অল্প জীবন, একরাশ সৌন্দর্য
অপূর্ব চৌধুরী
প্রকাশ: ২৩ আগস্ট ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
জীবন সংক্ষিপ্ত, বিশেষ করে মানুষের জীবন। ব্যক্তি ব্যক্তিতে নয়, প্রাণিকুলের তুলনায় ছোট সে জীবন। এ সার্বজনীন সত্যটি আমরা সবাই জানি। কিন্তু আমরা ভুলেও যাই অনেক সময়। আমাদের দৈনন্দিন রুটিন, আমাদের উদ্বেগ, আমাদের অভিযোগ, বিভিন্ন দ্বন্দ্বের মধ্যে আমরা এতটাই জড়িয়ে পড়ি, জীবনের এ বড় চিত্রটি হারিয়ে ফেলি তখন। আবার এটাও সত্য, সাদাসিধে জীবন শুনতে আকর্ষণীয়, কিন্তু তার প্র্যাকটিস বেশ কঠিন।
আমরা আমাদের ভালো মুহূর্তগুলোর প্রশংসা করতে ভুলে যাই। আমরা যে মানুষগুলোকে ভালোবাসি, আমরা যে সুযোগগুলো জীবনে পাই, আমরা যে বিস্ময়ের সাক্ষী হয়ে থাকি, আমরা সে সময়টির কথা ভুলে যাই। আমরা ভুলে যাই যে-আমরা এখানে চিরকাল নেই। আমাদের চিহ্ন তৈরি করার, আমাদের স্বপ্নপূরণ করার, আমাদের অস্তিত্ব উপভোগ করার জন্য আমাদের জীবনে থাকে সীমিত সময়।
চাহিদা কমিয়ে অল্পে তুষ্ট থেকে জীবনযাপন করা শুনতে ভালো লাগে যত, তারচেয়ে নিজেদের চাওয়া-পাওয়ার দ্বন্দ্ব আরও বেশি দৌড়ে আসে তত।
সন্তুষ্টির বৃত্ত ছোট করে নিলে ভালোলাগার চিত্ত বড় হয়ে ওঠে।
আধুনিক জীবনের একটি অন্যতম দেওয়াল এ দ্বন্দ্ব। দ্বন্দ্ব কেউ চায় না, দ্বন্দ্বটা জেগে উঠে। ভুল কেন্দ্র ভুল পরিধিতে নিয়ে যায় ঠেলে।
মানুষ প্রতিনিয়ত দরকারির চেয়ে চাওয়ার প্রতি বেশি ছুটে। সময়ের স্লোগান-প্রয়োজনের চেয়ে চাওয়া বেশি। চাওয়ার পারদ যত উজ্জ্বল হতে থাকে, পাওয়ার গরদ তত মলিন হতে থাকে।
বর্তমানে মানুষের গড় আয়ু ধরা হয় প্রায় ৭৯ বছর। এটি একটি দীর্ঘ সময়ের মতো শোনায়, কিন্তু অনেক প্রাণীর তুলনায় এর পরিধি অনেক ছোট। কিছু প্রজাতির কচ্ছপ ১৫০ বছর পর্যন্ত বাঁচে। কিছু কচ্ছপ ৫০০ বছর পর্যন্ত বাঁচতে পারে। এর মানে হলো-তারা অনেক প্রজন্মের মানুষের আসা-যাওয়া দেখতে পারে। সময়ের এ পরিবর্তনের চক্রে তুলনামূলকভাবে তারা অপরিবর্তিত থাকে। কচ্ছপ হলেও তারা পৃথিবীকে বিকশিত হতে দেখে, তাদের চারপাশকে পরিবর্তিত হতে দেখে, কিন্তু তারা তখন একই থাকে। সময়ের হিসাবে কচ্ছপের জীবন বেশি অভিজ্ঞতা লাভ করতে পারে, তুলনায় আমাদের অনেক কম থাকে। কিন্তু তার মানে কি তাদের জীবন আমাদের চেয়ে ভালো?
জীবন মানে সময়ের পরিমাণ নয়, জীবন মানে জীবনের গুণগত মান কতটা হয়। এটা শুধু আমরা কতদিন বাঁচি তা নয়, আমরা কতটা ভালোভাবে জীবনযাপন করি তার ভেতর রয়। জীবন কেবল কত লম্বা সময় ধরে প্রবহমান, তা নয়; আমরা কত স্মৃতি তৈরি করি সে জীবন নিয়ে, সেটাই জীবন। এটি কেবল আমরা কতটা করি তা নয়, আমরা আমাদের জীবনকে কতটা ভালোবাসি, সেটাই তৈরি করে আসল জীবন।
আধুনিক জীবন একদিকে হাতছানি দিয়ে ডাকে-আরও চাওয়ার দিকে। ঠিক পরক্ষণেই না পাওয়ার দ্বন্দ্বে ঠেলে দেয় আরও সজোরে। সময়ে যা পায়, তার চেয়ে বেশি হারায়। সাদাসিধে জীবন এ দ্বন্দ্বের অবসান ঘটায়। প্রয়োজন যেখানে সীমিত, ভালোলাগার বোধ সেখানে অসীম। অপ্রয়োজনের পৃথিবী রুদ্ধ করে দিলে জীবন হয়ে ওঠে অনেক সমৃদ্ধ।
সময়ের দৈর্ঘ্যে কচ্ছপের চেয়ে আমাদের জীবন অনুজ হতে পারে, তবে আমাদের রয়েছে সমৃদ্ধ জীবন। আমাদের এমন একটি জীবন রয়েছে, যা বৈচিত্র্য, জটিলতা, সৃজনশীলতা এবং আবেগে পূর্ণ। আমাদের এমন একটি জীবন থাকে, যা চ্যালেঞ্জ, সুযোগ, শিক্ষা এবং বৃদ্ধিতে পূর্ণ। আমাদের এমন একটি জীবন আছে, যা অর্থ, উদ্দেশ্য, আবেগ এবং আনন্দে পূর্ণ। আমরা যে পছন্দগুলো করি, আমরা যে কাজগুলো করি, আমরা যে কথাগুলো বলি এবং আমরা যে চিন্তা ভাবনাগুলো করি, সেগুলো সম্পর্কে আমাদের সচেতন হওয়া দরকার। এ সচেতনতা আমাদের জীবনের সংক্ষিপ্ত যাত্রাকে সমৃদ্ধ করে।
আমাদের কাজের, আমাদের কথার, আমাদের আচরণের পরিণতি, তার ভালো-মন্দ, উভয়ের জন্য আমরাই দায়ী। আমরা যে উত্তরাধিকার রেখে যাই, তার জন্য আমাদের জবাবদিহি করতে হবে পরবর্তী প্রজন্মের কাছে। বস্তুগত এবং অপ্রয়োজনীয়, উভয়ই, যা আমাদের নেই, তার জন্য অভিযোগ করার পরিবর্তে আমাদের যা আছে, তার জন্য কৃতজ্ঞ হওয়া দরকার। সময়ের কাছে ঋণগ্রস্ত হওয়া চাই। অন্যের সঙ্গে নিজেদের তুলনা না করে আমাদের যা আছে, যেটুকু আছে, তাতেই সন্তুষ্ট থেকে এগোতে হবে।
আমরা যা করি না, তা নিয়ে আফসোস না করে, আমরা যা করি, তাতেই খুশি হওয়া উচিত। আমরা যা পারি না, তা নিয়ে হতাশ না হয়ে, আমরা কী পারি সে বিষয়ে আমাদের আশাবাদী হতে হবে। আমরা যা করব না, তা নিয়ে ভয় না করে, আমরা যা চাই, তার জন্য আমাদের আশাবাদী হওয়া দরকার।
কঠোরতার পরিবর্তে নিজেদের প্রতি সদয় হওয়া দরকার আমাদের। দোষী না হয়ে, কিংবা দোষী সাব্যস্ত না করে আমাদের ভুলগুলোকে ক্ষমা করতে হবে। নিচুতার পরিবর্তে আমাদের অর্জনে গর্বিত হতে হবে। সন্দেহের পরিবর্তে আমাদের দক্ষতার প্রতি আত্মবিশ্বাসী হতে হবে। ঘৃণার পরিবর্তে আমাদের নিজেদের ভালোবাসতে হবে।
নিষ্ঠুর না হয়ে অন্যদের প্রতি সদয় হতে হবে আমাদের। বিচারের পরিবর্তে পরস্পরের পার্থক্যের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে হবে সমাজের। একে অপরে ঈর্ষান্বিত না হয়ে পরস্পরের লক্ষ্যগুলোকে সমর্থন করতে হবে। স্বার্থপর না হয়ে পরস্পরের প্রয়োজনে সহায়ক হতে হবে সময়ে।
উদাসীনতা নয়, তার পরিবর্তে একে অপরের অনুভূতির প্রতি সহানুভূতিশীল হওয়া দরকার। ঘৃণা না করে পরস্পরের প্রতি ভালোবাসার প্রয়োজন। ধ্বংসাত্মক না হয়ে বিশ্বের প্রতি সদয় হতে হবে আমাদের।
মননশীলতা, কৃতজ্ঞতা, সদয় এবং প্রেমময় একটি জীবনযাপন করে আমরা আমাদের সংক্ষিপ্ত জীবনের সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করতে পারি। এমন করে আমরা আমাদের জীবনকে সুন্দর, অর্থপূর্ণ এবং পরিপূর্ণ করতে পারি।
দিন শেষে সূর্যকে যখন আকাশে ডুবতে দেখি, আমরা আমাদের জীবনের দিকে ফিরে তাকাতে পারি। জীবনের দিকে তাকিয়ে আমরা একটু হাসতে পারি।
আমরা হাসতে পারি-কারণ আমরা সুন্দর জীবনযাপন করতে পারি। আমরা হাসতে পারি-কারণ আমাদের কোনো অনুশোচনা থাকে না। ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে আমরা অভিজ্ঞতার কাছে কৃতজ্ঞ থাকি। আমরা হাসতে পারি-কারণ, আমরা চাইলে আমাদের সেরাটা দিতে পারি। আমরা হাসতে পারি-কারণ, আমরা ভালোবাসি। আমাদের জীবন ছোট, কিন্তু আমাদের জীবন সুন্দর, কচ্ছপের চেয়েও সুন্দর।
