Logo
Logo
×

সাহিত্য সাময়িকী

আজ বারি ঝরে ঝরঝর ভরা বাদরে

Icon

ফজলুল হক সৈকত

প্রকাশ: ০২ আগস্ট ২০১৮, ০৬:০০ পিএম

প্রিন্ট সংস্করণ

‘এমন দিনে তারে বলা যায়/এমন ঘনঘোর বরিষায়’ : মৃণালিনী দেবীকে একবার রবিঠাকুর এক চিঠিতে লিখেছিলেন- ‘সমস্ত আকাশ অন্ধকার করে নিবিড় মেঘ জমে এসে বৃষ্টি আরম্ভ হল, নিচের ঘরের চারদিকের শার্সি বন্ধ করে এ বর্ষণদৃশ্য উপভোগ করতে করতে তোমাকে চিঠি লিখছি। তোমাদের সেখানকার দোতলার ঘরে থেকে এ রকম চমৎকার ব্যাপার দেখতে পেতে না। চারদিকের সবুজ ক্ষেতের ওপরে স্নিগ্ধ তিমিরাচ্ছন্ন নবীন বর্ষা ভারি সুন্দর লাগছে। বসে মেঘদূতের ওপর একটা প্রবন্ধ লিখছি। প্রবন্ধের ওপর আজকের এ নিবিড় বর্ষার দিনের বর্ষণমুখর ঘনান্ধকারটুকু যদি এঁকে রাখতে পারতুম, যদি আমার শিলাইদহের সবুজ ক্ষেতের উপরকার এ শ্যামল আবির্ভাবটিকে পাঠকদের কাছে চিরকালের জিনিস করে রাখতে পারতুম তাহলে কেমন হতো! আমার লেখায় অনেক রকম করে অনেক কথা বলছি- কিন্তু কোথায় এ মেঘের আয়োজন, এ শাখার আন্দোলন, এ অবিরল ধারাপ্রপাত, এ আকাশ পৃথিবীর মিলনালিঙ্গনের ছায়াবেষ্টন! কত সহজ! কী অনায়াসেই জলস্থল আকাশের ওপর এ নির্জন মাঠের নিভৃত বর্ষার দিনটি- এ কাজকর্ম ছাড়া মেঘে ঢাকা আষাঢ়ের রৌদ্রহীন মধ্যাহ্নটুকু ঘনিয়ে এসেছে। অথচ- আমার সেই লেখার মধ্যে তার কোনো চিহ্নই রাখতে পারলুম না।’- কবির এ বিনয়ী আক্ষেপটুকুকে মনে রেখেও বলা যায়, রবীন্দ্রনাথ প্রকৃতি বর্ণনায় ও ধারণে যে বিপুল অনুভব ও সাধনা বিনিয়োগ করেছেন, তার তুলনা বাংলাসাহিত্যে বিরল। প্রকৃতির রূপ-স্পর্শ বিবরণের কবি রবিঠাকুর। কী নাটকে কী কবিতায় কী গানে কী চিঠিপত্রে কী ছোটগল্পে কী উপন্যাসে- কোথায় রবির প্রকৃতির ছোঁয়া লাগেনি! ভরা বর্ষা, নদীর দুকূল, বিস্তর মাঠ, জলে ভেজা প্রকৃতির øিগ্ধতা তার লেখায় আছে বিপুলভাবে। প্রকৃতি আর মানুষের সম্পর্ক নিরূপণের চেষ্টা দেখি তার গানে। একবার রবিঠাকুর বলেছেন- ‘এসেছে বরষা, এসেছে নবীনা বরষা, গগন ভরিয়া এসেছে ভুবন ভরসা।’

আষাঢ় মানে বর্ষা। শ্রাবণ মানে বর্ষা। বর্ষা মানে অভিসার। আর অভিসার মানেই তো প্রেম- বিরহ-মিলন। আর এসব অনুভব, প্রত্যাশা আর না পাওয়ার কথা নিপুণ ছবির ফ্রেম রবিঠাকুর বেঁধেছেন তার বর্ষার গানে। বর্ষার আগমনী গানে তিনি লিখেছেন-‘ওই আসে ওই অতি ভৈরব হরষে/জলসিঞ্চিত ক্ষিতিসৌরভরসে/ ঘনগৌরবে নবযৌবনা বরষা/শ্যামসঙ্গীর সরসা।’, ‘আজ নবীন মেঘের সুর লেগেছে আমার মনে/আমার ভাবনা যত উতল হল অকারণে।’ বর্ষাকাল মনের চঞ্চলতা বাড়ায়। চিত্তকে অস্থির করে তোলে। প্রকৃতি যেন কথা বলতে থাকে মানুষের সঙ্গে। যেন চারদিকে ‘ওই মালতিলতা দোলে’। এ বাস্তবতার গান- ‘আমি কী গান গাব যে ভেবে না পাই-/মেঘলা আকাশে উতলা বাতাসে খুঁজে বেড়াই।’ গ্রীষ্মের তপ্ত বাতাসের পরে বর্ষার অঝোর ধারা জনমনে শ্রান্তি আনে। রবীন্দ্রনাথের গানে সে কথা পাই- ‘তপের তাপের বাঁধন কাটুক রসের বর্ষণে।/হৃদয় আমার, শ্যামল-বঁধুর করুণ স্পর্শ নে।’ বাদলাকে আহ্বান জানিয়েছেন এভাবে- ‘এসো হে এসো সজল ঘন বাদলবরিষণে-/বিপুল তব শ্যামল স্নেহে এসো হে এ জীবনে।’ বর্ষা যেন শরতে পদার্পণ না করে, সে-ই অনুনয়ও আছে কবির গানে- ‘শ্যামল শোভন শ্রাবণ, তুমি নাই বা গেলে/সজল বিলোল আঁচল মেলে।’

‘ঝরঝর বরিষে বারিধারা/ হায় পথবাসী, হায় গতিহীন, হায় গৃহহারা’ : বাঙালির বর্ষা-যাপনকে বহু বিচিত্র-প্রকাশে রবীন্দ্রনাথ অনিন্দ সৌন্দর্যে ফুটিয়ে তুলেছেন। তিনি চিরবিদায়ও নিয়েছেন তার প্রিয় এ ঋতুতেই। মানুষ বেঁচে থাকে এক অপার তৃষ্ণা নিয়ে। পিপাসা যেন মেটে না। বর্ষা হয়তো কখনও কখনও মানুষের সেই তপ্ত মনে মৃদু বাতাস বইয়ে দিয়ে যায়। কবি রবি তার একটি গানে সে কথা জানাচ্ছেন- ‘এসো এসো হে তৃষ্ণার জল, কলকল্ ছলছল্/ভেদ করো কঠিনের ক্রুর বক্ষতল কলকল্ ছলছল্॥/এসো এসো উৎসস্রোতে গূঢ় অন্ধকার হতে/এসো হে নির্মল কলকল্ ছলছল্॥’ বৃষ্টি যেমন পৃথিবীকে ধুয়ে-মুছে পরিষ্কার পবিত্র করে তোলে, তেমনি কবির ধারণা মানুষের মনেও তা এনে দেয় প্রশান্তি ও নির্মল আনন্দধারা। বর্ষাকাল কদম ফুল ফোটার সময়। রবীন্দ্রনাথের গানের কথায়- ‘বাদল দিনের প্রথম কদম ফুল করেছ দান/আমি দিতে এসেছি শ্রাবণের গান।’ বর্ষার এ সময়ে পুষ্প-বৃক্ষে, পত্র-পল্লবে, নতুন প্রাণের সঞ্চার করে সবকিছুর মধ্যে। কদম ফুলের øিগ্ধ ঘ্রাণ গ্রাম কিংবা নগরবাসী সবাইকে মুগ্ধ করে। ঋতু-বৈচিত্র্যের এ বাংলায় আষাঢ়কে বলা হয় ঋতুর রানী। রবীন্দ্রনাথের ভাষায়- ‘ঐ আসে ঐ ঘন গৌরবে নব যৌবন বরষা।’ বর্ষাকাল তার বৈশিষ্ট্যের কারণেই স্বতন্ত্র। বর্ষা কাব্যময়, প্রেমময়। রবীন্দ্রনাথের গানে এই বিপুল প্রেমধারা বয়ে চলেছে নিরন্তর। রবীন্দ্রনাথের গানে যে বিশেষ দুটি ধারা বর্তমান তার একটি গীতধর্মী আর অন্যটি কাব্যধর্মী। কবির ব্যক্তিগত দুর্বলতা ছিল গানে কাব্যাংশকে গুরুত্ব প্রদান করা। কাব্যময়তার ভেতরে কবি তার গানের কথা ও সুরে প্রাচীন হিন্দু ধর্মশাস্ত্র উপনিষদ, মধ্যযুগীয় বৈষ্ণব পদাবলি, বাউল গানের প্রবণতা আরোপ করেছেন। বাদল দিনে মানুষের মন উতলা থাকে। হারিয়ে যেতে চায় কোনো অজানায়। তখন মনে মনে কেউ হয়তো গেয়ে ওঠে- ‘আজি ঝরো ঝরো মুখর বাদল দিনে, জানি নে, জানি নে কিছুতে কেন যে মন লাগে না।’

‘নীল নবঘনে আষাঢ়গগনে তিল ঠাঁই আর নাহি রে।/ওগো, আজ তোরা যাস নে ঘরের বাহিরে’ : কী অপরূপ বর্ষাদিনের ছবি! এ গানটিতে যেন চোখের সামনে আঁকা হয়েছে এক জলছবি। চারদিক মেঘাচ্ছন্ন। আকাশের রব শোনা যায় ঘনঘন। বিদ্যুৎ চমকায়। মাঠ থেকে প্রবল শঙ্কায় গরু-ছাগল নিয়ে বাড়ি ফেরে রাখাল। মন যেন মেঘের সাথী। বর্ষায়-বাদলে রবিঠাকুরের মন যে কতটাই আবেগী উতলা হতো, তা আজ বিপুল বিস্ময় হয়ে জমে আছে বাঙালির প্রকৃতি-নিমগ্ন হৃদয়ে। ‘আষাঢ়সন্ধ্যা ঘনিয়ে এল, গেল রে দিন বয়ে/ বাঁধন-হারা বৃষ্টিধারা ঝরছে রয়ে রয়ে/একলা বসে ঘরের কোণে কী ভাবি যে গোপন মনে/সজল হাওয়ায় যূথীর বনে কী কথা যায় কয়ে।’ প্রকৃতির কোলে বারবার ঘুরে ফিরে আসে বর্ষা। ‘আবার এসেছে আষাঢ় আকাশ ছেয়ে,/আসে বৃষ্টির সুবাস বাতাস বেয়ে।’

‘আজ শ্রাবণের পূর্ণিমাতে কী এনেছিস বল্’ : রবিঠাকুরের ‘শেষ বর্ষণ’ গীতিনাট্যে রাজা নটরাজকে বলছেন- ‘শ্রাবণের পূর্ণিমায় পূর্ণতা কোথায়? ও তো বসন্তের পূর্ণিমা নয়’। তার উত্তরে নটরাজ বললেন- ‘মহারাজ, বসন্ত পূর্ণিমাই তো অপূর্ণ। তাতে চোখের জল নেই কেবলমাত্র হাসি। শ্রাবণের শুক্লরাতে হাসি বলছে আমার জিত, কান্না বলছে আমার। ফুল ফোটার সঙ্গে ফুল ঝরার মালাবদল। ওগো কলস্বরা, পূর্ণিমার ডালাটি খুলে দেখো, ও কী আনলে।- ‘আজ শ্রাবণের পূর্ণিমাতে কী এনেছিস বল?’- এই গানটিতে আছে বর্ষামঙ্গলের কথা। কবির অনুভূতি এমন- ‘গঙ্গাজলেই নাহয় গঙ্গা পুজো সেরে বলি কী আনিনি আমরা এই শ্রাবণী পূর্ণিমাতে? ফুল ফোটার হাসি, ফুল ঝরার কান্না, বিরহ-মিলন, বাদল হাওয়া, এসবের সঙ্গে বর্ষাঋতুর অন্তিম লগ্নে, বর্ষণস্নাত সবুজ ও সজীব এনেছি। ফল এনেছি কত রকমের। আদিগন্ত ফুলের সৌরভ ছড়িয়েছি। দিকে দিকে বৃক্ষরোপণ করেছি। বন-মহোৎসবের বার্তা ছড়িয়েছি প্রকৃতির আনাচে-কানাচে।’ অন্য একটি গানে তিনি লিখেছেন- ‘আজ-শ্রাবণের সজল ছায়ায় বিরহ মিলন।’- এ-ও এক অদ্ভুত মিলন আমাদের। শ্রাবণ আসে, শ্রাবণ যায়। রেখে যায় অবিরল প্রেমসুধা আর হারানোর কষ্টমাখা মৃদুস্বর। ‘শাওন গগনে ঘোর ঘনঘটা, নিশীথযামিনীরে/... পথতাপ লুণ্ঠিত, থরথর কম্পিত দেহ।’ হারানো দিনের ছায়া দেখতে পান কবি শ্রাবণধারায়। সুখ আর দুখে নিবিড় সেসব দিন তাকে কাতর করে। ‘আমার যে দিন ভেসে গেছে চোখের জলে/ তারি ছায়া পড়েছে শ্রাবণগগনতলে।’ বৃষ্টির মধ্যে এক ধরনের নেশা অনুভব করেছেন রবীন্দ্রনাথ। এমন মাতাল-করা সময়ে তিনি টের পান মানব-সভ্যতার এক চরম সত্যের- ‘যা না চাইবার তাই আজি চাই গো/ যা না পাইবার তাই কোথা পাই গো।’- এই অসম্ভব-কল্পনায় মাথা কুটে মরেন তিনি ভরা বর্ষায়। বর্ষারাতে কূলকিনারাহীন অসীম মায়ালোকে যেন আনমনে চেয়ে থাকেন অবিরাম। ‘এ ঘোর শ্রাবণ-নিশি কাটে কেমনে।’ শ্রাবণ যেন সত্যি সত্যি বৃথা আশ্বাসে দুখ-রজনীর সাথী- ‘আজি বরিষণমুখরিত শ্রাবণরাতি/স্মৃতিবেদনার মালা একেলা গাঁথি।’ মিলন-বাসনার আকুলতাভরা শ্রাবণসন্ধ্যা ও রাতকে রবিঠাকুর তার গানে স্থান দিয়েছেন প্রকৃতির রূপ ও রস মাখিয়ে। যেমন একটা গানের কথা এরকম- ‘যায় দিন, শ্রাবণদিন যায়/ আঁধারিল মন মোর আশঙ্কায়,/মিলনের বৃথা প্রত্যাশায় মায়াবিনী এই সন্ধ্যা চলিছে॥/ আসন্ন নির্জন রাতি, হায়, মম পথ-চাওয়া রাতি। ব্যাকুলিছে শূন্যেরে কোন প্রশ্নে ॥’

‘হেরিয়া শ্যামল ঘন নীল গগনে/সেই সজল কাজল আঁখি পড়িল মনে’ : ‘মেঘের পরে মেঘ জমেছে আঁধার করে আসে/আমায় কেন বসিয়ে রাখ একা দ্বারের পাশে।’ কিংবা ‘এসো শ্যামল সুন্দর/আনো তব তাপহারা তৃষাহারা সঙ্গসুধা/বিরহিনী চাহিয়া আছে আকাশে।’ অথবা, ‘আমার দিন ফুরালো ব্যাকুল বাদল সাঁঝে/গহন মেঘের নিবিড় ধারার মাঝে/বনের ছায়ায় জলছলছল সুরে/ হৃদয় আমার কানায় কানায় পুরে।’- এসব গানে বিরহ-ব্যাকুল মনের প্রতিচ্ছায়া আছে। বর্ষার গভীর গোপনকালে প্রিয়জনের সান্নিধ্য, তার আঁচলের নীলিমা, পায়ের নূপুরের ছন্দ, আকাশে মেঘের ছন্দময় ওড়াউড়ি কবির কানে-চোখে-মনে মাতাল তরঙ্গ তোলে। তখন তিনি লেখেন- ‘মোর ভাবনারে কী হাওয়ায় মাতালো,/দোলে মন দোলে অকারণ হরষে/ হৃদয়গগনে সজল ঘন নবীন মেঘে/ রসের ধারা বরষে।’ তাই, বর্ষাকে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন- ‘তৃষ্ণার শান্তি, সুন্দরকান্তি’। বাঙালির চিরচেনা ঋতুচক্রে ভাদ্র মাস এলে সমাপ্তি হয় বর্ষার। শরতের অপার স্নিগ্ধতার দিকে তখন প্রকৃতির নতুন অভিযাত্রা। রবীন্দ্রনাথের গানে বর্ষার এই বিদায়-ঘণ্টা বাজে এভাবে- ‘বাদল-ধারা হল সারা, বাজে বিদায়-সুর/গানের পালা শেষ করে দে রে, যাবি অনেক দূর।’

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম