন হলো ৭টি দল, ৭ ধরনের জটিলতা। এখানে তিনটি পরিবারকে সমান মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। বাস্তবে এ পরিবারগুলোর মাঝে বৈষম্য থাকবে, কেউ ধনী, কেউ দরিদ্র, কোনো পরিবারে আছে রূপসী স্ত্রী, কোনো পরিবারের লুচ্চা স্বামী আরেক পরিবারের স্ত্রীর প্রতি অনুরক্ত ইত্যাদি। এসব বৈষম্য অতিরিক্ত বিশৃঙ্খলতা সৃষ্টি করে। পদার্থবিদ্যায় একে বলে প্রজাপতির কাণ্ঢ বা বাটারফ্লাই ইফেক্ট। প্রজাপতির পাখার ঝাপটায় ঝড় নেমে আসা! পরিবারের সংখ্যা বাড়তে থাকলে জটিলতা দ্রুত বেগে বাড়তে থাকবে, শান্তি বজায় রাখার জন্যে মাতাব্বর, সালিশ, সমিতি ইত্যাদির প্রয়োজন হবে।

পরিবারের বদলে দলগুলোকে দেশ বললে হয়তো বুঝতে সুবিধা হবে। ধরা যাক A = আমেরিকা, B =রাশিয়া, C =চীন। (AB) হলো আমেরিকার সঙ্গে চীনের দ্বিপাক্ষিক চুক্তি। (AB, C) মানে হলো আমেরিকা এবং রাশিয়া আগে জোট পাকিয়ে চীনের সঙ্গে বাড়তি চুক্তি করতে যাচ্ছে ইত্যাদি। আগেই দেখেছি এভাবে ৭টি দল সৃষ্টি করা যায়। বলতে পারেন ২-এর সঙ্গে ১ যোগ ৩ না হয়ে ৭ হয়ে গেছে। এর পর আরও একটি দেশ যোগ করলে ২+১+১ সমান ২০ হয়ে যাবে। অঙ্কের ভাষায় এসব হলো অরৈখিক (nonlinear) সম্পর্ক, দার্শনিক এরিস্টটলের ভাষায় ‘sum of the parts is not equal to the whole.’ দুটি দেশের বদলে তিনটি দেশ হলে এবং তিনটি দেশই সমান শক্তিশালী হলে যুদ্ধ বাধার সম্ভবনা অনেক বেড়ে যায়। চীনের পারমাণবিক ক্ষেপণাস্ত্রের সংখ্যা দ্রুত বেড়ে যাচ্ছে, বিজ্ঞানীরা দলাদলি এবং যুদ্ধের সম্ভবনা নিয়ে অঙ্ক কষা শুরু করেছেন। এই যুদ্ধ লাগলে পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবে। নিউটন সৌরজগতের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত ছিলেন, সৌরজগৎ থেকে পৃথিবী বিদায় নেওয়ার আগেই হয়তো দলাদলির কারণে পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবে।

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম