সৈয়দ মুজতবা আলী
চিরঞ্জীব ক্লাসিক সাহিত্যিক
তৌফিকুল ইসলাম চৌধুরী
প্রকাশ: ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
সৈয়দ মুজতবা আলী ইংরেজি, আরবি, ফারসি, রুশ, জর্মন, সংস্কৃতসহ ২২টি ভাষা জানতেন। বহু ভাষাবিদ অগাধ পাণ্ডিত্যের অধিকারী সৈয়দ মুজতবা আলীর পড়াশোনার বিস্তৃতিও ছিল বিশাল। তিনি ভাষা, ধর্ম, দর্শন, সমাজতত্ত্ব সবকিছুতেই আগ্রহী ছিলেন। লেখাপড়া করেছিলেন বিশ্বভারতী, আলীগড়, জার্মানির বন বিশ্ববিদ্যালয় ও কায়রোর আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয়। তার অগাধ পাণ্ডিত্যের বিষয়ে অবগত হয়ে হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়, (যিনি ৩০ বছর পরিশ্রম করে বঙ্গীয় শব্দকোষ অভিধানটি লিখেছিলেন) একবার বলেছিলেন, ‘আমার মৃত্যুর পর বঙ্গীয় শব্দকোষের সংস্করণ হলে মুজতবার সাহায্য যেন নেওয়া হয়।’ মুজতবার পাণ্ডিত্য ও লেখনী বিষয়ে অবগত ভাষা-আচার্য সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় অনুযোগ করে বলতেন, ‘মুজতবা আলী তুলনামূলক ধর্মতত্ত্বে প্রচণ্ড গবেষক হতে পারতেন, তুলনামূলক ভাষাতত্ত্বে সার্থক অন্বেষণ চালাতে পারতেন, ভারতীয় ইতিহাসের অনুদঘাটিত দিক উন্মোচন করতে পারতেন, কিন্তু কিছুই করেননি। শুধু ব্যঙ্গ রসিকতায় নির্বাসন নিয়ে নিজেকে নিঃশেষ করলেন।’ আসলে কি সৈয়দ মুজতবা আলী নিঃশেষিত হয়ে গিয়েছিলেন? তার জন্মের শতবর্ষ পেরিয়ে আরও পথ চলার পরও এ প্রশ্ন অনেকের মনে আকুলিবিকুলি করতেই পারে!
সৈয়দ মুজতবা আলী সম্পর্কে এ দৈন্যতার কারণ-তার সম্পর্কে লেখালেখি হয়েছে খুবই কম। তিনি নিজেও তার সাহিত্য জীবন সম্পর্কে কোনো কৌতূহল পছন্দ করতেন না। জীবদ্দশায় তার কোনো বই তার কাছে চাইলে তিনি বেশ বিরক্ত হতেন। তিনি বলতেন, ‘আমি বেঁচে থাকতে কেউ আমার সম্পর্কে কিছু লিখুক সেটা আমি চাই না। তবে আমার মৃত্যুর পর যে যত খুশি লিখুক, তাতে আমার কিছু যায় আসে না।’ তার সম্পর্কে লিখতে গিয়ে তার’ই আত্মীয় সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম লিখেন, ‘তার বিশাল পাণ্ডিত্যকে তিনি কাঁধে বা আস্তিনে বয়ে নিয়ে বেড়াতেন না, বস্তুত তিনি যে বহু ভাষাবিদ একজন মৌলিক চিন্তাবিদ ও লেখক- এ রকম উল্লেখও তাকে বিব্রত করত। তাকে আমার আপনভোলা মানুষ মনে হতো এবং খুব হাসিখুশি বাইরেরটার আড়ালে আত্মমগ্ন একজন মানুষ। আমার এ রকম একটি ধারণা হয়েছিল, তিনি নিজের মনে অনেক ধ্যান করতেন এবং তার ধ্যানের বিষয়বস্তু ছিল জগৎ, ক্লাসিক সাহিত্য আর জগতের সঙ্গে এ সাহিত্য এবং জগৎ ও সাহিত্যের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক। কথা বলতে বলতে অনেক সময় তিনি হঠাৎ প্রসঙ্গ বদলাতেন এবং বদলে এ রকম একটা দুটো বিষয়ের অবতারণা করতেন।’
অনেকটা জেদি ও আত্মপ্রচারবিমুখ এ লেখক বহু ভাষাবিদ একজন মৌলিক প্রতিভাধর ব্যক্তি হওয়া সত্ত্বেও আলোর পাদপ্রদীপে আসেন বেশ বিলম্বে। তিনি তার সৃষ্টিশীল জীবনে অনেক প্রবন্ধ, অসাধারণ কিছু ছোটগল্প, উপন্যাস ও ভ্রমণকাহিনি লিখেন। এসব লেখনী তাকে জনপ্রিয় করে তোলে। তবে তার প্রখর বুদ্ধিদীপ্ত উঁচুমানের হাস্যরসসমৃদ্ধ রম্যরচনা তাকে ‘রম্য লেখক’ হিসাবেই পাঠক নন্দিত করে তোলে।
সৈয়দ মুজতবা আলীর প্রথম রচনা ‘নেড়ে’ নামের গল্প। ১৯/২০ বছর বয়সে লিখিত এ গল্পটি বিশ্বভারতী দেয়াল পত্রিকায় ১৯২৩-২৪ সালে প্রকাশিত হয়। পরবর্তীতে এটি সংকলিত হয়ে ছাপার হরফে আসে ১৯৬৭ সালে ‘পছন্দসই’ শীর্ষক গ্রন্থে। তার প্রথম প্রকাশিত গ্রন্থ ‘দেশে বিদেশে’। আফগানিস্তানের বিচিত্র অভিজ্ঞতার আলোকে তিনি এ গ্রন্থটি রচনা করেন। ১৩৫৬ বঙ্গাব্দের বৈশাখে ‘নিউ এজ পাবলিশার্স’ বইটি প্রকাশ করলে তিনি লেখক হিসাবে পরিচিত হয়ে ওঠেন। জীবনের প্রথম বই রচনার পটভূমি জানতে গিয়ে তার জীবন সায়াহ্নে তার একান্ত সহচর গোলাম মোস্তাকিমকে জানান, বইটি তিনি তার বড় ভাই সৈয়দ মোস্তফা আলী সাহেবের বড় মেয়ে ‘জিন্নাতবাসিনী জাহানারার স্মরণে’ উৎসর্গ করেছিলেন এবং তার অনুপ্রেরণায় তিনি বইটি লিখতে উৎসাহী হন। এ প্রসঙ্গে মুজতবা আলী বলেন, ‘আমি জার্মানি থেকে ডক্টরেট করে দেশে ফেরার পর কিছুদিন কলকাতায় ও মৌলভীবাজারে বাবা-মায়ের সঙ্গে ছিলাম। তারপর আমি ডা. পণ্ডিত অজিত কুমার বসুর সঙ্গে ইউরোপ চলে যাই। ফেরার পথে কায়রোতে আরবি শেখার জন্য একবছর ছিলাম। আমি যখন ডক্টরেট করলাম তখন বাঙালি মুসলমানদের মধ্যে ডক্টরেটের সংখ্যা হাতে গোনা যেত। তাছাড়া আমি বেশ কয়েকটি বিদেশি ভাষা শিখেছিলাম। তখন আমি বিদেশি সাহিত্যই বেশি পড়তাম।’
অগাধ পাণ্ডিত্যের অধিকারী হওয়ায় অন্য লেখকের কোনো বইয়ে দুর্বলতা দেখলে তিনি অনেক সময় মন্তব্য করতেন। এ ধরনের মন্তব্য ভাতিজি জাহানারার সামনে করলে সে কী বলত তা মুজতবার মুখে শুনুন, তিনি গোলাম মুস্তাকিমকে আরও বলেছিলেন, জাহানারার সামনে কোনো বাংলা বই সম্পর্কে তাচ্ছিল্য মন্তব্য করলে পরে জাহানারা বলত, ‘ছোট চাচা যদি এতটা জানে তহলে নিজে একটা বই লিখলেই পারেন।’ ‘সাহিত্যের নানা প্রসঙ্গ নিয়ে তার (জাহানারার) সঙ্গে আমার আলাপ হতো। তার সঙ্গে তর্ক করে আমি কখনোই জিততে পারিনি।’... ... “১৯৪৬ সাল। আমি তখন ব্যাঙ্গালোরে। পকেটে পাঁচ হাজার টাকা। বুঝতেই পারছ, পাঁচ হাজার টাকা তখন অনেক টাকা ছিল। থাকতাম সমুদ্রের পাড়ের এক হোটেলে। হাতে অডেল সময়।... তখনই আমি ‘দেশে-বিদেশে’ বইটা লেখা শুরু করি। প্রায় বছরখানেকের মতো আমি ব্যাঙ্গালোরে ছিলাম। ওই এক বছরের মধ্যে আমি বইটা লেখা শেষ করি।... তবে আমার বলতে কোনো দ্বিধা কিংবা সংকোচ নেই যে, ‘দেশে-বিদেশে’ লেখার পেছনে জাহানারা আমাকে খুব প্রেরণা জুগিয়েছিল। আমি যখন ব্যাঙ্গালোরে সমুদ্রের পাড়ে হোটেলে বসে বইটা লিখছিলাম তখন আমার কানে একটা কথা প্রায়ই বাজত, ‘ছোট চাচা যদি এতকিছু জানে, তাহলে একটা বই লিখলেই পারেন।’ আমার মনের ভেতর একটা জিদ কাজ করছিল। কাজেই জাহানারা বেঁচে থাকলে বইটা লিখেই আমি দেশে ছুটে গিয়ে তাকে বলতাম, এই দেখ, আমি একটা বই লিখেছি। এবার তুই কী বলিস। কিন্তু জাহানারার অকাল মৃত্যু আমাকে সে সুযোগ দিল না।” (সৈয়দ মুজতবা আলী : প্রসঙ্গ অপ্রসঙ্গ-গোলাম মোস্তাকিম, স্টুডেন্ট ওয়েজ, ঢাকা। দ্বিতীয় মুদ্রণ, বৈশাখ ১৪০৯ বঙ্গাব্দ, পৃষ্ঠা-১১৪, ১১৫)। তারপর একে একে প্রকাশিত হয় তার বিভিন্ন গ্রন্থ।
সৈয়দ মুজতবা আলীর প্রকাশিত গ্রন্থের গ্রহণযোগ্যতা ও সময়ে সময়ে আজো বিশেষ মুদ্রণ জানিয়ে দেয়, সৈয়দ মুজতবা আলী নিঃশেষিত হওয়ার নন। তিনি যুগ যুগ ধরে জিইয়ে থাকবেন তার অমর সৃষ্টি ও লেখনীর পাঠ ও বিস্তৃতির মাধ্যমে।
অন্য অনেক সৃষ্টিশীল মানুষের মতোই সৈয়দ মুজতবা আলী মদ-সুরার কল্পলোকে থাকতেই বেশি পছন্দ করতেন, যা তার সৃষ্টিমগ্নতাকে ব্যাহত করত। এছাড়া লেখার ব্যাপারে ছিল তার এক ধরনের আলসেমি। তাকে কাছ থেকে দেখা তার ভাগ্নি আসমা আব্বাসী ‘সৈয়দ মুজতবা আলী : আমার মাতুল’ প্রবন্ধে লিখেন, ‘তার আপতগম্ভীর বাইরের মূর্তিকে ভয় না পেয়ে যিনি কাছে গেছেন, তিনিই জানেন কী অসামান্য খনির সন্ধান তিনি পেলেন।... পাণ্ডিত্য ও কৌতুক-এ দুয়ের গঙ্গা-যমুনা সংমিশ্রণ হয়েছিল তার মধ্যে। অথচ লেখার বেলায় তার ছিল এক ধরনের আলসেমি। যখন একা থাকতেন প্রায় অধিকাংশ সময় পড়ার মধ্যে ডুবে থাকতেন। তিনি নিজেই বলতেন, জানিস তো অর্থের খুব একটা প্রয়োজন না হলে আমি লিখি না।’ (দৈনিক প্রথম আলো-সাহিত্য সাময়িকী, ৪ মার্চ ২০০৫)। এ কারণে তিনি যথেষ্ট সৃষ্টিশীল ও অগাধ পাণ্ডিত্যের অধিকারী হয়েও মানব জীবন সম্পর্কে গভীর উপলব্ধিজাত অনেক কিছু আমাদের দিয়ে যেতে হয়তো সময় করে নিতে পারেননি, যা তার একান্ত কাছের মানুষের কাছেও মর্মপীড়াদায়ক বটে। কিন্তু তারপরও তার সাহিত্যে ব্যঙ্গ-রসিকতায় মানুষের প্রাত্যহিকতাকে তিনি যেভাবে সবাক করেছেন, পাণ্ডিত্যপূর্ণ বক্তব্যের প্রাসঙ্গিকতায় শব্দকে যেভাবে দাপটের সঙ্গে সাহিত্যে প্রবাহিত করেছেন, তা অতুলনীয়। এক্ষেত্রে তিনি কালজয়ী। সাহিত্যিক সৈয়দ আলী আহসানের কথায়, ‘বাংলা শব্দ ব্যবহারের বিচিত্র দ্যোতনায় মুজতবা আলী নিঃসন্দেহে এক অনন্য সমৃদ্ধমান ব্যক্তি।’ (সতত স্বাগত-সৈয়দ আলী আহসান, ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড, প্রথম প্রকাশ-আগস্ট ১৯৮৩ ইং, পৃষ্ঠা-১২০)।
বাংলাসাহিত্যের প্রথম সার্থক রম্য রচনাকার তথা রচনা-সাহিত্যিক সৈয়দ মুজতবা আলী ছিলেন একজন সৃজনশীল অনন্য সাধারণ লেখক। তার রচনায় বাকপটুতার সঙ্গে শিল্প সুষমার অপূর্ব সমন্বয় দীপ্তিমান, যা উঁচুমার্গের রসবোধে সিক্ত।
সৈয়দ মুজতবা আলীর রম্য রচনাগুলো নিছক আনন্দদানের জন্য লিখিত হয়নি। বহু দেশ ভ্রমণ, বিচিত্র শিক্ষাজীবন ও বর্ণময় পেশাজীবনের অবারিত অভিজ্ঞতাপ্রসূত অগাধ পাণ্ডিত্যের সুবাদে অর্জিত তাবৎ বিশ্বের ‘উইট-হিউমার’-এর উপস্থিতি তার রচনায় দৃষ্ট হয়, যা নিছক অর্থহীন বিষয় নয়। তার উইট ও হাস্যকৌতুকগুলো একটু অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে পড়লে বোঝা যায়, এর মাধ্যমে তিনি সমাজের বিভিন্ন অসঙ্গতি তুলে ধরে আমাদের অস্তিত্বের মর্মমূলে প্রবেশ করে আমাদের নতুন করে জাগাতে, ভাবাতে সচেষ্ট থেকেছেন। তার গল্প-উপন্যাসগুলো হৃদয়কে নাড়া দেয়, আর প্রবন্ধগুলো তথ্যরসে ভরপুর জ্ঞানসমৃদ্ধ। সুসাহিত্যিক আবদুস শাকুর এর মতে, ‘হাস্যরসের অফুরান এক ডেটা ব্যাংক মুজতবা, যেখানে পাঠক রসটির সব ভ্যারাইটিই মজুত পায়। তার কাছে আছে পরশুরামের প্রসন্ন হাস্যরস, বঙ্কিমচন্দ্রের বিষণ্ন হাস্যরস, তৈলোক্যনাথের হৃদয়বৃত্তি, প্রমথ চৌধুরীর বুদ্ধিবৃত্তি-আর কি চাই।’ তারপরও আবদুস শাকুর মুজতবার মাঝে দেখতে পেয়েছেন, ‘একজন মহৎ গদ্যশিল্পী এবং সর্বসূত্রে অবশ্যই অনুকরণীয় রচনাসাহিত্যিক’-এর প্রতিকৃতি, যিনি মতেইন প্রবর্তিত এবহৎব ‘এসে’ বা রচনাশৈলী নামের কালজয়ী ফর্মটির বাংলাভাষায় সর্বশেষ শ্রেষ্ঠতম রূপকার।’ (সৈয়দ মুজতবা আলী : অন্তরঙ্গ রচনা সাহিত্যিক-আবদুস শাকুর)। আসলে সৈয়দ মুজতবা আলী নিঃশেষিত হওয়ার নন। ১৯০৪ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর জন্ম নেওয়া মুজতবার জন্মের শতবর্ষ অনেক আগে পেরোলেও মৃত্যুপরবর্তী আজও তিনি জেগে উঠছেন নতুন ব্যঞ্জনায়। তিনি আজও আমাদের সামনে হাজির তার অনুপম সৃষ্টির পসরা নিয়ে। চিরঞ্জীব হোক মুজতবার সৃষ্টি।
