Logo
Logo
×

সাহিত্য সাময়িকী

বাবারা মেরুদণ্ডহীন কবি হইয়ো না: আবদুল হাই শিকদার

Icon

ফরিদুল ইসলাম নির্জন

প্রকাশ: ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

আবদুল হাই শিকদার। কবি, প্রাবন্ধিক এবং সাংবাদিক। ১৯৫৭ সালের ১ জানুয়ারি কুড়িগ্রামের ভুরুঙ্গামারী উপজেলার দুধকুমার নদীর তীরে দক্ষিণ ছাট গোপালপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা কৃষিবিদ ওয়াজেদ আলী শিকদার এবং জননী হালিমা খাতুন। তার পিতা-মাতা দুজনই ছিলেন মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানীর আসাম জীবনের ছাত্র। মওলানা ভাসানীর দীর্ঘ ছায়ায় আশৈশব বেড়ে ওঠা তার। পড়ালেখার বেশির ভাগ কেটেছে রংপুরের কারমাইকেল কলেজে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়। পুরো পরিবার অংশ নিয়েছিল মুক্তিযুদ্ধে। লেখালেখির শুরু স্কুল জীবন থেকেই। পেশা জীবন শুরু সাংবাদিকতা দিয়ে, এখনো আছেন সেই পেশাতেই। সাংবাদিকদের বৃহত্তম সংগঠন ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের (ডিইউজে) দুই-দুইবারের নির্বাচিত সভাপতি। মাঝে নির্বাহী পরিচালকের দায়িত্ব পালন করে এসেছেন নজরুল ইনস্টিটিউটে। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম নিয়মিত সাহিত্য মাসিক ‘এখন’-এর তিনি মূল স্থপতি। সাহিত্য-সংস্কৃতির প্রায় সব অঙ্গনে তার রয়েছে সরব পদচারণা। মানবতা, স্বাধীনতা, জাতীয়তাবাদী চেতনার ধারক এই কবির মুখে সব সময় ধ্বনিত হয়েছে প্রেম, প্রকৃতি, বিশ্বমানবতা, শোষণমুক্ত সমাজ ও বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের কথা। তিনি গণমানুষের কবি হিসাবে পরিচিত অর্জন করেছেন। প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা শতাধিক। কবিতায় বিশেষ অবদানের জন্য পেয়েছেন বাংলা একাডেমি পুরস্কারসহ অন্যান্য পুরস্কার ও সম্মাননা। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ফরিদুল ইসলাম নির্জন

আপনার পড়া প্রিয় উপন্যাস কোনটি?

: আমি যে পরিবেশে মানুষ হয়েছিলাম, সেই পরিবেশেটা ছিল অনেক বেশি বনঘেঁষা। রূপকথামিশ্রিত। সঙ্গত কারণেই আমি যে বই পড়ি আপ্লুত হয়েছি সেটা আলিফ লায়লাসহ আরও নানা রকম বই ছিল। কিন্তু যে বই পড়ে হাপুস হুপুস করে কেঁদেছি ছোটবেলায়, সেই বইটি হলো মীর মশাররফ হোসেনের উপন্যাস বিষাদ সিন্ধু।

বইটি কখন কীভাবে সংগ্রহ করেছেন?

: আমার আব্বার একটা পাঠাগার ছিল। ১৯৩৩ সালে অ্যাগ্রিকালচারে গ্র্যাজুয়েশন নিয়েছিলেন বাবা। সারা আসামে সব ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে একমাত্র ছাত্র ছিলেন তিনি, অ্যাগ্রিকালচারে গ্র্যাজুয়েট করেছিলেন। সেই ছাত্রটি মওলানা ভাসানীর খুব আদরের এবং প্রত্যক্ষ ছাত্র ছিলেন। আবার আমাদের পরিবারের অভিভাবক ছিলেন মওলানা হামিদ খান ভাসানী, আমার বাবা-মার বিয়ের ঘটক তিনি, বিয়ে পড়িয়েছেন তিনি। তার প্রেরণায় অ্যাগ্রিকালচারে পড়েন বাবা। বাবার সেই লাইব্রেরিতে মেঘনাদবধ কাব্য, শেক্সপিয়র, বিভূতিভূষণসহ অসংখ্য লেখকের বই ছিল। বাবা আমাদের অমিত্রাক্ষর ছন্দ পড়া শিখাতেন। সেটা পড়াতে গিয়ে বিষাদ সিন্ধু সম্পর্কে ধারণা দিয়েছেন। রক্ত উত্তরাধিকারী হিসাবে বিষাদ সিন্ধু আমাকে হৃদয়ের ভেতরে চ্যালেঞ্জ বানিয়ে রেখেছে। বাবার কালেকশন থেকেই বিষাদ সিন্ধু সংগ্রহ করে পড়েছি।

কী কী কারণে বইটি আপনার প্রিয়?

: অজর, অমর, অক্ষয় কৃতি ছোটবেলায় আমাকে দারুণভাবে আর্দ্র করে রেখেছিল। আমাদের গ্রামে মহররম মাসে শুরু হতো উৎসবের নানা ধরনের প্রস্তুতি। আমাদের মসজিদটির সামনেই বিকালবেলা বসত বিষাদ সিন্ধু পড়ার আসর। বিষাদ সিন্ধুর বিশেষত্ব হলো, আমি মনে করি যে বাংলাভাষায় একমাত্র গদ্য লেখা মহাকাব্য। এটা আমাদের ধর্ম তাত্ত্বিকরা ধর্মীয় বই বলতে গিয়ে নাকচ করেছে, ইতিহাসবিদরা ইতিহাসের বই বলে নাকচ করেছে। কিন্তু লেখক ইতিহাসের বই লেখেননি, ধর্মের বইও লেখেননি। তিনি লিখেছিলেন উপন্যাস। এ উপন্যাসের অনেক কিছু আমাকে ভেতরে ভেতরে দুমড়ে মুচড়ে নানাভাবে কষ্ট দিয়েছে। বিশেষ করে একটা অসাধারণ ডায়ালগ আছে এ উপন্যাসে। যেখানে কাশেম এসে সখিনার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে যাচ্ছে। আর তো দেখা হবে না। সখিনা যে বিদায় ডায়ালগ দিচ্ছে, সখিনা বলিলেন, ‘কাসেম! তুমি আমাকে প্রবোধ দিতে পারিবে না। তবে এইমাত্র বলি, যেখানে শত্রুর নাম নাই, ইয়াজিদের ভয় নাই, কারবালা প্রান্তর নাই, ফোরাত-জলের পিপাসাও যেখানে নাই, সেই স্থানে যেন আমি তোমাকে পাই; এই আমার প্রার্থনা। প্রণয় ছিল, পরিণয় হইল, আর চাই কি?’ এ ঘটনাটা ছোটবেলায় বিপুলভাবে নাড়া দিয়েছিল।

পাঠকরা এ বইটি কেন পড়বে? আপনার বিবেচনায় কী কী শিল্পগুণে সমৃদ্ধ বইটি?

: পাঠকের মনতো কচুরপাতার পানির মতো। কোনটা তার ভালো লাগে, কোনটা তার ভালো লাগে না। এটা তো আরেকজন ব্যাখ্যা করতে পারে না। প্রত্যেক পাঠকের পছন্দ বা অপছন্দ আছে। তবে আমি মনে করি বিষাদ সিন্ধু উপন্যাসে মহাকাব্যিক পটভূমি। এটার মূল ঘটনাটি হয়তো ১০ মহররমের ইমাম হোসাইনের ট্র্যাজিক পরিণতিকে ভিত্তি করে দাঁড় করানো হয়েছে। এখানে একটি বিষয় মনে রাখতে হবে, বিষাদ সিন্ধু উপন্যাস তিন পর্ব। মহরম, উদ্ধার এবং ইয়াজিদ বধ। তিন পর্বের উপন্যাসে মূল নায়ক কিন্তু ইমাম হোসাইন নয়, মূল নায়ক কিন্তু ইয়াজিদ।

কারণ ইয়াজিদের হৃদয়ে যে ব্যথা, ইয়াজিদের হৃদয়ে যে কামনা, বাসনা, আকাঙ্ক্ষা, স্বপ্ন, তার ব্যর্থতা, তার হাহাকার, তার দহন এগুলো বিষাদ সিন্ধুর মূল উপজীব্য। এক্ষেত্রে আপনার বিষাদ সিন্ধুর সঙ্গে তুলনা হতে পারে রামায়ণের কাহিনি নিয়ে মাইকেল মধুসূধন দত্ত যেভাবে পুরো প্রেক্ষাপট পালটিয়ে, রাবণকে তিনি করেছেন মানুষের প্রতিনিধি। রামকে এখানে ছোট করা হয়েছে কিন্তু বিষাদ সিন্ধুতে ইমাম হোসাইনকে ছোট করা হয়নি। ইমাম হোসাইনকে রেখেই ইয়াজিদকে নায়ক করেছেন। জয়নবের প্রতি তার প্রেম আকাঙ্ক্ষা। সেটা ব্যর্থ হয়ে গেল। তারপর বিবি জয়নবের কাছে ইয়াজিদ হাঁটু গেড়ে অশ্রুসজল চোখে যখন বলে, ইয়াজিদের কিসের ঘাটতি ছিল। কেন ইয়াজিদের প্রেম আকাঙ্ক্ষাকে আপনি গ্রহন করেননি। কী হতো! আজকে যে হানাহানি, এই যুদ্ধ, এই রক্তপাত, এই মারামারি, কাটাকাটি, এই হিংসা, বিদ্ধেষ, প্রতিশোধ পরায়ণতা; সব কিছু তো শুধু আপনার জন্য। আপনাকে পাইনি বলেই এত কিছু করতে হয়েছে। এখনো কি আমাকে গ্রহণ করা যায় না? এই যে ইয়াজিদের হৃদয়ের আকুলতা, বেদনা, ব্যর্থতা, হাহাকার, দহন, দাহ এগুলোকে বেজ করে তিন পর্ব পরিচালিত হয়েছে। প্রতিটি পর্বেই কিন্তু ইয়াজিদ রয়েছে। ইমাম হোসাইন কিন্তু শুধু মহররম পর্বে। এই যে জীবনকে ব্যখ্যা করার, জীবনকে অনুধাবন করার, জীবনের সঙ্গে মিলেমিশে যাওয়া... এসব পাঠককে অনেক কিছু দিতে পারে বলে আমার ধারণা।

এমন বই এখন সচরাচর লেখা হয়? হলে উল্লেখ করেন, না হলে কেন হচ্ছে না বলে মনে করেন?

: প্রথম কথা হলো সময়টা বদলে গেছে। কাউকে কোনো দোষারোপ করছি না। প্রেক্ষাপট পালটে যায়, যে যুগে মেঘনাদবধ লেখা হয়েছে সে ১৮৬১ সাল। সে প্রেক্ষাপটটা কি এখন আছে। নাই। জীবন পালটে গেছে। আমি মনে করি প্রগতিশীলতা হলো নদীর মতো এগিয়ে যাওয়া। অতীতের অভিজ্ঞতার আলোকে বর্তমানকে যাচাই-বাছাই করে, বিজ্ঞান, কল্যাণ ও জ্ঞানকে অবলম্বন করে কল্যাণ ও মঙ্গলের জন্য এগিয়ে যাওয়া। এটা হলো আমার চোখে আধুনিকতার সংজ্ঞা। শামসুর রাহমানের বন্দি শিবির থেকে কাব্যগ্রন্থে তোমাকে পাওয়ার জন্য হে স্বাধীনতা বা আল মাহমুদ সোনালী কাবিন যে প্রেক্ষাপটে লিখেছেন এখন কি আরেকটি সোনালী কাবিন লেখা সম্ভব? না, সম্ভব নয়। কাজী নজরুল ইসলামের বাংলাভাষার অন্যতম শ্রেষ্ঠ্য উপন্যাস মৃত্যুক্ষুধা। সাহিত্য হলো জীবনের ব্যাখ্যাগার। বড় ক্যানভাসের জীবনকে উত্থাপন করে।

আপনার লেখা আপনার সবচেয়ে প্রিয় বই কোনটি?

: সন্তান সবই প্রিয়। তবে আমার লেখা সবচেয়ে প্রিয় প্রথম কবিতার বই আশি লক্ষ ভোর।

বইটি লেখা থেকে শুরু করে প্রকাশিত হওয়া পর্যন্ত জার্নিটা জানতে চাই

: কবি ফরহাদ মজহার ছিলেন এ বইটির প্রকাশক। তিনি ডেকে নিয়ে, জোর করে এ বইটি প্রকাশ করেন। তার কাছে অশেষ কৃতজ্ঞতা। আমি বই বের করার মানসিক প্রস্তুতি নেইনি। ফরহাদ মজহারের প্রতিপক্ষ প্রকাশনী সংস্থা থেকে বইটি প্রকাশিত হয়। এ বইটি মাঝরাতে বসে বসে পড়েছি। সিঁথানে নিয়ে ঘুমাতাম। অন্য রকম আবেগ ছিল।

ভালো বই নির্বাচনে পাঠকরা কোন বিষয়টি বিবেচনা করবে?

: মানুষের রুচির ওপর ভিত্তি করে বিবেচনা করবে। তবে আমি বলব জীবনে একবার হলেও ওয়ার্ল্ড ক্ল্যাসিক পড়ে নেওয়া উচিত। একজন পাঠক বই কিনতে গিয়ে অবশ্যই সিলেক্টেড হতে হয়। উপন্যাস, গল্প, কবিতা, ইতিহাস পড়বেন। ভালো বই পড়লে অন্তর জগৎটা ভালো থাকে।

নতুনদের লেখালেখির ব্যাপারে আপনার পরামর্শ

: পরামর্শ ছাড়াই তরুণরা অনেক ভালো কাজ করছে। এদের মধ্যে কারও কারও বই পড়ে চমৎকৃত হই। এত ভালো লাগে আমার, এরা তো ভাষা বদলে দিচ্ছে। শব্দচয়ন, বাক্য গাঁথুনি, ভাষা খুবই সুন্দর। আমার পরামর্শ ছাড়াই যারা এগিয়ে গেছে। তারা সামনের দিন আরও এগোবে। কাউকে পরামর্শ দিয়ে লেখক বানানো যায় না। তবে আমি বলব এখানে আমার দেশের ইতিহাসটা পড়া উচিত। এখানে বেশি দরকার জাতির ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, আকাঙ্ক্ষা, সংগ্রাম। জাতি বলতে এ ভদ্রলোক শ্রেণির জাতি না। এ শহরের শিক্ষিত, মিডেল ক্লাসের না। একবার সর্বনিম্ন পর্যায়ে বাস করে, প্রান্তিক জীবনে ওই মানুষটির হৃদয়ের স্পন্দন যদি লেখক না ধরতে পারে, সে কিসের ঘোড়ার আন্ডার লেখক।

অনুরোধ থাকবে বাবারা আমাদের দেশের মেরুদণ্ডহীন সরীসৃপ কবি হইয়ো না। বেশির ভাগ নিজের ইতিহাস পড়েনি, সাহিত্য পড়েনি। ভারত, কলকতার চামচ দিয়ে চিনি খেয়ে খেয়ে লেখক হয়েছে। ভারত, কলকতা, ইউরোপ থেকে নানা পক্রিয়ায় আসা বর্জ্য মাল, সেগুলোকে গলাধঃকরণ করে মনে করেছে, অমৃত পান করলাম। অথচ নিজের এক হাজার বছরের বাংলাসাহিত্য পড়েও দেখেনি কোনোদিন। সেজন্য তারা কখনো আল মাহমুদ, ফররুখ আহমেদ হতে পারেনি।

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম