গ্রাফিক নভেল
আমার দেখা নয়া চীন
আসিফ কবীর
প্রকাশ: ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
বাংলাভাষায় কমিকস-এর জনপ্রিয়তা সুবিদিত। দেশ পত্রিকায় সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ‘অরণ্যদেব’ কমিকস লিখতেন, খুবই হৃদয়গ্রাহী ঢং-এ। রুশ বিপ্লবের ঘটনাবলি ও সাম্যবাদী আদর্শ প্রগতি প্রকাশনীর কমিকস বইয়ের পাতায় পাতায় আগ্রহ উদ্দীপক ও আটপৌরে ঘরানায় ছড়িয়ে দেওয়া হতো। ইসলামি ফাউন্ডেশন মুসলিম মনীষী, শাসক, বীর যোদ্ধা, বিপ্লবী কিংবা ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্বের জীবনী গ্রন্থনা করে কমিকসের আদলে প্রকাশ করত। রঙিন ইলাস্ট্রেশন আর তুখোড় সংলাপ পাঠকের মনে অনুরণন তুলত। আরও নানা রকম জনপ্রিয় বাংলা কমিকস সিরিজ রয়েছে। সেসব সিরিজের পুরাতন বই আজও আসক্ত পাঠক নিলামে চড়া মূল্যে কিনে নেন। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের লেখা বই-এর কমিকস বা গ্রাফিক নোবেল ভার্সন প্রকাশ সেই বিবেচনায় খুবই মোক্ষম উদ্যোগ। আমার দেখা নয়া চীন গ্রন্থের গ্রাফিক নোবেল এবারের বইমেলায় প্রকাশিত হয়েছে। বইয়ের উপস্থাপনাটি সহজবোধ্য; পাঠাগ্রহী ও চিত্তাকর্ষকভাবে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত করা হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর দৌহিত্র রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক এর প্রকাশক। গ্রাফিক নভেল চিত্ররূপ সব্যসাচী মিস্ত্রির করা। কাহিনি বিন্যাস ও সংলাপ সিদ্দিক আহমেদের। বিনিময় মূল্য ৪৯০ টাকা। সম্পূর্ণ বইটি চাররঙা ছাপা, আকার এ ফাইভ, পেপার ব্যাক মলাট। প্রকাশ করেছে সেন্টার ফর রিসার্চ অ্যান্ড ইনফরমেশন।
জাতির পিতা ১৯৫২ সালে শান্তি সম্মেলনে যোগ দিতে কমিউনিস্ট পার্টির আমন্ত্রণে চীন সফরে যান। সফরকালীন নোট থেকে ১৯৫৪ সালে তা লিপিবদ্ধ করেন। ৬৫ বছর পর গ্রন্থাকারে চীন ভ্রমণের বৃন্তান্তটি প্রকাশিত হয়। এ সময়ের বিশ্ব বাস্তবতা যদি আমলে নেওয়া হয়, দেখা যায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সমাপ্তির এক দশকও অতিক্রান্ত হয়নি তখনো। যুদ্ধের ক্ষত ও বিপর্যয়ে তখনো ভুগছে দেশগুলো। ভারত ও পাকিস্তান সদ্য স্বাধীন হয়েছে। উপমহাদেশ ছাড়াও ব্রিটিশ শাসনের অবসান হয়েছে দেশে দেশে। চীনের সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের তিন বছর অতিবাহিত হয়েছে। ভারত-চীন সম্পর্কও সে মুহূর্তে তুঙ্গে। যারই ধারাবাহিকতায় সফরের মাত্র দুবছর বাদে স্লোগান উঠেছে ‘হিন্দি-চিনি ভাই ভাই’। ১৯৫৪-১৯৫৯ পর্যন্ত অনন্য উষ্ণতায় চলেছে দুই দেশের সম্পর্ক। যা আজকের দিনে বিস্ময় জাগায়। আজকের মতো তথ্য প্রবাহও ছিল না। সমাজতান্ত্রিক বিশ্বের ব্যাপারে কিছুই জানা সম্ভব হতো না।
তেমনি বাস্তবতায় চীন সফরকালে অনুসন্ধিৎসু মন নিয়ে জাতির পিতা সমাজতন্ত্রের অন্দর মহল চাক্ষুষ করতে চেয়েছেন। সমাজতন্ত্রের সাফল্যের মূলমন্ত্র অনুসন্ধান ও যাচাই করে নিতে চেয়েছেন। সমাজতান্ত্রিক চীনের শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, লাইব্রেরি, মিউজিয়াম, শিল্প, কৃষি, বাজারব্যবস্থা ... পর্যবেক্ষকের গভীর দৃষ্টিতে অবলোকন করেছেন। নারীর ক্ষমতায়ন, শিল্প প্রতিষ্ঠানের মালিকানা ব্যবস্থা, শাস্তি প্রদান ও অনুসৃত কঠোর নীতির আলোকপাত করতে পেরেছেন তার নিবিড় বীক্ষণের জন্যই। সমাজতন্ত্র তথা লাল বিপ্লবের মাত্র তিন বছর পরই তার সুদূর গ্রথিত দৃষ্টিতে দেখা চীনের বিবরণীর নামকরণ ‘আমার দেখা নয়া চীন’ তাই সর্বাংশে সার্থক।
গ্রাফিক নভেলটির ইলাস্ট্রেশন সুন্দর, চমৎকার ছাপা, রঙের ব্যবহার মসৃণ, সংলাপগুলোর জমিনে ভিন্ন রং ব্যবহার করায় পরম্পরা বোঝায় সহায়ক। আজকাল মেসেনজার বা হোয়াটস্ অ্যাপে কথোপকথনে যেমন প্রেরক ও প্রাপকের বার্তায় ব্যাকগ্রাউন্ডের রং দুরকম এ গ্রন্থও তেমনটিই দেখা যায়। সংলাপের বাইরে বিবরণীগুলো আলাদা উপস্থাপন করা হয়েছে, সূত্রধরের বক্তব্যের কায়দায়। জাতির পিতার সংলাপ ও বিষয়ের বর্ণনা বা আনুপূর্বিক বিবরণের পরিস্ফুটন ঘটেছে হালকা মিষ্টি খড় বা স্ট্র রঙে। একদমই বানান ভুল মুক্ত। কিছুটা সংক্ষেপণ হলেও মূল গ্রন্থের বিবরণী থেকে অবিকৃত। বইয়ের ভূমিকায় সামগ্রিক একটি নির্যাস পাওয়া যায়। সুলিখিত ভূমিকা থেকে চীন সফর, প্রেক্ষিত ও আলোকপাতের বিষয়গুলোর ধারণা মিলবে। ভূমিকা পাঠ করে মূল গ্রাফিক নভেল পাঠ করলে তাই আরও হৃদয়গ্রাহী হয়। ভূমিকায় ‘তখন তখনই’-এর মতো সহজবোধ্য শব্দ ব্যবহার হয়েছে, তৎসম তাৎক্ষণিক-এর পরিবর্তে। বইয়ের অধিকাংশ বর্ণনাক্রম ওপর থেকে নিচে অগ্রসরমাণ হয়েছে। বর্ণনার সুবিধার্থে কিছু বিবরণী দুই পৃষ্ঠাব্যাপী। এ দুপৃষ্ঠাব্যাপী বর্ণনাক্রম প্রথম চোখে পড়ে ১২ ও ১৩ পৃষ্ঠায়। এক্ষেত্রে কাহিনি বিবরণী ওপর থেকে নিচে নয় বরং বাম থেকে ডানে এগিয়েছে। বইয়ের এটিই প্রথম দুই পৃষ্ঠাজুড়ে বর্ণনা হওয়ায় পাঠকের একটু ধাক্কা খেতে হতে পারে। এমনকি পরম্পরা বোঝার জন্য একাধিকবার পাঠের প্রয়োজনও পড়ে। অবশ্য পরবর্তীর দুই পৃষ্ঠা ব্যপ্ত বর্ণনায় এ অসুবিধাবোধ মিটে যায়।
জাতির পিতার অসমাপ্ত আত্মজীবনী গ্রন্থে চীন সফরের উল্লেখ আছে। এ সফরের গ্রাফিক বিবরণীতে আমরা তাকে শিশুদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে তাদের আনন্দ দিতে ‘ভেংচি’ কাটতে দেখি। টোস করে বিলেতি কায়দায় সম্ভাষণ প্রকাশে দেখি। চীনা ভাষায় তাদের সম্ভাষণের জবাব দিতেও দেখি। তার সৌজন্য পরায়ণতা ও বিনয়বোধ আমাদের মুগ্ধ করে। সফর সঙ্গীদের সঙ্গে খুনসুটিও বাদ যায় না। তিনি সাধারণ মানুষের সঙ্গে কথাবার্তা বলে রেড আর্মি নিয়ে তাদের অভিজ্ঞতা, জীবনমান নিয়ে ভাবনা, সরকারের অনুসৃত নীতি নিয়ে মূল্যায়ন, জাতিগত চরিত্রের ধারণা নেন। লোক ঠকানোর প্রবণতা একদম না থাকার প্রশংসা করেন।
পাকিস্তানি শাসকদের বিরোধীদলীয় নেতাদের পাসপোর্ট প্রদানে গড়িমসি দিয়ে গল্প শুরু হয়। তবু বিদেশের মাটিতে নিজ দেশের সরকারের বিমাতাসুলভ আচরণ নিয়ে স্বভাব বিরুদ্ধভাবে নিশ্চুপ থাকেন দেশের সম্মান চিন্তায়। বঙ্গবন্ধু অবাক হয়েছেন যখন জানতে পারেন চীন দেশেও দুই রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের মধ্যে আত্মীয়তা আছে। তিনি শান্তি সম্মেলনে পৃথিবীর নানা প্রান্তের মজলুম জাতির বেদনা ধ্বনিত হতে শোনেন। শোষিতের পরম বন্ধু হিসাবে এসব বয়ান তাকে স্পর্শ করে। এ সম্মেলনে তিনি বাংলায় বক্তব্য রাখেন। চীনের আমদানিনির্ভরতা পরিহার, কর্মসংস্থান তৈরি ও ভিক্ষাবৃত্তিতে নিরুৎসাহিত করা, ১ অক্টোবর স্বাধীনতা দিবসের সমাবেশে উপস্থিতি নিয়ে সংবাদপত্রের সত্য ভাষণ, ধর্ম পালনে বাধা প্রদান না করা, নাগরিকদের দেশপ্রেম প্রভৃতি বঙ্গবন্ধুর কাছে খুবই সমাদৃত মনে হয়েছে। নয়া চীনে তার ভালো লেগেছে কী প্রশ্নের জবাবে বলেছেন: লাঙ্গল যার জমি তার নীতিটি। দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে থাকার ব্যাপারটিও। ... সবচেয়ে ভালো লেগেছে ছেলেমেয়ে সবাই সমান এটা।
চীনের নদী ও বাদাম তোলা নৌকা দেখে ‘পূর্ববাংলার’ কথা মনে পড়ে যায় জাতির পিতার। দেশের ভাবনায় বুকে ‘মোচড় দেয়’। দেশ মাতৃকার সঙ্গে তার যে নিগূঢ় বন্ধন সেটি এ কথায় বেশ বোঝা যায়। ‘আমি পাকা মাঝি। দাঁড় টানতে, লগি বইতে, হাল ধরতে সবই জানি।’-এমন কথা বলেছেন হ্যাংচো’র নদীতে নৌকা প্রতিযোগিতায় পারঙ্গমতা দেখানো প্রসঙ্গে। আজ বহু বছর পরও বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ তার নির্বাচনি প্রচারণায় ‘জিতবে এবার নৌকা’ দক্ষ হাতে দাঁড় টানা থেকেই উৎসারিত। সে হিসাবে নৌকা চালনায় বঙ্গবন্ধুর যে পারদর্শিতা চিত্রিত হয়েছে তার আবেদন ধ্রুপদি। ভ্রমণ কাহিনি ছাপিয়ে এটি বঙ্গবন্ধু শেখ মুুজিবুর রহমান লিখিত এমন একটি বিবরণী যা সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবোত্তর চীনকে আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিকভাবে জানতে সহায়ক। গ্রাফিক নভেল আকারে প্রকাশিত হওয়ায় বিরল পাঠ্যাভ্যাসের এ সময়ে পাঠাগ্রহী এবং শেষ অবধি মনোযোগ ধরে রাখা অনায়াস করেছে।
