|
ফলো করুন |
|
|---|---|
কথাসাহিত্যের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হচ্ছে জীবনকে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করা ও তা থেকে লব্ধ অনুভবগুলোকে গল্পের ভেতর দিয়ে তুলে আনা। ‘পর্যবেক্ষণ’ ও ‘গল্প’ দুটিই খুব তৎপর্যপূর্ণ। শিল্প বিষয়টিও সমান গুরুত্ববহ। আধুনিক কথাকারকে শিল্পচেতন হতেই হবে। উনিশ শতকের বা তারও আগের কথাসাহিত্যিকরা এখনকার লেখকদের মতো এতটা শিল্পসচেতন ছিলেন না। এটা নিয়ে আলাদাভাবে তারা ভেবেছেন বলে মনে হয় না। কিন্তু নিবিষ্টচিত্তে পড়লে ধরা পড়ে, তাদের লেখার স্টাইল এবং গল্প বলার ধরনের মধ্যে ‘শিল্প’ লুকিয়ে আছে। দৃষ্টান্ত হিসাবে শরৎচন্দ্রের কথা বলব। তার সময় সমাজের জটিল আবর্ত, নারীর মনস্তত্ত্ব এসব থাকা সত্ত্বেও গল্পটা কিন্তু তিনি সাদামাটাভাবেই বলতেন। তবে বর্ণনার বেলায় কোথাও কোথাও অভিনবত্ব চোখে পড়ে। এই যে তিনি প্রায়ই লিখেছেন, অমুক ‘মনে-মনে বলিল কিন্তু মুখে কহিল’-এ স্টাইল সম্পূর্ণ তার নিজের। সেজন্য আমি বলি যে, যারা কথাসাহিত্য রচনা করেন, তাদের ভেতর অল্প কিছু ব্যক্তি কথাশিল্পী। রবীন্দ্রনাথ কথাশিল্পী। কিন্তু, প্রভাত কুমার মুখোপাধ্যায় নিছক কথাসাহিত্যিক। হুমায়ূন আহমেদ কথাসাহিত্যিক, কিন্তু শহীদুল জহির কথাশিল্পী।
আমাদের চল্লিশের ও পঞ্চাশের প্রজন্মের লেখকরা রচনার বিষয়বস্তু প্রসঙ্গে ‘জীবনের সমগ্রতা’র কথা বলতেন। সবচেয়ে বেশি বলেছেন হাসান আজিজুল হক। সন্দেহ নেই, হাসান অনেক বড় লেখক; বড় কথাশিল্পী। কিন্তু, যে ‘সমগ্রতা’ নিয়ে তার মাথাব্যথা ছিল তা তার লেখাতেও কি ধরা পড়েছে? পড়া কি সম্ভব? সেটা ফলবান করে তুলতে হলে সব শ্রেণির, সব ধরনের মানুষকেও তাদের সমাজ-সংসগঠনগুলো আনতে হবে লেখায়। কিন্তু বাস্তবে আমরা কী দেখি? এক একজন লেখকের মনের গঠন এক এক রকম। কারণ তারা ভিন্ন ভিন্ন সমাজ-প্রতিবেশ ও শিক্ষা-সংস্কৃতির আবহাওয়ায় বেড়ে উঠেছেন। তাদের অভিজ্ঞতার জগৎও আলাদা আলাদা। তাই আমার মনে হয়, ‘জীবনের সমগ্রতা’ কল্পনা করা সহজ ও সম্ভব; রূপায়ণ সম্ভব নয়। হ্যাঁ, সেটা সমাজ ও জীবনসচেতন অনেক লেখক মিলে করা সম্ভব। তা কোনো একজন লেখকের কর্ম নয়। যদি হেমিংওয়ে, মিলার, ফকনার, কাফকা বা মার্কেজকে এ ধরনের সমগ্রতার বোধ-এর কথা বলা হতো, আমার ধারণা তারা হাসতেন। কমলকুমার মজুমদার কিংবা সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়ের মতো লেখকও বোধ করি অনুরূপ প্রতিক্রিয়া দেখাতেন। ছোটগল্প প্রসঙ্গে a slice of life কথাটা কে বলেছিলেন মনে নেই। তিনি ভারি সত্য কথা বলেছেন। আসলে ‘জীবনের সমগ্রতা’, ‘সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি’ এগুলো জীবন সম্পর্কিত তৃতীয় বিশ্বের ধারণা। জেমস জয়েসের মহাউপন্যাস Ulysses-এর কথা ভাবুন। এ বইয়ে লেখক নায়ক ও তার বন্ধুর একদিনের কর্মকাণ্ড তুলে ধরেছেন। এর ভেতর মিশিয়েছেন স্মৃতি-স্বপ্ন-কল্পনা এবং নানা রকম উদ্ভট চিন্তা। এখানে ‘জীবনের সমগ্রতা’ কোথায়? ফকনার, কাফকা বা সন্দীপনের মতো লেখকদের উপন্যাসেও কি আমরা ওই তথাকথিত সমগ্রতার সন্ধান পাব?
আরেকটি কথা। দেশভাগপূর্ববর্তী সময়ে এমনকি দেশভাগ পরবর্তী এক-দুই দশকে বিকশিত কথাসাহিত্যিকদের প্রায় সবাই বৃহত্তর জনজীবন চিত্রিত করার কথা বলেছেন। ‘বৃহত্তর জনজীবন’ বলতে তারা বুঝিয়েছেন সেসব মানুষকে, যারা উৎপাদনের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত। নিম্নবর্গের মানুষের জীবনের চালচিত্র তুলে আনার পেছনে তাদের প্রধান প্রেরণা ছিল মানিক-বিভূতি, সমরেশ বসু, শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় প্রমুখ লেখক। সে একটা সময় যখন গ্রামের গরিব মানুষদের জীবন নিয়ে লেখকদের কম-বেশি লিখতেই হতো, কেননা শহর তখন ঠিক ‘শহর’ হয়ে ওঠেনি। গত পঞ্চাশ বছরে কিন্তু বিরাট পরিবর্তন ঘটে গেছে। আমি যে শহরে বড় হয়েছি সেই রংপুর সত্তরের দশকের মাঝামাঝি পর্যায়ে ছিল প্রায় গ্রাম। তিরিশ বছরের বেশি সময় ধরে রংপুর রীতিমতো ব্যস্ত শহর-তার ডালপালা ছড়িয়েছে বহুদূর পর্যন্ত। এমন উদাহরণ অসংখ্য আছে। আমার জন্মগ্রাম নতুন অনন্তপুর (কুড়িগ্রাম জেলাধীন) আশির দশকের শেষ দিকেও ছিল এক নিভৃত পল্লি। বিদ্যুৎ ছিল না। মেঠো রাস্তায় ধুলার পাউডার, বিশাল বিশাল বাঁশঝাড়, সুপারি বন, কুঁড়েঘর (টিনের ঘর খুব কমই ছিল), গরুর গাড়ি, মেলা, পালা-পার্বণ চিহ্নিত সেই অনন্তপুরেও শহরের স্পর্শ লেগেছে বহুকাল আগেই। সুতরাং ‘গোলাভরা ধান, পুকুরভরা মাছ’-এর গ্রাম অন্তর্হিত। গ্রামেও এখন ধান্ধাবাজ ও বাটপার শ্রেণির লোক অগণিত; সরল ও বিশ্বাসী মানুষের সংখ্যা নগণ্য। অপরাজনীতি ও নগর আক্রান্ত এ পরিবর্তিত গ্রামের চিত্র আমরা শীর্ষেন্দু-স্বপ্নময়-ইলিয়াসদের লেখায় পেয়েছি, কম হলেও পেয়েছি। নগর-মহানগরগুলোর জীবন আজ জটিলতর। কাজেই শুধু পরিবর্তিত গ্রাম নয়, শহরের জীবনের জটিলতাও বেশি করে ও বিশ্লেষণাত্মক করে তুলে ধরা প্রয়োজন। তাছাড়া স্নেহ-প্রীতি, দেশপ্রেম, ভালোবাসা বা ঘৃণার অনুভূতি, শারীরিক জটিলতা ও তা থেকে জাত অদ্ভুত অনুভবের মতো অনেক শ্রেণি-নিরপেক্ষ বিষয় আছে যেগুলো নিয়ে উঁচুমানের গল্প-উপন্যাস খুবই কম লেখা হয়েছে, বাংলাভাষায়। মনে পড়ছে ‘ফুলের বয়স’ ও ‘মায়ের সঙ্গে দেখা’ নামে ইমদাদুল হক মিলনের দুটি ছোটগল্প। অনেক বছর আগে পড়েছি। রচনাদ্বয়ের আবেদন, লেখকের আরও অনেক গল্পের মতোই এমনই যে, তা আমার স্মৃতিপটে এখনো উজ্জ্বল। প্রথমটিতে একটি কিশোরীর প্রথম ঋতুস্রাবের অভিজ্ঞতা ও দ্বিতীয়টিতে দুটি বালকের মায়ের (পিতার মৃত্যুর পর যে মায়ের অন্যত্র বিয়ে হয়েছে) সঙ্গে সাক্ষাৎ ও নৌকায় চড়ে ফিরে আসার ঘটনা মর্মস্পর্শী ভঙ্গিতে বর্ণিত হয়েছে। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ও হুমায়ূন আহমেদের মতো জনপ্রিয় লেখকেরও এ জাতীয় প্রথম শ্রেণির গল্প কিছু আছে।
এ রকম বেশকিছু লেখক সম্বন্ধে জানি যারা গ্রামে বড় হয়েছেন; গ্রামের স্কুল-কলেজে পড়েছেন, তারপর বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে ভর্তি হয়েছেন ও সেখানকার পড়ালেখা শেষ করেছেন। ইউনিভার্সিটিতে আসা মানে তো শহরে এসে পড়া। আবার দেখা যায়, মাস্টার্স ডিগ্রি নেওয়ার পর চাকরি পেয়ে শহরেই থিতু হয়েছেন তারা। কেবল তা-ই নয়, বহু বছর ধরে শহরেই বসবাস করছেন। প্রশ্ন জাগে, এই যে এতকাল ধরে নগরে আছেন সেই অভিজ্ঞতা কেন তাদের লেখায় ছায়াপাত করছে না বা খুব কমই করছে। কেন তাদের রচনা চৌদ্দ আনাই এখনো গ্রামকেন্দ্রিক? সেটা কি নগরকেন্দ্রিক অভিজ্ঞতার অপ্রতুলতার জন্য, নাকি মানসিকতার জন্য? লেখকভেদে দুটি কারণই দায়ী বলে মনে হয়। আবার এও ভাবি, একচেটিয়া গ্রামনির্ভর গল্প-উপন্যাস লেখার দিন বোধ হয় অবসিত হয়েছে। কেননা বিশ শতকের তিরিশের-চল্লিশের-পঞ্চাশের-ষাটের দশকের সেই নিস্ত-রঙ্গ-নিরুপদ্রব গ্রাম আর নেই। এখন সত্যিকার গ্রাম নিয়ে লিখতে হলে, যদি লিখতেই হয়, স্মৃতির আশ্রয় নিতে হবে। অথবা টাউট-বাটপার অধ্যুষিত, বদলে যাওয়া নতুন গ্রাম নিয়ে লিখতে হলে, যদি লিখতেই হয়, স্মৃতির আশ্রয় নিতে হবে। অথবা টাউট-বাটপার অধ্যুষিত, বদলে যাওয়া নতুন গ্রাম নিয়ে ভাবতে হবে।
জ্যোতিরিন্দ্র নন্দী, নরেন্দ্রনাথ মিত্র, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়, রশীদ করীম, আবু রুশদ প্রমুখের উপন্যাসে ধৃত হয়েছে যে নগর, তার জটিলতা এখন অনেক বেশি। ইউরোপ-আমেরিকা থেকে আগত কোনো ব্যক্তি ঢাকার, কর্মব্যস্ত দিনের রাজপথে হাজার হাজার প্রাইভেট কার দেখে বুঝতে পারবেন না, এ দেশে এখনো লাখ লাখ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে আছে। কোনো পাঁচতারা হোটেলে এক রাতেই অর্ধ কোটি টাকার শুধু মদই বিক্রি হচ্ছে। অন্যদিকে, কাছাকাছি কোনো বস্তিতে একথালা ভাতের জন্য কাড়াকাড়ি-মারামারি চলছে। বিশেষত, তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর সাধারণ মানুষের ভাগ্য নিয়ন্ত্রণ করে চলেছে রাতারাতি আর্থিকভাবে ফুলেফেঁপে ওঠা কয়েকশ মানুষ। শেয়ারবাজারের আলো-অন্ধকার, ব্যাংকসহ অপরাপর বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলোর অস্বচ্ছতা (স্বচ্ছতা কোথায় আছে?), এনজিওর বিরাট ধাপ্পাবাজি, সব সওদাগরি প্রতিষ্ঠানের অনিয়ম-অত্যাচার ক্রমেই আরও অসহনীয় হয়ে উঠছে। মোটাদাগে এসব বিষয় ছাড়াও রাষ্ট্রযন্ত্রের যাবতীয় অকল্যাণকর কর্মকাণ্ড ও অবন্ধুসুলভ আচরণের অশুভ প্রভাব পড়ছে জনমানসে এবং নগরেই এসবের অনিবার্য প্রতিক্রিয়া দেখা দিচ্ছে সবচেয়ে বেশি পরিমাণে। নগরযন্ত্রণা নামক যে বিষয়টির সূত্রপাত উন্নত বিশ্বে একশ বছর আগে হয়েছিল, সেটা আমাদের এখানে দেখা দিয়েছে বছর কুড়ি আগে। সুতরাং বিবর্তিত গ্রামের মতো বিবর্তিত নগরও এখন কথাসাহিত্যের উপজীব্য হওয়ার বেশি বেশি দাবি রাখে। বাংলাদেশের ষাটোত্তর কথাসাহিত্যিকরা কি তাদের লেখায় এসব আনতে পারছেন? হ্যাঁ, খণ্ডিতভাবে কিছু কিছু এসেছে। ওই পরিবর্তনের সামগ্রিক চেহারা কি আমরা কারও লেখায় পেয়েছি? অথচ এটা এ সময়ের দাবি। সে জন্য আমি মনে করি, পরিবর্তিত গ্রামের জীবনের পাশাপাশি পরিবর্তিত শহরের জীবন সার্থকভাবে চিত্রিত করা প্রয়োজন। আর এই যে মধ্যবিত্ত সমাজ-সুবিধাবাদী সামাজ, উৎপাদন প্রক্রিয়ার সঙ্গে যার সম্পর্ক ছিন্ন হয়েছে, তা-ও কি যথেষ্ট জায়গা পেয়েছে আমাদের সাহিত্যে? রশীদ করীম, মাহমুদুল হক, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, রাহাত খান, মঈনুল আহসান সাবের, মঞ্জু সরকার, আবু সাঈদ জুবেরী, সুশান্ত মজুমদারদের কিছু রচনায় এ বিষয়টি ফলপ্রসূ হয়ে উঠেছে বটে, তার পরিমাণের অপর্যাপ্ততা কি আমাদের সাংস্কৃতিক দৈন্যদশার স্মারক নয়?
পৃথিবীতে মানিক, তারাশঙ্কর, বোর্হেস, কাফকা, জয়েস, অরওয়েল সারামাগো, কেনজাবুরো, নাগিব প্রমুখের মতো উঁচুমানের লেখক আসার পরও অনেকেই নিটোল কাহিনি বা ইচ্ছাপূরণের গল্প ফেঁদে চলেছেন। বাংলাদেশে এমন লেখকও অস্তিত্বমান যারা মনে করেন কথাসাহিত্যের বিষয়বস্তুকে কঠিন বাস্তব থেকে আলাদা করতে পারলে শিল্প-সৌন্দর্যের দেখা মিলবে। কমলকুমার, কাফকা, জন বাজার প্রভৃতি লেখককে দৃষ্টান্ত হিসাবে হাজির করান এরা। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, কমলকুমার মজুমদার বা কাফকা কি বাস্তববর্জিত? জর্জ অরওয়েল Animal Farm উপন্যাসে যে অনন্য রূপকের আশ্রয় নিয়েছেন, সেটার পেছনে কি জীবনের রূঢ় বাস্তবতা নেই? এ তো গেল ধারণাগত ভ্রান্তির প্রসঙ্গ। পর্যবেক্ষণ বা অবলোকনের জায়গায়ও আমাদের অনেক ঝামেলা। বাঙালি লেখকের পনেরো আনাই সন্তুষ্ট হয়েছেন জীবনের উপরিতলের চালচিত্র বয়ান করে। তারা সবকিছুই আলগাভাবে দেখেছেন, খেয়াল করে দ্যাখেননি। বাংলাদেশের গত চল্লিশ বছরের গল্প-উপন্যাসের কথা যদি বলি, দেখব; হাসান আজিজুল হক, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, কায়েস আহমেদ, শহীদুল জহির, আহমদ বশীর, আবু সাঈদ জুবেরী, মঞ্জু সরকার, নকিব ফিরোজ-এ রকম অল্প কয়েকজন ছাড়া বাদবাকি লেখকের পর্যবেক্ষণভঙ্গি অস্বচ্ছ বা অযথার্থ। মূলত কবি কিন্তু কথাসাহিত্যেরও উল্লেখ্য মুনশিয়ানার স্বাক্ষর রেখেছেন তেমন দু-তিনজন লেখককে আমি এ অভিযোগের আওতার বাইরে রাখছি। সাহিত্য-শিল্পের প্রধান ভূমিকা রহস্য তৈরি করা। মায়া বা স্বপ্ন-কল্পনার মাধ্যমে এ রহস্য উপস্থাপিত হয়। শিল্প তো বিষয়বস্তু থেকে বিচ্ছিন্ন কিছু নয়। আর কথাসাহিত্য হচ্ছে রাষ্ট্রবাস্তবতা, জীবনবাস্তবতা বা সমাজবাস্তবতার যোগ্য আশ্রয়স্থল। শিল্পচেতনার অতিরেক কিংবা প্রকরণভাবনার বাড়াবাড়ি অসংখ্য গল্প-উপন্যাসকে নষ্ট করে দিয়েছে। এ কালের উপন্যাসে আমরা একটা সুন্দর-অভিনব-অচিন্ত্য গল্প চাই। একেবারে নিটোল গল্পের চেয়ে ভাঙা-ভাঙা কাহিনি হলে আরও ভালো। গল্পটা যেমনই হোক, তা যেন চমৎকারভাবে পরিবেশিত হয়। কাহিনি উপস্থাপনের ধরনটা যেন একেবারে সাদামাটা না হয়ে চমকপ্রদ ও সৃজনী হয়। অথচ বেশির ভাগ ক্ষেত্রে কী দেখি আমরা? দেখি গল্প ও তার উপস্থাপনা কৌশল মামুলি। কখনো আবার গল্প অসাধারণ, কিন্তু তা বলার ভঙ্গি গতানুগতিক। এমনও ঘটে, পুরোনো কাহিনি তবে তা রসায়নের স্টাইলে অভিনব। কমলকুমার ও সন্দীপন উভয়েই আমার প্রিয়। এদের জীবন দেখার ভঙ্গি অনবদ্য। কথাভাষা যথেষ্ট নিজত্বপূর্ণ। কিন্তু দুজনেরই অসংখ্য রচনা শিল্পসর্বস্বতায় পরিণত হয়েছে। আমলকী বেশির ভাগ মানুষের অপছন্দ তার কষ্টে স্বাদের জন্য; কিন্তু সবাই এর খাদ্যগুণ স্বীকার করেন। কমলকুমার বা জেমস জয়েসের মতো লেখকরা হচ্ছেন ওই ‘আমলকী’।
মানুষ স্মৃতির ভেতর বা আগামীর স্বপ্ন-পরিকল্পনার ভেতর বাঁচে, নাগরিক মানুষের বেলায় এটা আরও বেশি সত্য। কেননা জীবনের ও জীবনযাপনের জটিলতা শহরে গভীরতর, যেহেতু চালাকি ও ছদ্মবেশ এখানে বেশি। মানুষ যে স্বপ্নকল্পনায় বা দিবাস্বপ্নে ডুবে থাকতে ভালোবাসে সেটা তো এজন্য যে, পীড়াপ্রদ ও বিরক্তিকর বর্তমানকে অর্থাৎ বাস্তবতাকে সে এড়িয়ে থাকতে চায়। সাময়িকভাবে সে তা করতে পারেও। এখন কথা হচ্ছে, লেখকের যদি ক্ষমতা থাকে, যদি তিনি গল্পভাষা মানে ‘কথাসাহিত্যের ভাষা’ আয়ত্ত করে থাকেন তাহলে ন্যাংটো ও রূঢ় বাস্তবতার ভিতের ওপরই মায়া বা স্বপ্নকল্পনার পরিমণ্ডল সৃষ্টি করতে পারেন। এর সবচেয়ে ভালো প্রকাশ দেখেছি জেমস জয়েস, অনেকখানি থমাস পিনচন (আমেরিকার নতুন কথাশিল্পী), শহীদুল জহির প্রমুখের উপন্যাসে ও গল্পে। আরেকটি কথা, যদি নিছক শিল্প কবিতার উপজীব্য হতে পারে যেমন উইলিয়াম কার্লোস উইলিয়ামস ‘কবিতা’ বিষয়ে কবিতা লিখেছেন একাধিক; তাহলে শিল্পি নিজেই কোনো উপন্যাসের বা ছোটগল্পের বিষয়বস্তু হতে পারে। এটাও ভেবেছি গল্পের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা নিয়ে আসা তেমন কঠিন নয়। কিন্তু একটা উপন্যাসের ভেতর থিমটাকে জমিয়ে তোলা সহজ হবে না।
কেবল বৃহত্তর জনজীবনের নয়, গ্লানি লাঞ্ছিত কলঙ্কিত মধ্যবিত্ত জীবনের অসহায়তা নয়, একজন বিত্তবান ব্যক্তির মনোবেদনা-উৎকণ্ঠা-ভিতিও কথাসাহিত্যের বিষয়বস্তু হতে পারে, হওয়া উচিত। বাংলাসাহিত্যে তেমন গল্প দু-চার-পাঁচটির বেশি মিলবে না। পশ্চিমের সাহিত্যে এগুলো আছে ও ছিল। টাকা-পয়সা, বিত্ত-বেসাত মানুষকে নিরাপত্তা দেয়। আবার সেই অর্থকড়ির আতিশয্য মানুষের ঘুম কেড়ে নেয়। এখন এ রকম একজন মানুষের মনোকষ্টকে আমি গল্পের উপজীব্য করব না কেন? সে ধনী লোক বলে? সে ধনী হয়েছে সৎপথে নাকি অপরাধের পথে সেটা ভিন্ন প্রসঙ্গ। একজন আধুনিক কথাসাহিত্যিক, যদি তিনি শিল্পী হন, ওই জিনিস নিয়ে মাথা ঘামাবেন না। তিনি বরং এ কথা মাথায় রাখবেন যে, ‘কী বলতে চাই’-এর চেয়ে ‘কীভাবে বলতে চাই’ অনেক বেশি গুরুত্ববহ। আর আধুনিকতার লক্ষণঋদ্ধ ও বিষয়সমৃদ্ধ গল্প-উপ্যাস রচনা সম্ভব হয়ে ওঠে তখনই, যখন লেখকের থাকে শিল্পীসুলভ রুচি এবং হৃদয়গ্রাহী গল্পভাষা।
