Logo
Logo
×

সাহিত্য সাময়িকী

আরাকান রাজসভায় বাংলাসাহিত্য এবং পদ্মাবতী

Icon

কাওসার পারভীন

প্রকাশ: ১৪ জুলাই ২০২৩, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

একটি জাতির নিজের পরিচয়ের বাহক তার মুখের ভাষা। আর আমরা বাঙালি জাতি ধারণ করে আছি নিজস্ব সত্তার বাহক এই বাংলাভাষাকে। হাজার বছরের ইতিহাস পর্যালোচনায় দেখা যায় বাংলাভাষা হঠাৎ করে তৈরি হয়নি। আজকের এই বাংলাভাষার সমৃদ্ধি হয়েছে ধীরে ধীরে। শত শত বছর ধরে একটু একটু করে পরিবর্তন হতে হতে আজকের এ বাংলাভাষা।

মধ্যযুগের একজন বাঙালি মুসলিম কবি ছিলেন আলাওল। পূর্ণনাম সৈয়দ আলাওল।

কবি সৈয়দ আলাওল আনুমানিক ১৬০৭ সালে তৎকালীন মাদারীপুর জেলার ফতেয়াবাদে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা ছিলেন ফতেয়াবাদের শাসনকর্তা মজলিশ এ কুতুবের অমাত্য। তিনি বাংলা, আরবি, ফার্সি এবং সংস্কৃত ভাষায় জ্ঞান অর্জন করেন। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ’র মতে কবির জন্ম ষোড়শ শতকের শেষ ভাগে এবং মৃত্যু বৃদ্ধ বয়সে, ১৬৭৩ খ্রিষ্টাব্দে। জলপথে চট্টগ্রাম যাওয়ার সময় আলাওল ও তার পিতা পর্তুগিজ জলদস্যুদের দ্বারা আক্রান্ত হন সেখানে তার পিতা জলদস্যুদের হাতে নিহত হন। অতঃপর তিনি জলদস্যুদের হাতে পরে ক্রীতদাস হিসাবে আরাকানে বসবাস শুরু করেন। তার জীবনের অধিকাংশ সময় কেটেছে আরাকানে। তিনি আরাকান রাজা সাদ উমাদারের অশ্বারোহী সেনাবাহিনীতে ভর্তি হন। তার কাব্যপ্রতিভার পরিচয় পাওয়ার পর তিনি রাজসভার কবি হন। তাকে কাব্যচর্চায় বিশেষভাবে উৎসাহিত করেন মাগন ঠাকুর।

বাংলাদেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণ পূর্বাংশে অবস্থিত আরাকান, মিয়ানমারের (তৎকালীন বার্মা) একটি অঙ্গরাজ্য। বাংলার দক্ষিণ-পূর্বাংশের সঙ্গে ভৌগোলিক যোগসূত্রের কারণে প্রাচীনকাল থেকে রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিকভাবে এ রাজ্য বাংলাদেশের (তৎকালীন পূর্ব বাংলা) সঙ্গে সম্পৃক্ত।

দুই দেশের রাজনৈতিক সম্পর্ক ছিল পরস্পরের ওপর নির্ভরশীল। ক্ষমতার রদবদল এবং নানা উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে বাংলার সুলতান বারবাক শাহর দুর্বলতার সুযোগ গ্রহণ করে রাজা বোসাউপিউ ১৪৫৯ খ্রিষ্টাব্দে চট্টগ্রাম জেলা দখল করে নেন। ১৬৬৬ সালে মোগলদের দ্বারা বিতাড়িত না হওয়া পর্যন্ত প্রায় দুই শতককাল ধরে আরাকানিরাই এখানে রাজত্ব করে। চট্টগ্রাম শহরের চকবাজার বড় রাস্তা থেকে শুরু হয়ে বহদ্দরহাট হয়ে প্রধান সড়কটি আজও আরাকান রোড নামে আভিহিত।

মুসলিম সংস্কৃতি আরাকানের জনগণের জীবনে এবং রাজ্যসভা পর্যন্ত গভীরভাবে প্রভাবিত করে। আরাকানের রাজারা বাংলাসাহিত্যকে পৃষ্ঠপোষকতা করেন এবং বিভিন্ন অঞ্চলের প্রতিভাবান কবিদের আরাকান রাজসভায় জায়গা করে দেন। ধীরে ধীরে অনেক বাঙালি মুসলমান কবি আরাকান রাজসভায় অংশগ্রহণ করতে থাকেন। আরাকান রাজা থাদমেন্তরের শাসনকালে বাঙালি কবি আশরাফ খান যুদ্ধমন্ত্রী পদে নিয়োজিত ছিলেন। শক্তিশালী একজন মন্ত্রী এবং নানা কর্মকাণ্ডে সাফল্যের কারণে তিনি ‘উজির লস্কর’ উপাধি পান এবং রাজার পক্ষ থেকে পুরস্কৃত হন।

মধ্যযুগের বাঙালি বিখ্যাত কবিদের মধ্যে আরও রয়েছেন কবি দৌলত কাজি, আব্দুল করিম খোন্দকার, কোরেশী মাগন ঠাকুর, মরদন এবং মহাকবি আলাওল।

বাংলাসাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি আলাওল আরাকান রাজসভায় প্রধানমন্ত্রীর আমাত্য পদে স্থান পান। আরাকান রাজা ও মন্ত্রীদের পৃষ্ঠপোষকতায় তিনি বাংলায় ছয়টি পুস্তক রচনা করেন। এর মধ্যে তার অন্যতম এবং বিখ্যাত সৃষ্টি ছিল ‘পদ্মাবতী’ কাব্যগ্রন্থ। রচনাকাল ১৬৫১ খ্রিষ্টাব্দ।

বাংলাসাহিত্যের মধ্যযুগের উজ্জ্বল নিদর্শন মহাকবি আলাওলের অনুবাদ কাব্যগ্রন্থ ‘পদ্মাবতী’।

কবি মালিক মোহাম্মদ জায়সীর ‘পদুমাবৎ’ কাব্যের অনুবাদ এটি। মধ্যযুগের বাংলাসাহিত্যের ইতিহাসে পদ্মাবতী কাব্যগ্রন্থ ছিল স্বতন্ত্ররীতির এক অনুপম সৃষ্টি।

অযোধ্যার হিন্দি ভাষার সাধক কবি মালিক মুহম্মদ জায়সীর ‘পদুমাবৎ’ কাব্য অনুসরণে লেখা বিখ্যাত ‘পদ্মাবতী’ কাব্যগ্রন্থ। অনুবাদ কাব্য সত্ত্বেও রোমান্টিক প্রণয়গাথা এ গ্রন্থে পাঠকমহলে বিপুল সাড়া জাগাতে সক্ষম হয়েছিল। আলাওল জায়সীর কাব্যের হুবহু অনুবাদ করেননি। আক্ষরিক ও ভাবানুবাদে, স্বতন্ত্রভাবে তিনি পদ্মাবতী কাব্য রচনা করেছিলেন।

সিংহলের রাজকন্যা পদ্মাবতী, চিতোরের রাজা রত্নসেন, দিল্লির সম্রাট আলাউদীন খিলজী, রাজা দেপপাল, এসব চরিত্রের কাল্পনিক কাব্যরূপ, ঐতিহাসিক প্রণয় উপাখ্যান ‘পদ্মাবতী’। বিষয়বস্তুর দিক থেকে এ এক হৃদয়গ্রাহী কাব্য নিঃসন্দেহে।

সাবলীল ভাষার ব্যবহার ও মার্জিত ছন্দের কারিশমায় ‘পদ্মাবতী’ আলাওলের কবি প্রতিভার স্বাক্ষর বহন করে। মহাকবি আলাওল রচিত উল্লেখযোগ্য আরও কাব্যগ্রন্থ হলো সয়ফুলমুলক বদিউজ্জামান, হপ্তপয়কর, তোহফা, সিকান্দরনামা, রাগতালনামা।

প্রধানত সিংহলদেশীয় রাজকন্যা পদ্মাবতীর উপাখ্যান-কাব্যগ্রন্থ পদ্মাবতীর জন্য মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্যের মুসলিম কবিদের মধ্যে তিনি সর্বশ্রেষ্ঠ বিবেচিত হন। আরাকান রাজসভার অন্যতম কবি হিসাবে আবির্ভূত হলেও মধ্যযুগের সমগ্র বাঙালি কবির মধ্যে ‘শিরোমণি আলাওল’ রূপে শীর্ষস্থান অধিকারী। তিনি আরবি, ফার্সি, হিন্দি ও সংস্কৃত ভাষায় বিজ্ঞ ছিলেন। এছাড়া যোগশাস্ত্র, কামশাস্ত্র, ইসলাম ও হিন্দু ধর্মশাস্ত্রীয় ক্রিয়াপদ্ধতি, যুদ্ধবিদ্যা, নৌকা ও অশ্ব চালনা প্রভৃতিতে বিশেষ পারদর্শী হয়ে আলাওল মধ্যযুগের বাংলাসাহিত্যে এক অনন্য প্রতিভার স্বাক্ষর রাখেন।

মহাকাব্য ‘পদ্মাবতী’ কাব্যগ্রন্থে পদ্মার রূপবর্ণনা পর্বের কিছু চরণ

‘সুচারু সুরস অতি রাতুল অধর।

লাজে বিম্ব বান্ধুলি গমন বনান্তর॥

রক্ত উৎপল লাজে জলান্তরে বৈসে।

তাম্বুল রাতুল হৈল অধর পরশে॥

আঁখিযুগ নীলোৎপল পুণ্য দরশনে।

কার ভাগ্য বশে বিধি সৃজিল যতনে॥

কুটীল কবরি কুষুম শাজ।

তারক মণ্ডলে জলধর মাজ॥

ষুব শশী দুহ শিন্দুর ভাল।

বেরি বিধন্তুদ অলকা জাল॥’

শোন্দরি কামিনি কাম বিমোহে।

খঞ্জন গঞ্জন নয়ানে ছোহে॥

‘কন্যাবিদায়’ পর্বের দুটি চরণ

‘পদ্মাবতী সব সখীগণ আনাইল।

গমনের কাল যদি নিকট হইল॥’

আশাবাদের কথা হলো, বর্তমান সময়ে মহাকবি আলাওলের সাহিত্য পথ অনুসরণ করে, অনুপ্রাণিত হয়ে প্রাচীন মিথ নিয়ে অনেকেই লিখছেন কাব্যে কিংবা গদ্যে।

যুগে যুগে বাংলাসাহিত্যের উৎকর্ষতা বেড়েছে, বাড়ছে। সোনালি দিনের পথে এগিয়ে যাক আধুনিক বাংলাসাহিত্য। চলার পথ হোক মসৃণ।

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম