Logo
Logo
×

সাহিত্য সাময়িকী

চেতনালোকে ফুলের নান্দনিকতা

Icon

বিপিন বিশ্বাস

প্রকাশ: ২৩ আগস্ট ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি হলো সুন্দরের প্রতি আকৃষ্ট হওয়া। তবে এটাও সত্য যে, কেউ কোনো বস্তুতে আকৃষ্ট হলেও অন্য কেউ অনুরূপ বস্তুতে আকৃষ্ট নাও হতে পারে। কিন্তু একটি বিষয়ে সবার মধ্যেই সমান আসক্তি দেখা যায় তা হলো- ফুলের প্রতি মানুষের আগ্রহ। তাই আমরা বিশেষ দিন ও মুহূর্তকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য, কারো প্রতি নিজের আবেগ ভালোবাসাকে প্রকাশ করার জন্য ফুল উপহার দিই। ফুলের সৌন্দর্য উপভোগের জন্য দূর-দূরান্তে ছুটে যাই। ফুল হাতে পেয়ে আমরা আনন্দিত হই। ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করি। এ থেকে একটি বিষয় সুস্পষ্ট যে, ফুলের নিজের একটি সৌন্দর্যগুণ রয়েছে। যা মানুষকে আকৃষ্ট করে। মানুষ ফুল পছন্দ করে বলেই ফুলের বাগান করে, বাড়ির আঙিনায়, ফ্ল্যাটের বারান্দায় ফুলের টব শোভা পায়। বিভিন্ন প্রজাতির ফুলের গাছ সংগ্রহ করে। কিছু কিছু ফুল আছে বাহ্যিক সৌন্দর্য ছাড়াও ফুলের সুগন্ধি আছে। সেসব ফুলের প্রতি মানুষের আগ্রহটা আরও একটু বেশি থাকে। তাই হাসনাহেনা, চন্দ্র মল্লিকা, কামিনী, সুমিষ্ট গন্ধের জন্য শিউলি কে আমরা পছন্দ করি।

ফুলের সৌন্দর্য আমাদের নানাভাবেই প্রলুব্ধ ও আসক্ত করতে পারে। শাপলা ও পদ্ম ফুলের সৌন্দর্য নদী, খাল, বিল, পুকুরে যেভাবে আমাদের চোখে ধরা পড়ে ও ভালো লাগে সে ফুলগুলো বাড়ির কোনো কক্ষে সাজিয়ে রাখতে ততটা ভালো লাগে না। অর্থাৎ ফুলের সৌন্দর্য উপভোগ করার জন্য প্রকৃতিও একটি অনুসঙ্গ। যে ফুলের যেখানে জন্ম যেখানে বেড়ে ওঠা সেই ফুলটিকে সেখানে দেখতে বেশি ভালো লাগে। ফুলের সৌন্দর্য উপলব্ধি করার জন্য ফুল গাছের স্থান, তার চারপাশকে ঘিরে গড়ে ওঠা পরিবেশ নিয়ে যে আবহ বা বাস্তুসংস্থা তৈরি হয় তা মানুষকে আকৃষ্ট করে। এ থেকে বোঝা যায় ফুলের সৌন্দর্য দেখার জন্য সঠিক পরিবেশটাও অপরিহার্য।

ফুল মানুষের মনের মধ্যে এক ধরনের আবেগ ও অনুভূতি তৈরি করে। তাই সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে বিভিন্ন বয়স ও শিল্প গুণসম্পন্ন মানুষ নদী খাল বিলে শাপলা ও পদ্ম ফুলের সৌন্দর্য দেখতে যায়। ছবি ওঠায়। ফেসবুকে ইউটিউবে সেই ছবি ও ভিডিও শেয়ার করে। এজন্যই কবি বলেছেন, বন্যেরা বনে সুন্দর, শিশুরা মাতৃক্রোড়ে। বন্য প্রাণী ও পাখিকে বনে মুক্ত দেখে আমরা যতটা আনন্দিত হই, সৌন্দর্য খুঁজে পাই, যতটা ভালোলাগা কাজ করে তা কিন্তু সেসব বন্যপ্রাণীকে আবদ্ধ করে ঘরের কোনায় রেখে দিলে পাওয়া যায় না। তাই বনফুল বনে থাকলে যতটা সৌন্দর্য ছড়ায় ঘরের কোণে রেখে দিলে কিছুটা হলেও কম সুন্দর্য অনুভূত হয়। এরপরও কিন্তু আমরা ঘরের সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য, নিজের আবেগ অনুভূতিকে সম্মান দিয়ে ফুলদানিতে ফুল রাখি।

ফুল সুন্দর বলেই আমরা তাকে কাছে পেতে চাই। এজন্য দৈনন্দিন জীবনে আমরা ঘরের ফুলদানি, ড্রয়িং রুম, পড়ার টেবিল, অফিস কক্ষ ফুল দিয়ে সাজাই। কেউ কেউ বাড়ির আঙিনায় বিভিন্ন ধরনের ফুলের গাছ লাগান তার সৌন্দর্য পাওয়ার জন্য। শহরের মানুষ ফ্ল্যাটের বারান্দায় ফুলগাছের টব ঝুলিয়ে রাখে। এর মাধ্যমে ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব যেমন প্রকাশ পায় তেমনি ফুলের সৌন্দর্য অন্য মানুষকে আকৃষ্ট করে। ফুলের সৌন্দর্য ও উৎকৃষ্টতা মানুষকে সময় যাপনের পথরেখা দেখায়।

যারা গান ও ফুল পছন্দ করে না, তারা মানুষ হত্যা করতে ভয় পায় না। অর্থাৎ ফুলের সৌন্দর্য ও ফুলের গুরুত্ব এ থেকেও পরিমেয়। ফুলের সৌন্দর্য মানুষকে এতটাই মোহগ্রস্ত করেছে যে, নারী চুলের খোঁপায় ফুল পরে। নববর্ষে, উৎসবের দিনগুলোতে মাথায় ফুলের চাকতি পরে। গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানে কনেকে ফুল দিয়ে সাজায়। আর এসব কিছু করা হয় এ কারণেই যে, ফুলের আলাদা একটি সৌন্দর্য ও নান্দনিকতা রয়েছে। ফুলের সৌন্দর্য মানুষকে আরও সুন্দর করে তোলে। মানুষ নিজেরও একটি সৌন্দর্য আছে। দুই সৌন্দর্য মিলে একাকার হয়ে যায়। আমাদের মনের মধ্যে যখন হর-গৌরি, রাধাকৃষ্ণের ছবি ভেসে ওঠে তখন গভীর আত্মপ্রেমের মধ্যেও পরম শুদ্ধতা ও সৌন্দর্য খুঁজে পাই।

কেউ জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হলে তাকে ফুলের মালা দিয়ে বরণ করে নেওয়া হয়। হিন্দুসহ বিভিন্ন ক্ষুদ্র জাতিসত্তার মধ্যে বিয়ের সময় ফুলের মালা পরে বিয়ে করতে হয়। এ বিষয়ে পৌরাণিক কাহিনি থেকে জানা যায়, মানুষ তার ভালোবাসা-আবেগকে প্রকাশ করার জন্য ফুলকেই বেছে নিয়েছে। মানুষের আদি নিবাস প্রকৃতি। পাহাড়, পর্বত, অরণ্যে, নদীর তীরে মানুষ বেড়ে উঠেছে। সে সময় নিজের ভেতরের সৌন্দর্যকে বাইরের সৌন্দর্য দিয়ে বরণ করে নেওয়ার জন্য মানুষ ফুলকে বেছে নিয়েছে।

ভালোবাসা ও বন্ধনের প্রতীক হিসেবে ফুলের মালা বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হওয়া নারী পুরুষের মধ্যে একের প্রতি অপরের ভালোবাসা ও অনন্য অনুভূতির প্রকাশ পায়। ফুল প্রকৃতির এমন এক সৃষ্টি যা দেব-দেবীকে তুষ্ট করার জন্য ভক্তরা, পূজারিরা প্রতিদিন পূজার উপাচার হিসাবে ব্যবহার করেন। ফুল পবিত্রতার প্রতীক। এজন্য পরম ঈশ্বরকে তুষ্ট করার জন্য, খুশি করার জন্য ফুল দিয়ে শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন করা হয়।

ফুলের নান্দনিকতার জন্যই বিশ্বব্যাপী বাণিজ্যিকভাবে ফুল উৎপাদন করা হয়। আমাদের দেশে যশোরের গদখালিতে ফুল চাষ হচ্ছে। সারা দেশে ফুলের সৌন্দর্য ও সৌরভ ছড়িয়ে দিচ্ছে গদখালি। সারা বছর সারা দেশে ফুলের চাহিদা আছে। কারণ মানুষ ফুল পছন্দ করে। ফুল কেনে। ফুলের প্রতি মানুষের এ ভালোবাসা কখনো শেষ হবে না। এছাড়া ফুলের সৌন্দর্যের কারণে গরিব-দুঃখী, ধর্মবর্ণ সবার মধ্যেই ফুলের আলাদা একটি গ্রহণযোগ্যতা আছে। সবাই ফুল পছন্দ করে।

ফুলের সৌন্দর্য ও সুগন্ধি কবি সাহিত্যিকদের এতটাই আকৃষ্ট করে যে, কবি সাহিত্যিকরা তাদের কবিতা, গল্প ও উপন্যাসে নানাভাবে ব্যবহার করে। গানের লিরিক্স এ ফুলের উপমাকে ব্যবহার করে। ফুলের প্রতি মানুষের ভালোবাসা, আস্থা, আগ্রহ চিরায়ত এক সত্য। মানুষের চেতনালোকে সৌন্দর্য সৃজনে ফুলের ভূমিকা অনস্বীকার্য। যে মানুষ যত সৌন্দর্যালোকে বড় হয়, বেড়ে ওঠে, তার মধ্যে বিকাশ ঘটে শুদ্ধ চিন্তার ও সুশ্রী অনুভূতির।

কেউকেনহোফ নেদারল্যান্ডসের লিসির শহরে অবস্থিত বিশ্বের সবচেয়ে বৃহৎ টিউলিপ বাগান। বসন্তকালে এর বিশাল জায়গাজুড়ে বিভিন্ন ধরনের কয়েক লাখ টিউলিপ ফুলের চারা লাগানো হয়। ফুলের বাগান সত্যিই এক মনোমুগ্ধকর দৃশ্য। সে বাগানে হেঁটে বেড়ালেও মনের মধ্যে আনন্দ অনুভব হয়। ফুলের সৌন্দর্য মানুষকে এতটাই মোহগ্রস্ত করে যে, বিভিন্ন দেশ থেকে পর্যটকরা এ সময় বেড়াতে যান। অর্থাৎ ফুলের সৌন্দর্য এতটাই শক্তিশালী একটা উপকরণ যে, পৃথিবীর নানা প্রান্ত থেকে মানুষ ফুলের সৌন্দর্য উপভোগের জন্য ছুটে আসে। ফুলের স্নিগ্ধ ও নির্মল রূপ দেখে পর্যটকরা অভিভূত হয়। দীর্ঘ সময় ফুলের বাগানের কাছাকাছি যাপিতজীবন অতিবাহিত করে আবার বাড়িতে ফিরে যায়। সৌন্দর্য মানুষকে ঘরের বাইরে বের করে নিয়ে আসে।

নন্দনতত্ত্ব হচ্ছে মানুষের চেতনার সুগভীর অনুভূতি। আর এ অনুভূতি বিকশিত হয় সুন্দরকে উপলব্ধির মধ্য দিয়ে, দেখার মধ্য দিয়ে এবং সুন্দরের সঙ্গে যাপনের মধ্য দিয়ে। তাই মানুষ কষ্ট স্বীকার করে হলেও সুন্দরের কাছে থাকতে চায়, সুন্দরকে দেখতে চায়, সুন্দরের ভেতর অবগাহন করতে চায়। ফুল নান্দনিক অনুভূতি সৃজনে অনন্য ভূমিকা রাখে। মানুষের বেঁচে থাকার পরম অর্থ হচ্ছে-সুন্দরের প্রতি আকর্ষণ। সৌন্দর্য মাঙ্গলিক চিন্তা ও প্রশান্তির আনন্দ উপলব্ধিতে সরাসরি ভূমিকা রাখে। এক্ষেত্রে ফুলের সৌন্দর্যের জন্য ফুলের ভূমিকা অগ্রগণ্য। তাই আমরা ফুলকে ভালোবাসি। ফুল আমাদের চেতনালোকে প্রশান্তির প্রচ্ছায়ার মতো লেগে আছে। প্রকৃতির অনন্য সৃষ্টি ফুল। মানুষ তার নিজের মধ্যে সৃজনশীল কর্মকাণ্ডকে তখনই উপলব্ধি করতে পারে যখন ফুলকে উপলব্ধি করার অনুভূতি জন্মে। আমাদের মধ্যে হৃদয়ের আঙিনাজুড়ে প্রকৃতি ও ফুলের সৌন্দর্য সতত স্রোতস্বিনী নদীর মতো প্রবাহিত হয়। এজন্য আমরা সৌন্দর্যাভিমুখী।

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম